২০২৩ সালের নতুন পাঠ্যক্রম নিয়ে ২০২২ সাল থেকেই গণমাধ্যমে নানা প্রতিবেদন, আলোচনা, সমালোচনা হয়ে আসছিল। শিক্ষা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করা লোকজনের মধ্যে একটু কৌতূহলও কাজ করছিল, আসলে কি হতে যাচ্ছে, কি থাকছে নতুন পাঠ্যক্রমে। পুরোটা না জানতে পারলেও আমরা যতটুকু জেনেছিলাম পরিবর্তনের একটা বড় জায়গা ছিল, মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত বিজ্ঞান, মানবিক এবং বাণিজ্য বিভাগ থাকবে না। শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন হবে বছরব্যাপী তাদের পারদর্শীতা, সামস্টিক পারদর্শীতা এবং আচরণের উপর ভিত্তি করে। কিন্তু পাঠ্যবইয়ে আসলে কি কি কন্টেন্ট থাকবে, সেগুলি নিয়ে তেমন আলোচনা ২০২২ সালেও হয়নি, ২০২৩ এ এসেও হচ্ছে না। আলোচনা হচ্ছে কয়েকটি নির্বাচিত কন্টেন্ট। তার মধ্যে অন্যতম হল বিবর্তনবাদ। আলোচনা হচ্ছে আরআরএস এর পরামর্শে পাঠ্যবই এ কন্টেন্ট অন্তর্ভুক্তি নিয়ে। আলোচনা, সমালোচনা হচ্ছে ডক্টর জাফর ইকবালের সম্পাদনায় সপ্তম শ্রেণির “অনুসন্ধানী পাঠ “বইয়ের প্রথম অধ্যায়ের কন্টেন্ট ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ডট ওআরজি থেকে হুবহু টুক্লি করে গুগল গুগল ট্রান্সেলটর’র সাহায্যে অনুবাদ করা হয়েছে। এইটা করা যে অন্যায় কিছু না, সেটার পক্ষেও কেউ কেউ যুক্তি দিচ্ছেন? ইতোমধ্যে সম্পাদকদ্বয় এই ঘটনার সত্যতা এবং দায় স্বীকার করে আনুষ্ঠানিকভাবে দুঃখ প্রকাশও করেছেন। সেইটা নিয়েও পক্ষে-বিপক্ষে নানা আলোচনা হচ্ছ। স্কুল লেভেলে বিবর্তনবাদ কেন অন্তর্ভুক্ত করা হল, সেটা নিয়ে খোদ বিশ্ববিদ্যালয়েরই কোনো কোনো শিক্ষক প্রশ্ন তুলেছেন। এই প্রশ্ন তুলবার কারণ কিন্তু এটা স্কুল পর্যায়ের ছাত্রছাত্রীদের উপযোগী কি’না, সেটা নয়; প্রশ্নের জায়গা হল, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ নাকি বিবর্তনবাদ তত্ত্ব বিশ্বাস করেন না। কেউ কেউ আরো এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলছেন, ধর্মশিক্ষা বলে তো আর কিছু থাকল না। ২০২১ সালে যে পাঠ্যক্রমের রুপরেখা প্রণয়ণ, ২০২২ সালে বিস্তরণ এবং ২০২৩ সালে এসে বাস্তবায়িত হতে যাওয়া নতুন এই পাঠ্যক্রমকে নিয়ে যে আলোচনা, সমালোচনা হচ্ছে সেটা হওয়ায় স্বাভাবিক। আলোচনা, সমালোচনার মধ্য দিয়েই তো শিক্ষাক্ষেত্রে এই নবযাত্রা পোক্ততা পাবে। কিন্তু আমরা যদি এই রকম খণ্ডিত এবং আংশিক সমালোচনা করি এবং নিজের বিশ্বাস, অবিশ্বাসের সাথে শিক্ষার মত গুরুত্বপুর্ণ বিষয়কে গুলিয়ে ফেলি, তাহলে সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর এ পর্যন্ত এক ডজনের বেশি শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে কিন্তু অদ্যাবধি আমরা বিজ্ঞানভিত্তিক গণমুখী কোনো সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ণ করতে পারি নাই এবং খুব শীঘ্র সেটা পারার সম্ভাবনাও কম। কারণ হল, আমাদের সত্যিকার অর্থে কোনো শিক্ষা দর্শন নেই। আমাদের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখে আসলে কি হবে, পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রে তারা কোথায়, কি অবদান রাখবে, সেইটা আমরা এখনও ঠিক করতে পারি নাই। প্রত্যেকের মধ্যে যে সহজাত প্রতিভা আছে, সেইটাকে কিভাবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে লালন করে তাকে বিকশিত করা যায়, সেইটা আমরা নিশ্চিত করতে পারি নাই। সেই আলাপে আজ যেতে চাই না, বরং যে বিষয়গুলি নিয়ে আজ আলোচনা, সমালোচনা হচ্ছে, তার বাইরে গিয়ে একটা ছোট প্রশ্ন নিয়ে আলাপটাকে একটু এগিয়ে নিতে চাই।
