প্রবহমান: পর্ব – এগারো

হোসনে আরা মণি
হোসনে আরা মণি
15 মিনিটে পড়ুন
প্রবহমান

ভাতুরিয়া আর বালিদিয়া পাশাপাশি দুই গাঁ। গা লাগালাগি করে থাকলেও আসলে তাদের শরীর যেখানে লেগে আছে তার নাম পিঠ। বিরাগ, নাকি ঘেন্নায় তারা কেউ কারো মুখ দেখতে চায় না। উল্টোমুখী হয়ে – একজন পূবমুখো, আরেকজন পশ্চিমমুখো; সেই কোন কাল থেকে যে তারা বসে আছে তা জানে না এর অধিবাসীরাও। তারা শুধু জানে যে সময় সময় এই দুই গাঁও ঝড়ের বেগে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে মুখোমুখি দাঁড়ায়ে পড়ে। তারপর কী হয় তা বলতে পারে কেবল প্রত্যক্ষদর্শী জীবিতজনেরা। দুই গাঁয়ের দাঁত-নখের আঘাতে যে দুই-চার-পাঁচ হালি ঘটনাস্থলেই কতল হয় তারা তাদের নিজ নিজ গ্রামের কাছে দিনকতকের জন্য শহীদের মর্যাদা পায়। কিন্তু বিস্মরণপ্রিয় মানুষেরা অচিরেই তাদের ‘অবদান’ ভুলে যায়। বরং তারা শহীদদের পরিত্যক্ত আর সব সম্পত্তির মতই সুন্দরী যুবতী বিধবাদের মালিক হওয়ার ফিকির করে। কাইজের পর পুলিশ কখনো আসে, কখনো আসে না। মহকুমা সদর থেকে পাক্কা আট ক্রোশ পথ এই ভাতুরিয়া-বালিদিয়া সীমান্ত। সে পথও বড় সহজ পথ নয়। মাঠ-ঘাট-বন-বাদাড়-নদী-নালা-খাল-বিল পেরোয়ে পায়ে হাঁটা আর বড় জোর গরুর গাড়ি চলা পথে পুলিশের কনস্টেবল তো সাধ করে পা রাখতে যায় না। শক্ত মামলা হলে, অর্থাৎ কিনা যখন ধর-পাকড় করতে যাওয়া একান্তই আবশ্যক, তখন তারা রওনা হয়। তারপর যেতে যেতে সারা পথ মুখ খারাপ করে। গালাগাল করে প্রথমে পথের দুর্গমতার পরে, বড়কর্তার আদেশের পরে, পুলিশের চাকরির পরে এবং তা শেষ হয় নিজের ভাগ্যটারে দোষারোপ করে। অনেক সময় তাদের গালাগাল ম্বশুরবাড়ির কুটুম্ব সম্পর্ক ধরে শুরু হয়ে অচিরেই শ্লীলতার সব সীমা অতিক্রম করে। তা করবে নাই বা কেন? যে এলাকায় চাষের জমির চেয়ে সরকারের বাঁধা রাস্তা চলাচলের বেশি অনুপযোগী সেখানে কে যায় ডিউটির নামে জীবনপাত করতে? উঁচু-নিচু-খানা-খন্দ-কাটা-ছেঁড়া তো আছেই, তার চেয়ে মারাত্মক এর মাটি। শুকনো মৌসুমে পায়ে চলা পথে হাঁটু ডোবা মিহি ধুলোÑ যেন ধুলিরাজ্য। ওদিকে কৃষকের চষা খেতের মাটির দলা রোদে শুকায়ে শুকায়ে শক্ত যেন ঝামা। হালকা বর্ষায় পথ প্রথমে পিছল – এমন পিছল যে খালি পায়ে আঙ্গুলে টিপে পা গুনে গুনে এত সতর্ক হয়ে ভারসাম্যের পরীক্ষা দিতে দিতে পথ চলতে হয় যে, আধঘন্টার পথ দুই ঘন্টাতেও পেরোনো দুষ্কর। একটু অসতর্ক কি অনভ্যাসেই এক পিছলে দশহাত পেরিয়ে – ধপাস! আর বর্ষার বয়স বেশি হলে, যেমন- আষাঢ়ের মাঝামাঝিতে গোড়ালি ডোবা আঠালো কাদা – এমনই আঠা যে বহু কষ্টে এক পা তুললে তার সাথে উঠে আসে এক চাপড়া খামিরের মত কাদামাটি, এদিকে আরেক পা তখন দেহের ভারে পোতা হতে থাকে জমিনের গভীরে। এরপর শ্রাবণ-ভাদ্রে নদী-নালা উপচে বন্যায় মাঠ-ঘাট ভেসে যাওয়ার কালে পথ-অপথ সবই যখন একাকার তখন ডিঙ্গি আর তালের ডোঙ্গায় করে আর যাই হোক আসামী ধরতে যাওয়া চলে না। সব বছর পানি এত বেশি হয় না যে সবখানে অনায়াসে বড় নাও বাওয়া চলে। বন্যার পানি নেমে গেলে ফের সেই কাদারাজ্য। এবারের কাদা পলির সম্পৃক্ততায় বড় মোলায়েম – পাগুলো অনায়াসে গেঁথে যায় হাঁটু অবধি।
তো এমন নরম রসালো যে জমিন তার মানুষেরা কেমন করে হয় অত শক্ত-বাঁকা যা সোজা করতে হানা দিতে হয় পুলিশের? কী নিয়ে, কোন স্বার্থের হেরফেরে তারা করে কাটাকাটি, ঢাল-সড়কি নিয়ে বেরিয়ে আসে বর্বরযুগের উন্মাদনায়?
সেবার বোশেখ মাসের শেষদিকে ভাতুরিয়ার গনু মন্ডলের বড় ভুঁয়ের পাটের চারা বালিদিয়ার ছমির শেখের দুর্দান্ত বদমেজাজি ষাঁড়টা সাবাড় করে চলছিল। কার কাছে খবর পেয়ে এসে গনু মণ্ডলের বড় ব্যাটা সেটাকে প্রথম খালি হাতেই তাড়া করে। কিন্তু একগুঁয়ে ষাঁড়টা তাকে একটুও ভয় না পেয়ে বরং ফোঁস ফোঁস করে নাক দিয়ে গরম ভাপ বের করে বিরক্তি ও রাগ প্রকাশ করতে থাকলে প্রথমে সে হাতের কাছে যা পায় তাই দিয়ে, অর্থাৎ ইটেল ছুড়ে তাড়াতে চেষ্টা করে। কিন্তু পলি মাখা এঁটেল মাটির জমিনে ফাল্গুন-চৈত্র ছাড়া মজবুত ইটেল পাওয়া দুষ্কর। তার উপর দুই দিন আগে বয়ে যাওয়া কালবোশেখির সাথে বেশ বৃষ্টি হওয়ায় মাটি সেদিন ভেজা ভেজা কোমল। জুত হচ্ছে না দেখে গনুর ব্যাটা ইতিউতি চেয়ে দেখে অদূরেই পেয়ে যায় এক কচা গাছ। ব্যাস, মট করে একটা কচার ডাল ভেঙ্গে নিয়ে চলছিল ষাঁড় তাড়ানোর চেষ্টা। কিন্তু দুর্দম ষাঁড়টা যে উল্টে তার দিকেই তেড়ে আসে! ব্যাটা বাপকে ডাকে, ডাকে ভাইদের। বাপ-ভাইয়েরা সে ডাক সরাসরি শুনতে না পেলেও যারা শুনছিল এবং দেখছিল, তারা মুখে মুখে খবরটা পৌঁছে দেয় যেন টেলিগ্রাফের চেয়ে দ্রুতগতিতে। এরপর যা ঘটে তাতে ষাঁড়ের গোজীবন সাঙ্গ হওয়ারই কথা। গনু মন্ডলের ব্যাটারা চাইলে একটা মেজবানি লাগিয়ে দিতে পারতো। কিন্তু নানা বিবেচনায় তাদেরকে সেটা করতে দেয় না কয়েকজন বিবেচক মুরব্বি। তারা বরং ষাঁড়টাকে খোঁয়াড়ে রেখে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। পরদিন খোঁয়াড় থেকে ষাঁড় ছাড়িয়ে নিতে আসে ছমির শেখের তিন ব্যাটা। খোঁয়াড়ের জরিমানার টাকা নয়, বরং তারা হাতে বয়ে আনে তিনটে চকচকে বাঁশের লাঠি। লাঠিয়াল হিসাবে ছমির শেখের ব্যাটাদের সুনাম আছে তল্লাটে। যেমন দশাসই তাদের চেহারা, তেমনি আসুরিক তাদের মেজাজ। তাদেরকে একসাথে লাঠি হাতে দেখলে ডরায় না এমন বাহাদুর কমই আছে গাঁয়ে। কিন্তু ভাতুরিয়ার সব মানুষ তো আর ভাতের বদলে ফেন খায় না। পালোয়ান না থাক, তাদেরও আছে কিছু সিপাই-বরকন্দাজ। কাজেই ছমির শেখের ব্যাটাদের অন্যায় আচরণের সমুচিত জবাব দিতে ভাতুরিয়ার কেউ কেউ রুখে দাঁড়ায়। তর্ক-বিতর্ক, ধমকানি-চোখরাঙানি সত্যিকারের বীরেরা বেশিক্ষণ চালায় না। বীরেরা তর্কবাগীশ হয় না। তারা কথার চেয়ে কাজে বিশ্বাসী। কাজেই অচিরেই ছমির শেখের এক বীরজাতকের মাথা ফাটে এবং অন্য দুজন এর শোধ নেবে বলে হুঙ্কার দিয়ে তখনকার মতো রণে ক্ষান্ত দিয়ে ফেরে নিজ গ্রামে। এরই জের ধরে পরদিন মুখোমুখি দুই গ্রাম। কোন মীমাংসার পূর্বচেষ্টা ছাড়াই হয়ে যায় এক ব্যাপক রক্তক্ষয়ী কাইজে। যে কাইজে পরে পরিচিতি পায় গনুর কাইজে বলে।
পুরুষেরা কাইজে করে। নারীরা ঘরে বসে বুক চাপড়ায়, আল্লাহকে ডাকে, পীরের দরগায় জোড়া মোরগ মানে, মক্কা শরীফে মানত করে গিলাফ কিংবা মোমবাতি। কোন নারী চেষ্টা করে স্বামীকে বাঁধা দিতে। চোখের সবটুকু মিনতি আর বুকের সব প্রেম দিয়ে চেপে ধরে রুখতে চায় স্বামীকে। কিন্তু পুরুষ যখন খুনের নেশায় পাগল তখন কি আর তারে বাঁধতে পারে প্রেম! আর নেশাটাতো এমনি এমনি চাপে না। শুধুই খুনের নেশায় খুন করে কজনে! বাড়া ভাতে ছাই ঢাললে, পাকা ধানে মই দিলে কি মাথায় কাঁঠাল ভাঙতে চেষ্টা করলেও যদি তারা সয়ে থাকে, তবে তো তারা বেমরদের দল। অমন হলে কুরুক্ষেত্তর, লঙ্কাকাণ্ড দূরে থাক, এই যে কদিন আগে মহাযুদ্ধ হয়ে গেল, তারও তো কোন দরকার পড়ত না। কোথায় কোন যুবরাজ আর তার বিয়ে না হওয়া বৌয়েরে কে মারল তাই নিয়ে সারা দুনিয়া ঝাঁপায়ে পড়ার কী ছিল দরকার? হাঁ, দরকার ছিল, দরকার আছে, দরকার থাকবে। আর তাই যুদ্ধও হবে। যুদ্ধ জীবন নেয়, আবার জীবন দেয়ও। যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপের উপরও অসীম সম্ভাবনা নিয়ে গজিয়ে ওঠে সতেজ-সবুজ অঙ্কুর। যুদ্ধ মানচিত্র বদলে দেয়, বদলে দেয় যেকোন ভূমির ইতিহাস, সভ্যতা। কিন্তু এই বদলটাও এক অর্থে প্রাকৃতিক। বদল জরুরী বলেই মানুষের রক্তে রোপিত আছে ঘুরে দাঁড়াবার বীজ। এই বীজ তাকে প্রলুব্ধ করে মাথা তুলে দাঁড়াতে, জান বাজি রেখে হলেও কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনতে। যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সে পরিবর্তন হয়ে দাঁড়ায় অনাকাঙ্ক্ষিত। তা মানুষের আকাঙ্ক্ষানুযায়ীই যদি সব ঘটতো তবে তো পৃথিবীটা অগণিত বেহেশতিবাগের টুকরোয় ভরে যেত। যার যেমন আকাঙ্ক্ষা তার তেমন বাগ। তবে সবার বাগেই বোধহয় একটা সাধারণ ব্যাপার থাকতো – সেখানে সেই অধীশ্বর।
