হাওয়াই মিঠাই, হাওয়াই মিঠাই আছে।
ঠং ঠং ঠং ঠং করে ছোট ঘন্টা বাজার শব্দ আসছে। কাঁচের বড় বাক্সে হাওয়াই মিঠাই। ফেরিওয়ালা পাইকপাড়ার ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।
সনাতন খালি গায়ে তালপাতার চেটাই পেতে বসে আছে। গরম সহ্য করা যাচ্ছে না। জৈষ্ঠ্য মাসের বেলা। সাড়ে বারোটার মতো বাজে। লক্ষ্মী এখনও সনাতনকে ভাত দেয়নি। ঘাটে থালা মাজতে গিয়ে একটা কাঁকড়া ধরে এনেছে, লক্ষ্মী। লাউটা একটু বুড়ো হয়ে গেলেও ওই কাঁকড়া দিয়ে আজ রান্না হয়েছে। ঘরে তেমন কিছু ছিল না। আর একটু সজনে পাতা ভাজা। আর কিছুই হয়নি। গাছে কাঁচা লঙ্কা আছে। মুখে ভাল না লাগলে লঙ্কা ঘষে নিলে ভাতটা খাওয়া যায়। বাড়িতে আলু ঢোকেনি সাতদিন হয়ে গেল। লক্ষ্মী মুখ বুজে ঠিক চালিয়ে দেয়। ওর জায়েরাও জানতে পারে না।
ফেরিওয়ালার ডাক শুনে যুগলকিশোরের বড় ছেলের নাম ধরে ডাকে, সনাতন।
– ‘এই জ্যোতে। বলি শুনতে পাচ্ছি? জ্যোতেচ? কোতায় গেলি রে?
জ্যোতিষ পাইক, যুগলকিশোরের বড় ছেলে সাড়া দেয়, ঠাকুর দা বলো।’
– ‘তোর কাছে আটআনা পয়সা হবে? চার আনা পয়সা হবে?’
– ‘নিগো দাদু।’
– ‘দ্যাক তো মোহনের বিচনার তোলায় পয়সা আচে কিনা।’
– ‘দাঁড়াও দেকতিচি।’
একটু দেখে নিয়ে ঘরের ভেতর থেকে সে জবাব দেয়,
– ‘নিগো দাদু। কিচ্চু নি।’
শশধর ঘরের মেঝেতে শুয়েছিল। একটু আগে সে ফিরেছে। কাজ থেকে।
সে বাবার সব কথা শুনতে পাচ্ছে। তার ঘরটা পুরানো ঘরের উঠোন থেকে নেমে রাস্তার দিকে। উত্তরে। কোমরের গেঁজে থেকে সে একটা টাকা নিয়ে হাঁক দেয়, ‘জ্যোতিষ এই নে যা। ঠাকুর দা-কে দে।’
দৌড়ে গিয়ে এক টাকার কয়েনটা শশধরের হাত থেকে নিয়ে ঠাকুর দাকে হাত বাড়িয়ে দিতে এলে সনাতন বলল, ‘শশধর একটাকা দিল?
তুই একটু যা তো দুটো হাওয়াই মিঠাই নে আয়। তোর একটা আমার একটা।যা দৌড়ে যা!’
– ‘ওই তো ঘোন্টা বাজতেচে। যাচ্চি।’
জ্যোতে দাওয়া থেকে লাফিয়ে নামে। দৌড়ে দুটো হাওয়াই মিঠাই নিয়ে এসে ঠাকুর দা-র হাতে একটা ধরিয়ে দেয়। নিজেও একটা খায়। খুচরো পঁচাত্তর পয়সা সনাতনের বিছানায় থাকে। একটা পঞ্চাশ পয়সা, আর গন্ডার মার্কা একটা পঁচিশ পয়সা। মূহুর্তের মধ্যে দুজনের গালের ভেতর হাওয়ায় মিঠাই অদৃশ্য হয়ে যায়। জ্যোতে জিভ দেখায়। লাল হয়েছে কিনা। সনাতনের জিভটা সে দেখতে চায়। দেখে লাল টকটকে। জিভে হাওয়ায় মিঠাই দিয়ে সনাতন খুব তৃপ্ত হয়। ছোটবেলায় তার বাবাও কিনে দিত, লবন চুষ, কাঠিলজেন্স। আরও কতকিছু সনাতনের মনে নেই। তবে লবন চুষ খুব মনে পড়ে।
জ্যোতের ছোটভাই কাগজ কেটে হাওয়ায় চড়কি করে হাতে নিয়ে দৌড়ে অনেকদূর পর্যন্ত গিয়েছিল। সবেদা বাগানের ছায়ায় দক্ষিণের হাওয়ার সামনে দাঁড়িয়েছিল। বনবন করে ঘুরছিল। সনাতনের মুখে হাওয়ায় মিঠাই একটু লেগে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল, ‘কি খাচ্ছ ? ঠাকুর দা। হাওয়াই মিঠাই। সব খে নেচো। কে কিনে দিল?
সনাতন চার আনা পয়সা তার হাতে ধরিয়ে দেয়, সে দৌড়ে যায়। হতাশ হয়ে ফিরে আসে। ঠাকুর দার হাতে পয়সা ফেরত দেয়।
মোহন বলে, “এদিক দে ফিরতে পারে। বাকুলের সামনে এলে খাবিকোনে।”
জ্যোতের ভাই মোতে। মোতে বলে, হ্যাঁ ঠাকুর দা। মোতের ভাল নাম মতিন। ভাল নামে কেউ ডাকে না। মোতে নামেই ডাকে। দুই ভাই পিঠোপিঠি। ছেলেমানুষ। কিন্তু কাজ বাজ বড়দের মতো শিখে গেছে। বড়টা তো নারকেল পাড়তে পারে, তালগাছ কাটতে পারে। সবাই বলে গেচুরে হবে। ছোটটার ওসব দিকে ন্যাক নেই। মাছ ধরতে ভালবাসে। অনেকে বলে, ‘কাওরার ঘরে না জন্মে বাগদির ঘরে যেতে পারতিস। এক হাঁটু জলে গুলিয়ে ঠিক মাছ ধরে আনে, মোতে। দুটো দাঁতের কামড়ে জ্যান্ত কই মাছ ধরে রাখে। নড়বার উপায় নেই।
লক্ষ্মী এসে ভাত বেড়ে দেয়। সবাইকে। এক থাবা লাউ, সজনে শাক ভাজা আর রেশনের চালের ভাত। যুগলকিশোর ছেলে দুটোকে পাশে বসিয়ে তালপাতার চেটাইয়ে বসে খাচ্ছে। সনাতন বসেছে, উঁচু পিঁড়িতে।খেতে খেতে সে কথা বলে না। লক্ষ্মী ভাতের হাঁড়ির কাছে হাঁটু মুড়ে বসে আছে।
মোতে খেতে খেতে সনাতনকে বলল, ‘মিইদানা এলে কিনে দেবে তো ঠাকুর দা।’
সনাতন বলল, ‘দোবো। এলেই দোবো। আসুক না।’
যুগলকিশোর বলে, ‘ঠাকুর দা পয়সা কোতায় পাবে? মিইদানা খে কি হবে?
উত্তর পাওয়ার আগেই পিঁড়ি থেকে ভাতের থালার দিকে সনাতন ঝুঁকে পড়ে। কোনও কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে উল্টে পড়ে যায়। লক্ষ্মী ভয় পেয়ে সবাইকে ডাকে। হাউমাউ করে ওঠে। সবাই কাজ ফেলে দৌড়ে আসে। যুগলকিশোর সকরি হাতে বাবাকে ধরে তোলে। ছেলে দুটোও তোলে মুখের ভাত মুখে থাকে, সনাতন ঢলে পড়ে। শশধর স্নান করে ঘরের দাওয়ায় ওঠার আগে বাবার এই অবস্থা দেখে দৌড়ে আসে। মাঠ ভেঙে ডাক্তার ডাকতে ছোটে। বৃন্দাবন, শম্ভুনাথ পাশের পাড়ায় কাজে গেছে, হালদারদের পুকুর কাটা হচ্ছে। চৌপুরে করে ফিরবে। মোতে দৌড়ে কাকাদের ডাকতে গেল। ছটা বউ, সবাই দাওয়ায় উঠে সনাতনকে দেখছে। মেজোবউ অষ্টমীর চোখে একটু জল। সেজোবউ যেন রগড় দেখছে। সবার চোখ শুকনো। সনাতনের প্রতি এদের কত মায়া-দয়া বোঝা যাচ্ছে। আড়া লেগে একটা মানুষ আছে আর কি! তারজন্যে কারও বিশেষ মাথা ব্যথা নেই। বেঁচে থাকলে আনন্দ নেই, শোকও নেই। মরে গেলে মরে গেছে, তাদের কাছে একটা ঘটনা মাত্র। তাদের চোখ থেকে এক ফোঁটা চোখের জল সে আদায় করতে পারবে। মনে হল না।
লক্ষ্মী কেঁদে আকুল হয়ে যাচ্ছে। এই একটা মানুষ যার কাছে সনাতন শ্বশুর নয়, সত্যি সত্যি বাবা। বাপের বাড়ি সে যে কবে গেছে তার মনে পড়ে না। সনাতনের সংসার, তার ইহকাল, তার পরকাল। নিজের মতো করে কখনও সে ভাবেনি। লক্ষ্মী নিজের সংসারের ছবি কখনও মনে মনেও আঁকেনি। সবাইকে নিয়ে সে দিব্যি ছিল। কষ্ট ছিল। থাকলেও শোক ছিল না। কিন্তু সনাতনের এই অবস্থা দেখে সে যেন একেবারে ভেঙে গেল।
যুগলকিশোর বাবাকে ধরে বসিয়ে রেখেছে, মাথায় জল দিচ্ছে। সনাতনের গা – মাথা ধোয়ানো জল দাওয়ার ধারি ধরে ছেঁচে গিয়ে নামছে।সনাতনের ঘাড়টা যেন মটকে আছে। বীরেন রায়দীঘিতে গানে গেছে। সে এখন খবর পাবে না। মোহনের ওপরে দুটো দাদা ভূষণ আর নীলু আগের রাতে মালিপুকুরে জাল টানতে গেছে। আজ পুকুর ছেঁচা হচ্ছে। ওরা মাছ ধরে দেবে। ওখানেই আছে। ফিরতে ফিরতে আগামীকাল সকাল হয়ে যাবে। তেমন হলে ওদের খবর দিয়ে ডেকে আনতে হবে। মোহন তো একটু বাদেই এসে যাবে। বাবার আগের প্রেসক্রিপশন নিয়ে সে চশমা দোকানে দিন পনেরো আগে চশমা করতে দিয়েছিল। এটা ওটা কাজ সেরে চশমাটাও সে নিয়ে আসবে। ঠিক করেছে। ধনঞ্জয়ের বউ, পারমিতা, দুলালিও শোরগোল দেখে দৌড়ে আসে। আধ খাওয়া ভাতের থালা চারটে থালা পারমিতা একধারে গুছিয়ে রাখে। হাঁড়ির খোলা মুখটা সে ঢাকা দেয়। চেটাই, পিঁড়ি দেওয়ালের গায়ে সরিয়ে রাখে। মাটির দাওয়ায় একটু ন্যাতা দিয়ে জায়গাটা পরিস্কার করে দেয়। লক্ষ্মীকে থামাতে থাকে, ধনঞ্জয়ের বউ।দুলালির চোখেও জল। যখন ডাক্তার এলো সব শেষ। দাওয়ায় ঝ্যাঁতলা পেতে সবাই মিলে তাকে শুইয়ে দেয়। সনাতনের আর সাড়া নেই। জৈষ্ঠ্য মাসের ভরদুপুরে সনাতন সাত ছেলে, ছয় বউ, আটটা নাতি নাতনি, আর অভাবের সংসার রেখে পাইকপল্লী থেকে বেরিয়ে অজানা কোনও পল্লীর সন্ধানে পাখির মতো যেন উড়ে গেল। পরনে ময়লা ধরা সেই লুঙ্গি, সনাতনের মতো বর্ণহীন, অনাদর ক্লিষ্ট। সনাতনের মুখের ওপর ডাঁশ মাছি এসে বসছে, মুখের ভেতরে এখনও কটা ভাত থেকে গেছে।
দূরে গ্রামের শ্মশানের দিকে একটা কাক ডাকছে, খুব ব্যাকুল ভাবে। দুলালির কুকুরটা ওর পিছন পিছন এসেছে, সে আজ বেশ শান্ত। মুখটা কাচুমাচু করে, পেঁপে গাছের গোড়ায় যে উঁচু মতো জায়গা আছে, সেখানে শুয়ে থাকল। লেজটা সে নাড়াচ্ছে না। পারমিতার চোখ দিয়ে গলা মোমের মতো জল নামছে। মোহন যখন এলো, দেখল, পাড়ার লোক তাদের দাওয়ায় উঠে উঠে নেমে আসছে। চারদিকে রোদ খোলা উঠোন ফাঁকা পড়ে আছে। যে যার মতো ছায়া খুঁজে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
যুগলকিশোর মোহনকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। এতক্ষণে তার কাঁদার বেগটা যেন গতি পেল। মোহনের হাতে চশমার খাম, সে খামটা খুলে বাবার চোখে পড়িয়ে দিল। দেখলে মনে হবে, যুগলকিশোর ঝ্যাতলাতে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। টপটপ করে জল নামছে, মোহনের দুটো চোখ বেয়ে। গৌতম ঝন্টুর বাড়ির থেকে সাইকেল চেয়ে নিয়ে মালিপুকুরে ভূষণ আর নীলুকে ডাকতে যায়। শশধর বাবার মাথার কাছে বসে পরম যত্নে মাছি তাড়াচ্ছে। বৃন্দাবন, শম্ভুনাথ মাথার আলটা খুলে হাললাক হয়ে বসে আছে। তাদের হাঁটু পর্যন্ত কাদা। গায়ে কাদা। হাতেনাতে কাদা লেগে আছে। মাধব হরিনামের দলের খবর দিতে যায়। একে একে সবাই চলে আসে। কিন্তু বীরেনের পথ চেয়ে বসে থাকে, পাইকপল্লী। মাঝরাতের দিকে তার বাড়ি ফেরার কথা। রায়দিঘি তো বেশ দূরে। খবর দেওয়ার উপায় নেই। শশধর, বৃন্দাবন, শম্ভুনাথ বাঁশের ঝাড় থেকে কাঁচা বাঁশ কেটে খাটিয়া বানায়। দড়ি, পেরেক মাধবের বউ দুলালি এনে দেয়।
যুগলকিশোর বলে, ‘মাধব দা, তুমি একটু হিসেব রেকো। কাজটা তোমার মতামতে কোরতে হবে। আমার মাতা আর কাচ করে নে।’
সূর্য অস্ত যাওয়ার মুখে। বাড়িতে তেমন কান্না নেই। লক্ষ্মী অবিরাম কেঁদে যাচ্ছে। হরিনামের দল উঠোনে এসে কীর্তন শুরু করেছে। মোহনের বুকটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে।
সনাতন মোরগ ডাকার আগেই তো উঠে পড়ত। শতনাম গাইত। ভোর থেকে। কত দেবদেতার গান তার মুখস্থ। পাইকপল্লীর ভোরবেলা চোখ খুলতো, তার গানের সুরে। তার গান ছিল, পাইকপল্লীতে সূর্য ওঠার হাতেখড়ি। গায়ক সে নয়, কিন্তু তার গানের সুরে একটা সাদামাটা টান ছিল। সোনার গহনা না হলেও ইমিটেশনের গহনা তো সোনার মতো লাগে, অনেকের তাতেই জীবন কাটাতে হয়। পাইকপাড়ায় তেমন কোনও গানবাজনার সরঞ্জাম ছিল না। দুটো একটা রেডিও ছাড়া। কিন্তু সনাতনের শতনাম ছিল, তাদের প্রতিদিনের সঙ্গী। কাল থেকে আর সনাতনের গান কানে আসবে না। পাইকপল্লী এই শূন্যতাটুকু আবিষ্কার করতে খুব একটা আর বাধা পাবে না। গতবারের ঝড়ে ধনঞ্জয়ের পাঁচ পুরুষের খিরিশ গাছটা যখন মুখ থুবড়ে পড়ল, তখন সবাই দেখল, এতবড়ো ছায়া ঘেরা জায়গা কেমন ফাঁকা হয়ে গেল। গাছটা তো ধনঞ্জয়ের ছিল। ছায়াটা ছিল, সবার। সনাতনের বিষয়টা খানিকটা সেরকম। সন্ধ্যার পর পাইপল্লী আজ বড় স্তব্ধ। শাঁখ-ঘন্টা যখন বাজল, তখন শুধু গমগম করে শব্দ হল। তারপরে শ্রান্ত, ক্লান্ত অবসন্ন মাটির পৃথিবীর মতো এই পল্লী বিধ্বস্ত হয়ে থাকল, সনাতনের শোকে নয়। মৃত্যুর রহস্যময় ছায়া ও আশঙ্কা সনাতনের মৃত্যুতে ঘিরে ধরেছে, এই পল্লীকে। জীবন ক্ষণস্থায়ী এই নোটিশটি এই পল্লীর বাতাসে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে, ভয় দেখাচ্ছে।
চলবে…