“হে পরমেশ্বর তুমি আমাকে লেখাপড়া শিখাও”, বোবা কান্নায় ঈশ্বরের কাছে বারবার আকুলভাবে প্রার্থনা করতেন রাসসুন্দরী। পরমেশ্বর বোধহয় তার সেই প্রার্থনা শুনেছিলেন। একদিন ভোর রাতে স্বপ্ন দেখলেন চৈতন্য ভাগবত এর পুথি পড়তে বসেছেন। সেই স্বপ্ন তার মনের মধ্যে এক সুদীর্ঘ মধুময় আবেশ ছড়িয়ে দিল। সংসারে যে কাজই করেন না কেন সর্বদা একই চিন্তা তাকে পুথি খানি পড়তে হবে।
১৮০৯ সাল। সারা বাংলাদেশ জুড়ে সতীদাহ প্রথা, কৌলিন্য প্রথা, পণপ্রথা, বহুবিবাহ সমাজের বুকে গভীর ক্ষত তৈরি করে চলেছে। সমাজকে অগ্রাহ্য করার দুঃসাহস কারুর হতো না। যে সামাজিক বিধান অস্বীকার করতো তাকে শাস্তি স্বরূপ এক ঘরে করে দেওয়া হতো। বিয়ে ,ছেলের পৈতে, বাপ মায়ের শ্রাদ্ধ , সমস্ত সামাজিক অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হতো। সে যে কি অসহনীয় অত্যাচার তা কল্পনারও অতীত। দুর্গতির শেষ থাকতো না বাড়ির কেউ মারা গেলে। মরা বাসি হবার ভয়ে বাড়ির লোকেরাই মৃতদেহ নিজের কাঁধে করে পুড়িয়ে আসত। গ্রামের কেউ এ ব্যাপারে সাহায্য করত না। এক ঘরে হবার ভয়ে অনেকেই বাধ্য হয়ে ধনী সমাজপতিদের সামাজিক বিধান মেনে চলত। সহ্য করত তাদের নির্মম অত্যাচার।
পলাশীর যুদ্ধ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিরাট পরিবর্তন এনেছিল। কিন্তু সামাজিক দিক থেকে সেরকম কোনও পরিবর্তন আনতে পারিনি। নতুন শাসন ব্যবস্থায় সমাজে যে পরিবর্তন ঘটার সম্ভাবনা ছিল তাতো হয়নি, বরং সে সময়কার ইংরেজ কর্তারা ভোগবিলাসে নিজেদেরকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। তারা খুব উচ্চ আদর্শ ছিল না। এই প্রসঙ্গে রাজনারায়নবাবু বলেছেন, “সেকালের সাহেবরা অর্ধেক হিন্দু ছিল।”
তারাও মন্দিরে উপঢৌকন পাঠাতো, বাইজির মজলিসে যেত, খানাপিনার মধ্যে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে। লুঠতরাজ শুধু যে দেশীয় দুষ্কৃতিরাই করতো তা নয় ইংরেজরাও মাঝরাতে গৃহস্থের ঘরে ঢুকে অবাধে লুঠপাট চালাত।
ততদিনে বাংলার মসনদে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন শুরু হয়ে গিয়েছে৷ দাস-দাসীর ক্রয়-বিক্রয়ের বাজার রমরমিয়ে চলছে৷ ইংরেজরা দেশীয় ও আফ্রিকান রমণীদের নিয়ে তাদের কামনা চরিতার্থ করত৷ ইংরেজ রমণীরা যাতে তাদের স্বামীদের সঙ্গে এদেশে আসে সে ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হলো ৷
বাংলাদেশের প্রধান শহর কলকাতা,বর্ধমান, কৃষ্ণনগর, ঢাকা লাম্পট্যের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছে৷ বাইরে কোঁচার পত্তন ভিতরে ছুঁচোর কেত্তন চলছে৷ এই ব্যভিচারের স্রোত গৃহ গৃহস্থকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল৷ গৃহবধূ ও ললনারা আত্মরক্ষা করতে পারেনি অথচ সবকিছু হচ্ছে ধর্মের নামাবলীর আড়ালে।
সমাজের এরকম একটা অস্থির সময়ে বাংলাদেশের পাবনা জেলার পোতাজিয়া গ্রামে ১৮০৯ সালে রাসসুন্দরী দেবী জন্মগ্রহণ করেছিলেন৷ পিতার নাম ছিল পদ্মলোচন রায়৷ যখন তার বারো বছর বয়স তখন তার বিয়ে হয়ে যায় ফরিদপুর জেলার রামদিয়া গ্রামের ভূস্বামী সীতানাথ সরকারের সঙ্গে৷ সেকালে মেয়েদের লেখাপড়া শেখার সুযোগ খুবই কম ছিল, ছিল না বললেই চলে।
রাসসুন্দরী নিজের চেষ্টায় অক্লান্ত পরিশ্রম করে পড়ালেখা শিখেছিলেন৷ তিনি প্রথম বঙ্গনারী যিনি নিজের কথা লিখেছিলেন৷ তার লেখা “আমার জীবন” গ্রন্থটি হল সে সময়কার গ্রাম্য জীবনের এক জীবন্ত দলিল৷
আর পাঁচটা মেয়ের মতন রাসসুন্দরীকে সতীনের ঘর করতে হয়নি৷ তার শ্বাশুড়িও ছিলেন মায়ের মত, রাসসুন্দরীকেও মেয়ের মতনই ভালোবাসতেন৷ যেহেতু শৈশবেই রাসসুন্দরী পিতৃহীন হয়েছিলেন তাই মা তাকে অনেক আদর দিয়ে মানুষ করেছিলেন৷ মাকে ছেড়ে আসতে তার খুব কষ্ট হয়েছিল৷ বিয়ের দিনও তিনি বোঝেননি যে তাকে মাকে ছেড়ে চলে আসতে হবে৷ যখন তাকে পালকিতে তোলা হল তখন তার নিজেকে “বলির পাঠা” বলে মনে হয়েছিল৷ কিন্তু মায়ের আদরের অভাব তার শ্বশুরবাড়ির লোকেদের সুমধুর ব্যবহারে পূর্ণ হয়েছিল৷
তার শ্বাশুড়ি বালিকা বধূটির জন্য নানারকম খেলনা এনে দিতেন। এভাবেই তিনি অবশেষে “তাহাদের পোষা পাখি হইয়া তাহাদেরই শরণাগত হইলাম।”
পল্লী গ্রামের সরলাবালা সংসার সামলাতেই সারাদিন কেটে যে ৷ গা ভর্তি ভারী গয়না, হাতের শাখা ,সিঁথি ভরা সিঁদুর নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন কবে চৈতন্য ভাগবত এর পুঁথিটি পড়বেন৷ সংসারের কাজ করার ফাঁকে আকুলভাবে প্রার্থনা করতেন, “হে দীননাথ আমি কল্য স্বপ্নে যে পুঁথিখানি পড়িয়াছি, তুমি ওই পুঁথি খানি আমায় চিনাইয়া দাও৷ ওই চৈতন্য ভাগবত পুঁথিখানি আমাকে পড়িতে হইবে।”
অবশেষে তার স্বপ্ন পূরণ হল৷ ভগবান তার প্রার্থনা শুনলেন৷ একদিন তিনি যখন রান্নাঘরে হেঁসেল সামলাতে ব্যস্ত৷ তখন শুনলেন তার স্বামী বড় ছেলে বিপিনকে ডেকে বলছেন, “আমার চৈতন্য ভাগবত পুঁথিখানি এখানে থাকিল৷ আমি যখন তোমাকে লইয়া যাইতে বলিব তখন তুমি লইয়া যাইও।”
আনন্দের আতিশয্যে তার দেহ মন রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল৷ আট বছরের বিপিন যখন খেলতে গেল রাসসুন্দরী তখন ঘরে গেলেন৷ আস্তে করে পুঁথিটিকে দুহাতে আঁকড়ে ধরলেন৷ প্রিয়জনের গায়ে হাত বুলানোর মত ,তিনিও পরম যত্নে পুঁথিটির গায়ে হাত বুলাতে লাগলেন৷ পুঁথির সঙ্গে বাঁধা যে কাঠের মলাটটি তার উপর আঁকা রঙিন প্রচ্ছদটিকে তিনি ভালোভাবে চিনে রাখলেন৷ যাতে পরে পুঁথিটি চিনতে ভুল না হয়৷ দুর্বোধ্য আঁকাবাঁকা মসী রেখাগুলোর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকলেন রাসসুন্দরী৷
মনে মনে বললেন এই পুঁথি তাকে পড়তেই হবে। ভোরের স্বপ্ন কখনো যে মিথ্যে হয় না৷ সেই কোন ছেলে বেলার কথা মনে পরল রাসসুন্দরীর৷ সেকালে মেয়েদেরকে লেখাপড়া শেখাবার কথা কেউ ভাবতো না৷ বাপের বাড়িতে চণ্ডীমণ্ডপ এর পাশে ছেলেদের একটা পাঠশালা চলত। যখন পাঠশালা চলত তখন রাসসুন্দরীও সেখানে বসে থাকতেন৷ পাঠশালার ছেলেদের উচ্চস্বরে অ-আ-ক-খ পড়া তার মনকে ছুঁয়ে যেত৷ তিনিও মনের খাতায় অক্ষরগুলিকে লিখতেন৷ এভাবেই প্রাথমিকভাবে অক্ষর পরিচয় থাকলেও তার কোনও চর্চা ছিল না।
বিয়ের পরে যখন তার লেখাপড়া করার সাধ জাগল তখন তার বয়স বছর চৌদ্দ হবে৷ সারাদিন নিয়মমাফিক সাংসারিক কাজ সেরে যেটুকু সময় পেতেন মাথায় এক হাত সমান ঘোমটা টেনে গুরুজনদের সেবা করতে হত ৷ স্বল্পভাষী রাসসুন্দরীর মনটা হারিয়ে যেত সেই শৈশবের পাঠশালায়। বোবা কান্নায় ডুকরে উঠতেন রাসসুন্দরী, “হে পরমেশ্বর তুমি আমাকে লেখাপড়া শিখাও।”
এই ঐকান্তিক প্রার্থনাই শেষ পর্যন্ত পরিণতি পেল তার চৈতন্য ভাগবত পাঠের মধ্য দিয়ে ৷ রান্নাঘরটাই ছিল সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা রাসসুন্দরীর কাছে৷ সেখানেই তিনি উনুনের পাশে বসে পুঁথি থেকে একটার পরে একটা পাতা খুলে ঘোমটার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে পুঁথির পাতা পড়বার চেষ্টা করতেন৷ মাঝে মাঝে ভয় হতো যদি তাকে কেউ এই অবস্থায় দেখে ফেলেন, তবে নিন্দার শেষ থাকবে না৷ বড় ছেলে বিপিনের অ-আ-ক-খ মকশো করার পাততাড়ি লুকিয়ে এনে চুপি চুপি শৈশবের শেখা সামান্য অক্ষর পরিচয় জ্ঞান নিয়ে সেগুলোকে মনে মনে আত্মস্থ করেছিলেন রাসসুন্দরী৷
কোনও কোনও সময় হতাশ হয়ে পড়তেন৷ ভাবতেন এই জীবনে বুঝি আর লেখাপড়া হবে না৷ কিন্তু আবার মনের আশাকে সঙ্গী করে নতুন উদ্দমে চেষ্টা শুরু করতেন, না শেষ পর্যন্ত তাকে আশাহত হতে হয়নি তার চেষ্টা সফল হয়েছিল।
কারুর বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ না জানিয়ে, বিদ্রোহ ঘোষণা না করেও, তিনি লিখেছিলেন এক গ্রাম্য কূলবধুর আত্মকাহিনী৷ যা তার একান্তই নিজের কথা, নিজের জীবনের কথা ৷ অবগুন্ঠনবতী রাসসুন্দরী সলাজ কন্ঠে লিখলেন, ”আমার জীবন” প্রথম মহিলা আত্মজীবনীকার৷#