প্রশ্নটা হল, স্কুল পর্যায়ের বই কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরককে লিখতে হয়, কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সম্পাদনা করতে হয়? এই প্রশ্নের একাধিক উত্তর হতে পারে। হতে পারে স্কুল পর্যায়ে স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবই প্রণয়ণ এবং সম্পাদনার জন্য উপযুক্ত শিক্ষক নাই। হতে পারে স্কুল পর্যায়ের শিক্ষকেরা লিখলে কিংবা সম্পাদনা করলে পাঠ্যবই এর মান যা হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা করলে তার থেকে অনেকগুণ ভাল হবে। হতে পারে স্কুল, কলেজের শিক্ষকদের চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দেশ-বিদেশের অভিজ্ঞতা এবং হালনাগাদ জ্ঞান লাভের সুযোগ তুলনামুলকভাবে বেশি থাকে, যার প্রতিফলন তাঁরা পাঠবই এ ঘটাতে পারেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ঠিক কোন যুক্তিতে স্কুল পর্যায়ের পাঠ্যবই প্রণয়ণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরকে যুক্ত করেন, সেটা আমার জানা নেই। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা কেন এখানে যুক্ত হন, সেইটা আমি কিছুটা জানি কিছুটা অনুমানও করতে পারি। সেই প্রসঙ্গেও আমরা আজ যাব না। আমি নিজের প্রশ্নের যে একাধিক উত্তর নিজেই অনুমান করে নিয়েছি, সেগুলি বা সেগুলির কোনো একটা উত্তরও যদি হ্যাঁ বা সঠিক হয়, তাহলে বলতে হবে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পার হয়ে যাবার পরও নিজেদের ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াবার জন্য পাঠবই প্রণয়ণ এবং সম্পাদনার জন্য স্কুল পর্যায়ে কোনো শিক্ষক গড়ে উঠেনি কিংবা উঠতে দেওয়া হয় নাই। যদি আমার শেষের প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ হয়, তাহলেও বলতে হবে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, আমাদের রাস্ট্রযন্ত্র স্কুল পর্যায়ের শিক্ষকদের বঞ্চিত করেছে যুগোপযোগী মানুষ হিসাবে গড়ে উঠতে। তাহলে যে মানুষ যুগের উপযুক্ত নন, তিনি কিভাবে তার পরবর্তী প্রজন্মকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন? ফলতঃ যা হবার তাই হয়েছে, তাই হচ্ছে। সপ্তম শ্রেণির বইয়ের যে কন্টেন্ট নিয়ে এত কথা হচ্ছে, আমার জানামতে মাস্টার ট্টেইনার এবং প্রত্যেকটা বিষয়ের শিক্ষকদের প্রথম দফা প্রশিক্ষণ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে নতুন কারিকুলাম নিয়ে এবং প্রশিক্ষণের পুর্বেই শিক্ষকেরা প্রত্যেকেই তার নিজ বিষয়ের বই হাতে পেয়েছেন। সারা বাংলাদেশে একজনও স্কুল পর্যায়ের শিক্ষক পাওয়া গেল না, যিনি বিষয়টাকে সামনে আনতে পারতেন। কিন্তু বিবর্তনবাদ নিয়ে স্কুল পর্যায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষকদের একাংশের আপত্তির কথা আলোচনা য় চলে এসেছে। তার মানে শিক্ষকদের কাছে বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য-উপাত্তের চেয়ে, অনুসন্ধনে, বিশ্লেষণের চেয়ে নিজের ব্যক্তিগত বিশ্বস, অবিশ্বাস অনেক বড় ব্যাপার।
জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের একটা কথা আছে, “একখান বই পইড়া আপ্নে তখনই বুঝবেন যে বইখান আপ্নের পড়া হইছে, যখন বইখান আপ্নে নিজে ল্যাখতে পারেন” । এই কথার অর্থ আমি যেভাবে বুঝি, যে লেখা বা বই পড়ে আমি আমার মত করে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে পারি কিনা। কথা তো পরিস্কার, ডক্টর জাফর ইকবালের সম্পাদনায় সপ্তম শ্রেণির বইয়ের আলোচিত, সমালোচিত অধ্যায়টি পড়ে নিজের মত করে ল্যাখবার মত একজন শিক্ষকও আমাদের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নাই। তাহলে তারা কিভাবে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াবেন? আমি যে নাই বললাম, কথাটা আমি নিজেও বিশ্বাস করি না, আমাদের অনেক মেধাবী শিক্ষক আছেন, কিন্তু এইটাকে তারা তাঁদের কাজ বলে মনে করেন না। কিন্তু পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ণ কিংবা সম্পাদনার দায়িত্ব পেলে তাঁরা আবার না ও করেন না। কারণ এখানে নগদ নারায়ণ বলে একটা ব্যপার থাকে। আলোচনা দীর্ঘ হচ্ছে। একটা ঐতিহাসিক বিষয় উল্লেখ করে আজকের আলোচনার ইতি টানতে চাই। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধুর সাথে কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ট্রোর সাক্ষাতে প্রেসিডেন্ট ক্যাস্ট্রো বঙ্গবন্ধুর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, আপনি এতবড় যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করলেন, এখন দেশ পরিচালনা করবেন কাঁদেরকে দিয়ে, প্রশাসনে কারা থাকবে? উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, কেন যারা আছেন, তাঁদেরকে দিয়ে, নতুন অভিজ্ঞ এবং দক্ষ লোক আমি কোথায় পাব? ক্যাস্ট্রো সেদিন কূটনৈতিক শিষ্টাচার এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতি সম্মান রেখেই কথা এই প্রসঙ্গে কথা বাড়াননি। শুধু বলেছিলেন, নতুন দেশের নতুন অভিজ্ঞতায় দেশপ্রেম থাকলে দক্ষতা এমনিতেই গড়ে উঠবে। ক্যাস্ট্রো মূলতঃ পাকিস্তানীদের দ্বারা নিয়োগকৃত এবং প্রশিক্ষিত আমলাদেরকে বাদ দিতে বলেছিলেন। দেশপ্রেমিক নতুন প্রজন্মকে যুক্ত করতে বলেছিলেন। কিন্ত তা তো হয় নাই। ফলতঃ আমাদের প্রশাসন এবং জনগণের মধ্যে যোজন যোজন দুরত্ব। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা স্কুলের পাঠ্যবই প্রণয়ণ করেন তাঁদের ক’জনার সাথে স্কুলের শিক্ষার্থীদের সাথে এমনকি শিক্ষকদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ আছে। কোনো বই রচনার আগে তাঁদের কয়জন, এই বই যারা পড়বে, তাদের মুখটা মানসপটে কল্পনা করতে পারেন?
আমার মনে হয়, স্কুলেই বই প্রণয়ণ এবং সম্পাদনার জন্য স্কুল থেকে শিক্ষকদেরকে যুক্ত করতে হবে, তাঁদেরকেই অন্যদেশ ভ্রমণ, নিবিড় প্রশিক্ষণ এবং প্রয়োজনীয় দক্ষতা উন্নয়নের জন্য যা যা প্রয়োজন, তার যাবতীয় ব্যবস্থা করতে হবে। তবে সবার আগে ঠিক করতে হবে, কি হবে আমাদের শিক্ষা দর্শন? সেটা ঠিক হলেই স্কুলের বই, স্কুলের শিক্ষকেরাই লিখবেন, সম্পাদনা করবেন এবং পড়াবেন এমনকি সেখানে যুক্ত হবে শিক্ষার্থীরাও। স্বপ্নের মত মনে হতে পারে। হোক না, মানুষের স্বপ্নই তো একদিন বাস্তবে রূপলাভ করে।