ভারতের ধর্মীয় দর্শনের দুটি দিক- আস্তিক্যবাদী দর্শন ও নাস্তিক্যবাদী দর্শন। ঈশ্বরে বিশ্বাস করুক আর নাই করুক- বেদ-এ যারা বিশ্বাস করে তারাই আস্তিক আর যারা বেদে বিশ্বাস করে না তারাই নাস্তিক। বৈষ্ণব, শৈব, শাংখ্য ইত্যাদি বেদ নির্ভর ছিল বলেই তারা আস্তিক- যাদের আজ একসাথে হিন্দু বলা হয়। বিপরীতে বেদে বিশ্বাস না থাকায় বৌদ্ধরা ছিল নাস্তিক। এজন্য আজও বৌদ্ধ ধর্মকে নাস্তিক্যবাদী ধর্ম বলা হয়। মুসলিমিরা আসার আগে ভারতে সুদীর্ঘকাল বৌদ্ধদের সাথেই বৈদিকদের (বর্তমানের হিন্দু) দ্বন্দ্ব-সংঘাত ছিল। আজিবিক ধর্মের সম্রাট বিন্দুসারের পুত্র সম্রাট অশোকের কলিঙ্গ যুদ্ধে এক থেকে তিন লক্ষ লোক নিহত হয়। নিহতরা ছিলেন বৌদ্ধ ও হিন্দু। অশোক ছিলেন প্রচণ্ড বৌদ্ধবিরোধী। অবশ্য এই হত্যাকাণ্ড তাঁর ভিতরে গভীর কষ্টবোধ তৈরি করে এবং তিনি বৌদ্ধ ধর্মই গ্রহণ করেন। তাতে বৌদ্ধ-হিন্দুদের দ্বন্দ্ব/সংঘাত শেষ হয়ে যায়নি। পালরাজারা যখন ক্ষমতায় তখন পর্যন্ত বৌদ্ধদের উত্থান ছিল, নিপীড়নের শিকার হতো হিন্দুরা। যখন সেন রাজবংশ ক্ষমতায় এলো তখন আবার বৌদ্ধদের নৃশংসভাবে হত্যা/নিপীড়ন করা হয়। বেঁচে যাওয়া বৌদ্ধরা দলে দলে আবার হিন্দু হতে বাধ্য হয় নইলে এলাকা ছাড়ে। মুসলিমরা আসার আগ পর্যন্ত এটা চলতে ছিল। বৌদ্ধ ও হিন্দুদের মধ্যে রয়েছে সুদীর্ঘকালের সংঘাতের ইতিহাস।
খৃস্টানদের সাথে হিন্দুদের কোন সম্পর্কই ছিল না ইংরেজদের ভারত দখলের আগে। যদি মুসলিমরা ভারত দখলে ব্যর্থ হতো এবং ইংরেজরা আরো আগে ভারতে আসতে পারতো তাহলে আজ ভারতে থাকতো হিন্দু আর খৃস্টান। তাদের মধ্যেই চলতো সংঘাত। যে হিন্দুরা মুসলিম হয়েছিল তারা হতো খৃস্টান। সেটা হয়নি মুসলিমরা আগে ভারত দখল করতে পারায়। খৃস্টান ধর্ম হল সেমিটিক ধর্ম যা পৌত্তলিক ধর্মের ঠিক বিপরীত। খৃস্টান ধর্মের প্রবর্তনকারী নবীকে মুসলিমরাও নবী হিসেবে মানেন। তাদের মধ্যে অনেক বিষয়ে মিলও রয়েছে। ইউরোপ থেকে নির্মম নিপীড়ন করেই পৌত্তলিক প্যাগানদের নিশ্চিহ্ন করেছিল খৃস্টানরা। ইংরেজরা চলে যাওয়ার আগে যত সংঘাত হয়েছে তা হিন্দুদের সাথেই বেশি। অর্থাৎ শেষ দিকে বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে হিন্দুদের অংশগ্রহণই ছিল বেশি। এছাড়া ভারতে খৃস্টান নিপীড়নের অসংখ্য ঘটনা আমরা সাম্প্রতিক সময়ে দেখছি। অর্থাৎ ভারতেও হিন্দুদের সাথে বৌদ্ধ-খ্রিস্টানদের ঐক্য সম্ভব নয়৷ সেই খৃস্টান ও বৌদ্ধদের সাথে হিন্দুরা ঐক্য পরিষদ গঠন করে চলছে ভাবতেই বিস্মিত হতে হয়। তবে বাস্তবিক এর প্রেক্ষাপট ও কারণ রয়েছে।