নিজেরে একেশ্বর ভাবতে পছন্দ করে পুরুষ, অন্ততঃ তার আপন বাগে, যে বাগ সে সাজায় নিজ মহিমার প্রমাণ দিতে, নিজেরই প্রয়োজনে। সেই আপন বাগও যদি তারে ছেড়ে পালাতে হয় অনির্দিষ্ট কালের তরে তবে তার মতো দূর্ভাগা আর কে আছে জগতে! এমনই এক দূর্ভাগা ছমির শেখের ছোটভাই আমীর শেখ।
ওটা ছিল মহাযুদ্ধ শুরু হওয়ার দুই-চার বছর আগের ঘটনা। সেই যে বছর ভাগ হওয়া দুই বাংলা আবার এক হলো। আমীরের দ্বিতীয় বৌয়ের গা থেকে তখন হলুদের গন্ধ মুছেছে কি মোছেনি। গনুর কাইজের জের ধরে আমীরকে হতে হয়েছিল পলাতক। শুধু আমীর নয়, বালিদিয়া-ভাতুরিয়ার শেখ ও মণ্ডল বংশের সব পুরুষই গা ঢাকা দিয়েছিল দিন কয়েকের জন্য। অন্য সব বংশের কিছু কিছু সমর্থ ও যোগ্য পুরুষেরাও রাতে বাড়িতে হুশিয়ার হয়ে ঘুমাতো দিনকতক। বলা যায় না, কখন এসে পড়ে পুলিশ। আর এসেই ‘সামনে যারে পাও তারেই বাইন্ধে নেও’ নীতিতে অ্যাকশন শুরু করলে …। কথায় কয়, বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, আর পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ। তা পুলিশ অবশ্য দুই দিনের বেশি আসেনি। প্রথম দিন আসছিল কাইজের স্মারক সাতটা লাশের সরকারি বিধিমতে সদগতি করতে। আর দ্বিতীয় দিন তদন্তের নামে এলাকায় ত্রাস সঞ্চার ও ধরপাকড় করতে। কাইজের মাঠে যারা সেদিন একবারে না মরে শরীরের এখানে-ওখানের জখমে পট্টি লাগায়ে টোটকা চিকিৎসা আর কবিরাজির পরে ভরসা করে ঘরে শুয়ে ধুকছিল, তারা এদিন শোলার টুপি-বুট জুতা সমেত হাফপ্যান্টওয়ালাদের খাকি চেহারা দেখেই আধমরা থেকে মরমর দশায় পৌঁছে গেল। তারপর পুলিশ যখন তাদেরকে কোমরে দড়ি বেঁধে হাঁটিয়ে নিয়ে চলল তখন গাঁ বলতে গেলে পুরুষশূন্য। সেই যে সুস্থ-সবল জোয়ান আমীর শেখ এক কাপড়ে বাড়ি ছাড়ল, তারপর তার দেখা মিলল এই সেদিন, বালিদিয়ার হাটে।
হাটে অনেকেই আমীর শেখকে ঘিরে ছিল। সবাই তার কথা শোনার জন্য উদগ্রীব কিন্তু সে কারো সাথেই বেশি কথা বলেনি। লোকেরাও তারে কথা বলানোর জন্য বিশেষ চেষ্টা করার সাহস পায়নি। তা কী করেই বা তারা পাবে? নামেই আমীর শেখ। চেহারায় আছে খানিক মিল। কিন্তু পোশাকে-আশাকে, কথার ধরণে কে বলবে যে এটা সেই আমীর শেখ যার হাতের তেলপাকা বাঁশের লাঠির ঘুর্ণিগতির ঘূর্ণনের সামনে এগোতে পারে এমন বিপক্ষ দল গড়ে তোলাই ছিল শক্ত! লোকেরা চেয়ে চেয়ে আমীর শেখের গাল বসা হনু জাগা মুখে খোঁচা খোঁচা কাঁচায় পাকায় মেশানো দাড়ি আর খাড়া নাকের নীচে ঝুলতে থাকা কালচে পুরুষ্ট ঠোঁটের তলাকার শীর্ণ চিবুক বেয়ে নেমে যাওয়া ছয় আঙ্গুল লম্বা কাটা দাগটা দেখে। লোকেরা দেখে তার মেরুদণ্ড বেঁকে যাওয়া শীর্ণ দেহ কাঠামো, কেশবিরল মাথা – যেখানে একসময় ঝাঁকড়া বাবরি ছিল, উঁচু কপালের নীচে কোটরে বসা চোখে কী এক শুন্যতা নাকি উদাসীনতায় মরা মাছের মত ঘোলাটে দৃষ্টি। লোকেরা বলাবলি করে, আমীর শেখের বর্তমান চেহারার সাথে তার এতদিনকার ফেরারী জীবনযাপনের কল্পনা মিশিয়ে তারা আলোচনা শুরু করে। অচিরেই আমীর শেখ অঞ্চলের প্রধান আলোচ্য হয়ে ওঠে।
পরস্তাব নিয়ে আসে এই আমীর শেখ।
আমীরের প্রথম পক্ষ লবেজান বিবির গর্ভের তিন ব্যাটা, যাদেরকে ফেলে আমীর দেশান্তরী ছিল এই এতকাল, তারা সবাই এখন বিয়ের লায়েক। বড়টার তো বলতে গেলে পয়লা বিয়ের বয়স পেরিয়েছে আরো ক’বছর আগে। তবু যে এতকাল তাদের বিয়ে করা হয়নি তার কারণ শুধু এই নয় যে বাপের অবর্তমানে তাদেরকে বিয়ে করানোর মতন অভিভাবক ছিল না। খুব ছিল। আমীর শেখের বড়ভাই ছমির শেখ তো এ কয় বছর ভাইপোগুলোকে বলতে গেলে আপন ব্যাটার মতই যত্ন-আদর আর শাসনে বড় করেছে। আমীরের দ্বিতীয় পক্ষকেও সে অসম্মান করেনি। কিন্তু ভরা যৈবতী মেয়েমানুষ নিখোঁজ স্বামীর আশায় পথ চেয়ে চেয়ে যৌবন ক্ষয় করে আর কতকাল টিকে থাকে সতীনপোদের সংসারে? তাছাড়া সতীনপোরা লায়েক হয়ে উঠছিল আর নিজের না ছিল কোন নাড়ী ছেঁড়া ধন। কাজেই সে যে একদিন স্বামীর ভিটার দিকে ফিরে ফিরে চেয়ে আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে টিনের তোরঙ্গ কাঁখে গরুর গাড়িতে গিয়ে উঠল, তাতে ছমির শেখের কোনই দায় থাকার কথা নয়। আর ছমির শেখকে এ দোষও কিছুতেই দেয়া চলে না যে ভাইপোদের বিয়ের পণের টাকা যোগানোর ভয়ে সে এতকাল তাদেরকে আইবুড়ো করে রেখেছে।
আসল কথা হলো রক্ত। ডাকাবুকো বংশের লড়াকু বাপের যোগ্য সন্তান তারা। কারণে-অকারণে মাথায় রক্ত চড়া যাদের স্বভাব তারা যখন মহাযুদ্ধের বাজারে তিনবেলা পেটপুরে খেতে না পাওয়ার গোলমালে পড়ে, তখন আর কতকাল নিরীহ ভাব ধরে উঠোনের কোনে বসে বাখারি চাঁচতে পারে! কাজের ভেতর ঐ একটা কাজই যে তাদের করার ছিল তখন। কাজেই তারা যদি এক গভীর রাতে মুখে কালো কাপড় বেঁধে রামদা হাতে নহাটা বাজারের বিখ্যাত মহাজন অধর কুন্ডুর গদিতে হানা দেয় তবে সেটা কোন আচানক কাণ্ড তো নয়। আবার পেশাদারিত্বের অভাবে তাদের কেউ যদি পুরুষানুক্রমিক তেজারতির কারবারে বুদ্ধিপাকানো কুণ্ডুর খাসলোকেদের হাতে ধরা পড়ে, তবে তাও কোন আশ্চর্য ব্যাপার নয়। তবে এটা নিশ্চয় বিস্ময়ের বিষয় যে, হাতেনাতে অস্ত্র সমেত ডাকাত ধরার পরেও কুন্ডু সেই ডাকাবুকো নবীন ‘ডাকু’টাকে পুলিশে না দিয়ে তুলে দিল অন্য এক ‘বাহিনী’র হাতে। সেই থেকে আমীর শেখের তিন ব্যাটাই আছে গহর লাঠিয়ালের দলে।
