ইসরায়েলে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকার সবেমাত্র ক্ষমতায় এসেছে। এখনি বিচার ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা খর্ব করতে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছেন। তার জোটের অতি-ডানপন্থি ও অতি-কট্টরপন্থি দলগুলোর প্রতি অনেক মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে এবং তারা জাতীয় নিরাপত্তা, স্বরাষ্ট্র, অর্থসহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ পেয়েছে।
কিন্তু দেশটির বিচারমন্ত্রী হিসাবে নিয়োগ পেয়েছেন ইয়ারিভ লেভিন। তিনি নেতানিয়াহুর লিকুদ পার্টির সদস্য এবং তার একজন ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা। ইসরায়েলি গণতন্ত্রের ওপর সবচেয়ে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে এ সিদ্ধান্ত।
নেতানিয়াহুর আইনি সংস্কার বাস্তবায়ন হলে সরকার সুপ্রিম কোর্টের কিছু রায় বদলে দেওয়ার ক্ষমতা পাবে এবং বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রেও সরকারের ক্ষমতা আরও বেড়ে যাবে। বিচারমন্ত্রী ইয়ারিভ লেভিন অবশ্য এমন পদক্ষেপকে ‘সংস্কার’ হিসেবে তুলে ধরে বিচার বিভাগকে বরং আরও শক্তিশালী করার এবং জনগণের আস্থা ফেরানোর দাবি করেন।
দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ইয়ারিভ লেভিন দৃঢ়ভাবে স্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা রোধ করতে বদ্ধপরিকর। নতুন এ মন্ত্রী, একজন আইনজীবী ও প্রতিষ্ঠানের প্রবীণ সমালোচক হিসাবে ‘ওভাররাইড ক্লজ’ করতে চান। এটি নেসেটে আদালতের মাধ্যমে অসাংবিধানিক বলে বিবেচিত আইন পাস করার অনুমতি দেবে। তার প্রস্তাবের অধীনে আদালত আর ‘যৌক্তিকতার’ ভিত্তিতে সরকারি সিদ্ধান্ত বাতিল করতে পারবে না। রাজনীতিবিদরা বিচারক নিয়োগ করবেন এবং সরকারের আইনি উপদেষ্টা, বর্তমানে একটি স্বাধীন গোষ্ঠী, রাজনৈতিক নিয়োগকারীদের মাধ্যমে প্রতিস্থাপিত হবে।
নির্বাচিত সরকার ও স্বাধীন বিচার বিভাগের মধ্যে উত্তেজনা ইসরাইলের জন্য অনন্য নয়। কিন্তু ইসরায়েলের একটি আনুষ্ঠানিক সংবিধানের অভাব রয়েছে। দেশটির নির্বাচন ব্যবস্থা, যা সাধারণত কয়েকটি ছোট কিন্তু রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী বিশেষ করে স্বার্থবাদী দলগুলোর জোটে পরিচালিত হয়।
ইসরায়েলি রাজনীতিবিদরা আদালতের লাগাম টানতে চাইছেন। ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠাতা প্রধানমন্ত্রী, বাম লেবার পার্টির ডেভিড বেন-গুরিয়ন, সুপ্রিম কোর্টের উদ্বোধন এড়িয়ে যান। আরেকজন লেবার প্রধানমন্ত্রী, ইতজাক রাবিন, তার জোটের ধর্মীয় সদস্যদের সন্তুষ্ট করার জন্য ১৯৯৪ সালে একটি নির্দিষ্ট আইনের ‘ওভাররাইড’ ধারায় সম্মত হন। নতুন নেতানিয়াহুর সরকার মূলত এমন রাজনীতিবিদদের নিয়ে গঠন করা নীতিগতভাবে যারা অনির্বাচিত বিচারকদের হস্তক্ষেপে আপত্তি করে। তারা এতেও অবিচল যে তারা প্রকৃত গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখছে।
ইসরায়েলের বিচারকরা একমত নন এই প্রস্তাবের পক্ষে। গত ১২ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের প্রেসিডেন্ট, এসথার হায়াত, জনসমক্ষে সরকারি নীতির সমালোচনা করার বিরল পদক্ষেপ নেন। লেভিনের পরিকল্পনাকে ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য একটি মারাত্মক ক্ষত’ বলে অভিহিত করেন তিনি। হায়াত বলেন, যদি তারা পাস করতে পারে, তাহলে সংস্কারগুলো ‘স্বীকৃতির বাইরে দেশের গণতান্ত্রিক পরিচয় পরিবর্তন করবে।’
সাংবিধানিক আইনজীবী ও ইসরায়েল ডেমোক্রেসি ইনস্টিটিউটের ভাইস-প্রেসিডেন্ট সুজি নাভোট যুক্তি দেন এবং বলেন, নেতানিয়াহুর সরকার যেভাবে এটিকে নিয়ে যাচ্ছে, ‘রাজনৈতিক ইচ্ছার ভিত্তিতে’ এই পরিবর্তনগুলোর অর্থ হবে সরকারের ক্ষমতার ওপর যে কোনও চেক অপসারণ করা। গণতন্ত্রের জন্য একটি সত্যিকারের হুমকি।’
ইসরায়েল সরকারের পরিকল্পনাটি খণ্ডিত ও হতাশাগ্রস্ত বিরোধিতাকে পুনরুজ্জীবিত করেছে। ১৪ জানুয়ারি প্রায় আশি হাজার বিক্ষোভকারী কেন্দ্রীয় তেল আবিব ও অন্যান্য শহরে জড়ো হন এই সংস্কারের বিরুদ্ধে। সরকারের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেয় তারা।
নেসেট আইন কমিটির চেয়ারম্যান, সিমচা রথম্যান বলেন, আমরা প্রশাসনিক পর্যালোচনার সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতাকেও স্পর্শ করছি না। ধর্মীয় জায়নবাদের রথম্যান, একটি অতি-ডানপন্থি ব্লকের।
অতীতে ইসরায়েলের আইনি ব্যবস্থা নজির স্থাপন করেছে। একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। যৌন নিপীড়নের দায়ে একজন রাষ্ট্রপতিকে কারাগারে পাঠানো হয়। নেতানিয়াহু নিজেই ঘুষ ও প্রতারণার অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছেন। প্রস্তাবিত পরিবর্তনগুলো তার মামলাকে সরাসরি প্রভাবিত করবে না, তবে বিচার বিভাগের সঙ্গে মীমাংসা করার জন্য তিনি ব্যক্তিগত স্কোর নিয়ে অফিসে ফিরেছেন এমন ধারণা এড়ানো কঠিন।
অতীতে নেতানিয়াহু নিজেকে সুপ্রিম কোর্টের স্বাধীনতার একজন চ্যাম্পিয়ন হিসাবে উপস্থাপন করেছেন। তিনি সত্যিকার অর্থে তার মন পরিবর্তন করেছেন বা রাজনৈতিক সুবিধার জন্য তা করেছেন কিনা সেটি এখনো অজানা।
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট