কৃষ্ণকিশোর বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম আমরা জানি না। সে কে কবে কোথায় জন্মেছে বা মারা গেছে তাও জানি না কেউ। কিন্তু তার একটি কবিতার নাম দুই বাংলার মানুষই জানে- ‘অর্থই অনর্থের মূল’। ১৮৬৮ সালে রচিত কবিতাটিতে অর্থের বিরুদ্ধে যাবতীয় নিন্দাই করা হয়েছে। তিনি অর্থার্জনের বিরোধীতা করে ধর্মের জয়গান গেয়েছেন। তিনি বলেছেন, অর্থের চেয়ে খারাপ কিছু পৃথিবীতে নেই, তাই অর্থের পেছনে অমূল্যকাল কাটিও না। বাঙালি, কবির নাম ভুলে গেছে কিন্তু কবির কবিতার নাম অমর করে রেখেছে। ফলে লুটেরা তস্করা যখন দেশের টাকা ফাঁকা করে পাচার করে দেয় তখনও ভাবে, ‘এবার অনর্থটাও বুঝবে বাপু!’ এদেশে তাই কখনই কোন দুর্নীতিবাজের সামাজিক শাস্তি হয়নি, হয় না।
আমাদের ধর্মগ্রন্থগুলোও কৃষ্ণকিশোরের ভাবাদর্শ বহন করে আসছে আরও হাজার হাজার বছর আগে থেকেই। ধর্মে বলে- যার যত কম সম্পদ, পরকালে তাকে তত কম হিসাব দিতে হবে। এসব শুনে মানুষ খুশি হয়ে দরিদ্র থাকে। অর্জিত টাকা পয়সা কাঁদতে কাঁদতে পীর/বাবার হাতে তুলে দেয়। আর বাবা সেই টাকায় আয়েশ করে, ভোগবিলাসে জীবন কাটায়। সাধারণ মানুষ আর লুটেরাদের দিকে চোখ তুলে তাকায় না। মনে মনে ভাবে, আহারে! পরকালে যমরাজ/আজরাইল তোমাকে এমন … দিবে!
কয়েকদিন জ্বর ও বুক ব্যর্থায় শয্যাশায়ী থেকে বুঝেছিলাম, মানুষ কেন বৃদ্ধকালে আত্মজীবনী লিখতে বাধ্য হয়। এর একটা কারণ বিছানায় শুয়ে থাকলে হাজারো স্মৃতি ধেয়ে আসে। ভেসে আসা অসংখ্য স্মৃতির মাঝে দুটি উল্লেখ করছি-
০১। মায়ের বয়সী এক ভদ্র মহিলা গাড়ি থামিয়ে, আমার কাছে এসে বললো, বাবা আমাকে চিনতে পারছেন? মাথা নেড়ে বললাম, স্মরণে আসছেন না! ওনি বললেন, ‘আমরা এক সময় দরিদ্র ছিলাম। এখন আমার গাড়ি-বাড়ি হয়েছে। আমার স্বামীর চিকিৎসা করানোর মতো একটি টাকাও ছিল না আমার কাছে। আপনার কাছে আসলে ৫০০/- টাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। আমার স্বামী বাঁচেনি কিন্তু মনকে বুঝাতে পারি অন্তত চিকিৎসাটা করাতে পেরেছিলাম। আমার মনে পড়লো। ১৯৮৪-৮৬ সালের কথা। এমন মানুষদের সহায়তা করার জন্য আমরা গণকালেকশন করতাম। মূলত আমাদের ক্লাব থেকেই করেছিলাম। সেই সময়ের সেই শীর্ণ-জীর্ণ ও হতাশাক্রান্ত নারীর সাথে আজকের চাকচিক্যময় নারীর তুলনা করতে পারি না। ওনি যাবতীয় সম্পদ বিক্রি করে প্রথমে এক পুত্রকে বিদেশে পাঠান। এরপর আরো দুই পুত্রকেও। তারা বিদেশে সফল হয়ে দেশে এসে ব্যবসা করেও সফল হন।
০২। ২০১৩ সালের কথা। চেহারা চিনি এমন এক নারী এসে খুব কাতরভাবে বলল, তার ছেলে এক্সসিডেন্ট করে মৃত্যুর মুখে। পা খণ্ডখণ্ড হয়ে গেছে। রিক্সায় করে নিয়ে এসেছেন। কোন টাকা যোগাড় করতে পারেননি। আমার ভরসায় এসেছেন। আমি যদি ৫ হাজার টাকা দেই তবেই ছেলেকে বাঁচাতে পারেন। আগামী মাসেই টাকা দিয়ে দিবেন। আমি টাকাটা দিলাম। বুদ্ধি করে ওনার হিসাব নাম্বারটিও রেখে দিলাম। পরে খোঁজ করে দেখলাম, আরো কয়েক মাস আগে থেকেই ওই হিসাবে টাকা আসা বন্ধ। পরে আমি একদমই ভুলে গিয়েছিলাম। বছর চারেক পরে, এক মহিলা এসে, ৫ হাজার টাকা দিয়ে বললেন, বাবা খুব উপকার হয়েছিল। কিন্তু সামর্থ্য না থাকার কারণে আর ফেরত দিতে পারছিলাম না। এখন অবস্থা পাল্টেছে। ভাবছিলাম, আপনাকে পাবো কিনা!
আমাদের দেশে এমন ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প খুব বেশি নেই। এই দুই নারী তার প্রতিবেশি ও আত্মীয় স্বজনের কাছেও টাকা না পেয়েই আমাদের কাছে এসেছিলেন। অর্থহীনতা জীবনকে কতোভাবে লাঞ্ছিত করে তা বুঝতে পেরে, সংগ্রাম করেছেন এবং ঘুড়ে দাঁড়িয়েছেন। অথচ এখনও আমাদের পাঠ্যবইতে পড়ানো হয়, ‘অর্থই অনর্থের মূল’। এর একটাই কারণ, শাসকরা আমাদের বিভ্রান্ত করতে চায়। তারা বুঝাতে চায়, অর্থ ও ক্ষমতার দিকে তাকিও না, তাহলে নরকে যাবে। কদিনের পৃথিবী? একটু কষ্ট কর, সবুর কর মরার পরেই অনন্তকাল স্বর্গসুখ পাবে। ধর্মঘর বানিয়ে দিচ্ছি, এসি লাগিয়ে দিচ্ছি, বিদ্যুৎ ফ্রি করে দিচ্ছি, নগদ প্রণোদনা দিচ্ছি- আর কি লাগবে? সেই স্বর্গসুখের আসায় আমরা অর্থ পাচারকারীদের দিকে তাকাই না, শাসকদের অনাচারের দিকে তাকাই না। তারা সব সুখ একত্র করে জীবন যাপন করেন বর্তমান পৃথিবীতেই আর আমাদের দেখান পরকালের সুখের পথ।
কৃষ্ণকিশোর বন্দ্যোপাধ্যায় বেঁচে আছেন-থাকবেন শাসক ও তাদের উচ্ছিষ্টভোগীদের ষড়যন্ত্রের উপকরণ হিসেবেই।
লেখক: মুজিব রহমান