গহর লাঠিয়াল সারাবছর ভাড়া খাটে বিভিন্ন ধনীলোক আর মহাজনদের পক্ষে-বিপক্ষে। গহরের বাপ-দাদার নামের সাথে উপাধি ছিল লস্কর। গহর ন্যাংটাকালে দাদার বাপের মুখে গল্প শুনতো রাজা সীতারামের। দাদার বাপের দাদা নাকি সীতারাম রাজার হয়ে বহুবার মুঘল সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করেছিল। ভূষণার রাজা সীতারাম যত পুকুর-দীঘি খনন করেছিলেন তার সবেতেই নাকি ছিল গহরের পরদাদার বাপের কারিগরির ছোঁয়া। লোকটা লড়াইয়ের মাঠে মানুষের কল্লা কাটতে যেমন ছিল দড়, ফসলভরা মাঠের মধ্যিখানে পুকুর কাটতে তেমনই ছিল চারু। সাত পুরুষের রক্তের ধারাবাহিকতায় গহরের শরীরে যে রক্ত বহমান তাতে সেই পরদাদার বাপের যোগ্যতা প্রশমিতভাবে হলেও বিদ্যমান। গহর লাঠিয়াল নিজে তা জানে এবং অন্যরেও তা জানায়ে থাকে। তার সাগরেদেরা সবাই তারে পীর-মুর্শিদের মতই ভক্তি করে। আর করবে নাই বা কেন? গহরের দলে থাকা মানে পরিবার-পরিজনের ভরণপোষণের দুশ্চিন্তা আর না থাকা। ধনীলোকদের ভাড়াটে লাঠিয়ালরা যতদিন জীবনে বেঁচে থাকে, কখনো বেকার হয় না। ধন যাদের থাকে তাদের জীবনে ফ্যাসাদ আর মগজে কূটবুদ্ধিও থাকে। কাজেই তাদের লাঠিয়ালদেরকে তারা পুষ্ট ও তুষ্ট করে রেখেই নিজেদের জীবন ও বিত্ত পাহারার কাজে লাগায়।
গহরের দলে থেকে আমীরের ব্যাটাদের মাত্র ক’বছরেই বেশ ভালো বাড়-বাড়ন্ত হয়েছে। অধর কুন্ডুর বিষয়-সম্পত্তি পাহারার দলে থাকে আমীরের যে ব্যাটা, সে রীতিমত মাস চুক্তিতে বেতন পায়। আর যে দুটো গহরের কাছ থেকে তালিম নিয়ে লাঠি চালনায় হাত পাকায়ে জমিদারের খাস লাঠিয়াল বাহিনীতে যোগ দিয়েছে তারাও বছর চুক্তিতে মাইনে পাচ্ছে। এখন আমীর শেখ তার লায়েক পুত্রদেরকে সংসারী দেখতে চায়।

চলবে…

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
জন্ম - মাগুরা জেলার মহম্মদপুর থানার ওমেদপুর গ্রামে নানা বাড়িতে জন্মতারিখ- প্রকৃত: ২৭ জুন ১৯৭৭, সনদীয়: ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ পিতা- মোঃ আব্দুল গফ্ফার মোল্লা মাতা- সালেহা ইয়াসমিন সংসারসঙ্গী- মোঃ দেলোয়ার হোসেন (মাহমুদ) তিন কন্যা- আদৃতা, অঙ্কিতা ও দীপিতা বর্তমান অবস্থান: রাজশাহী। পেশা: সরকারী চাকরি [উপপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত), জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর, বিভাগীয় কার্যালয়, রাজশাহী] প্রকাশিত গ্রন্থঃ ৭টি (৬টি গল্পগ্রন্থ, ১টি উপন্যাস) প্রথম: অপরাজিতা (সময় প্রকাশন) দ্বিতীয়: জীবনের পেয়ালায় ছোট্ট চুমুক (ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ) তৃতীয়: নদীও নারীর মত কথা কয় (বটেশ্বর বর্ণন) চতুর্থ: মহাকালে প্রান্তরে (পরিবার পাবলিকেশন্স) পঞ্চম: লিলুয়া জীবনের নারীগণ (বটেশ্বর বর্ণন) ষষ্ঠ: বিবিক্তা (বটেশ্বর বর্ণন) – উপন্যাস সপ্তম: তামসী (বইঘর)
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!