উপজাতি/আদিবাসীসহ বাংলাদেশের সকল সংখ্যালঘুরাই বিভিন্নভাবে নিপীড়নের শিকার হন। মানসিক নিপীড়নটা হয় আরো বেশি। বাংলাদেশে তাদের একটি দিকেই মিল রয়েছে আর তাহল- তারা সকলেই সংখ্যালঘু এবং সংখ্যালঘু হিসেবে তারা সকলেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের হাতে নিপীড়িত/নির্যাতিত হন। ফলে ধর্ম হিসেবে তারা ঐক্যবদ্ধ হতে পারেন না, পারেন সংখ্যালঘু হিসেবে। নামটিও জুৎসই হতো যদি হতো ‘বাংলাদেশ সংখ্যালঘু ঐক্য পরিষদ’! সংগঠনটি তৈরি হয় অবশ্য ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার রক্ষা করতেই। সেখানে তারা যথেষ্ট কাজও করছেন। ১৯৮৮ সালের ৯ জুন জাতীয় সংসদে ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম ঘোষণা করা হয়। একই দিন মেজর জেনারেল (অব.) চিত্তরঞ্জন দত্তের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা করা হয় ঐক্য পরিষদ এবং ৯ জুনকে তারা কালো দিবস হিসেবে পালন করে। বাংলাদেশি হিন্দু, বৌদ্ধ ও খৃস্টানরা পৃথিবীর বিভিন্ন বড় শহরেই এই সংগঠনটির শাখা খুলেছে। বাংলাদেশেরও সকল উপজেলাতেই এর শাখা রয়েছে।সংগঠনটির হিন্দু নেতৃবৃন্দ সংগঠনটিকে অসাম্প্রদায়িক রূপ না দিয়ে সম্পূর্ণ সাম্প্রদায়িক রূপ দিয়েছেন। সংগঠনটিতে তিনটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নাম রয়েছে কিন্তু কার্যক্রম হিন্দু ধর্ম কেন্দ্রিক। অনেক সময়ই এটিকে একটি হিন্দু মৌলবাদী সংগঠনের মতো মনে হয়। তারা অনুষ্ঠানাদিতেও হিন্দুরীতিতেই হিন্দুধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানাদী পালন করে। আবার দেশজুড়ে যারা হিন্দু ধর্মের পূজা উৎযাপন কমিটির সাথে জড়িত তারাই জড়িত থাকেন হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃস্টান ঐক্য পরিষদে। এটা যে একটি সংখ্যালঘুদের রক্ষার সংগঠন তা ভ্রম হয়। যদিও তাদের কার্যক্রম সংখ্যালঘুদেরই স্বার্থে পরিচালিত হয়।
বাংলাদেশে সবেচেয়ে নিপীড়িত শ্রেণিটা হল প্রগতিশীল মানুষেরা। গত এক দশকে দেশে ধর্মীয় বিদ্বেষে যত খুন হয়েছে তার অধিকাংশই প্রগতিশীল মানুষ। অভিজিৎ রায় ও অনন্ত বিজয় খুন হয়েছেন হিন্দু বলে নয়, প্রগতিশীল বলেই। প্রগতিশীল মানুষদের পক্ষে ঐক্য পরিষদের পাশে দাঁড়ানোও কঠিন হয়ে পড়ে তাদের ধর্মান্ধ আচরণের কারণে। যখন কয়েকটি ধর্মের মানুষের একটি সংগঠন তৈরি হবে তখন সেটাকে হয় তাদের মধ্যেকার বৃহৎ ধর্মটি গ্রাস করবে, নয় সংগঠনটির নেতৃত্ব থাকবে প্রগতিশীল মানুষের কাছে। আমরা সংগঠনটিকে প্রগতিশীল সংখ্যালঘু নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে দেখলাম না। নামটির বাইরে এর বহুধর্মের মিলন হিসেবে কার্যকর মনে হয় না। সংখ্যালঘুদের এমন একটি সংগঠনের পাশে সবসময়ই প্রগতিশীল ও অগ্রসর চিন্তার মুসলিমদের জড়িত থাকার কথা। আমাকেও যখন কেউ বলে তখন মাথায় আসে ‘মৌলবাদী’ সংগঠন হিসেবেই। কিন্তু যখন বিভিন্ন সংখ্যালঘু ধর্ম মিলে একটি সংগঠন হয় তখন তা মৌলবাদী কিভাবে হয়? সেই ভাবনাটাও হয়।
কলমে- মুজিব রহমান
স্যোসাল মিডিয়া থেকে সংগৃহীত।