রাত এগারোটা নাগাদ মোহন বাড়ি ফিরছে, ফতেপুর থেকে। সাহিত্য সম্মেলন থেকে। একটি সাহিত্য পত্রিকার আয়োজনে এই সম্মেলন। বাংলা আকাদেমি সভাঘরে আজ মোহনের কবিতা পাঠ ছিল। রবীন্দ্র সদন চত্বরে চাঁদের হাটে হেঁটে বেড়ানো। কবিতার কাগজ দেখা মোহনের নেশায় ধরেছে। দু-চার মাস ছাড়া আসা-যাওয়া শুরু হয়েছে।
অবিনাশ, সমীর, রাজ দা ওরাও লেখালেখি করে, ফলতা থেকে। সবাই একসঙ্গে গিয়েছিল। বাসে থেকে নেমে সবাই বাড়ির পথে। কোথায় সভাঘর আর কোথায় তাজপুর পাইকপল্লী। পৃথিবীর ধূলোমাখা পথ পেরিয়ে চাঁদে পা দেওয়ার মতো ঘটনা বলে মনে হয়, তার কাছে। তার খুব ইচ্ছে হয়, গোটা পাইকপাড়া ধরে নিয়ে আসার, কবিতার এই রাজধানীতে। গৌতমকে এর আগে একবার নিয়ে এসেছিল। মাধব দা-দুলালি বউদিকেও একবার নিয়ে এসেছিল। ওরা গোটা পাড়াতে গল্প করেছে। সেটা লিটিল ম্যাগাজিনের সময়। তখন শীত ছিল। মাধব তো বইপত্রের পসার দেখে হাঁ হয়ে গিয়েছিল। তার চোখে মুখে সে বিস্ময় মোহন দেখেছিল। অনেকেই দেখেছেন। তারা বুঝতে পেরেছে, লিটিল ম্যাগাজিন মেলাতে নতুন নতুন লোক এলে বিস্মিত হয়ে যায়। তাজপুরের বিস্ময় আরও অন্যরকম। মাধব-দুলালি বেছে বেছে কটা কাগজও কিনেছে। পকেট থেকে সে আশি টাকা খরচ করেছে। ঝোড়া-চুপড়ি বিক্রি করলেও সে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট। জলে-কাদায় তার জীবনটা নির্ঝঞ্ঝাট কেটে আটকে গেছে। অভাব থাকলেও শৌখিন জীবনের প্রতি তারও অনুরাগ আছে। তাদের খড়ের ঘরের তাকে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলামের বই আছে। দিনের পর দিন ধূলো জমে যায়, সেই বইয়ের মলাটে। একবার তো তাকের ওপর রেখে দেওয়া বইয়ের ওপরে লন্ঠন বসিয়ে মাধবের ছোট ছেলেটা একটা বই নষ্ট করেছে। মলাট থেকে বইয়ের পাতা কেরোসিন তেল চুষে নিয়েছে। বইয়ের বারোটা বেজেছে। অনেকগুলো পাতা অস্পষ্ট হয়ে গেছে। এখনও বইটা সেই তাকে আছে। মাধব সময় পেলে একটু আধটু পাতা ওল্টায়, বই পড়ে। অবকাশ তো নেই। বইমেলাতে এসে সে তো ম্যাগাজিন কিনবেই। সে মনে করে, এসব খরচা বাজে খরচা নয়। রবীন্দ্র সদন চত্বরে দুলালিকে সে কফি খাইয়েছে। মোহন খাইয়েছিল, ফিস ফিঙ্গার। নন্দনের সামনে দাঁড়িয়ে তারা ছবি তুলেছে। ওখানে তো ফটোগ্রাফার ঘুরে বেড়ায়। অল্প পয়সায় ছবি তুলে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে প্রিন্ট করে দিয়ে দেয়। সে ছবি মাধবের ব্যাগের ভেতরে বইয়ের পাতার ভাঁজের মধ্যে রাখা হয়ে গেছে। দশ টাকাতে এক কপি। বাঁধানোর ইচ্ছে আছে, তাদের। বইগুলো কাঁধের ব্যাগে ঝুলে থাকলে যে ভার অনুভব হয়, সেই ভারে মাধবের বইপড়ার ইচ্ছে হয়, নতুন করে। কয়েকটা পত্রিকা তো সে এমনিতেই পেয়েছে, তাতেও সে উৎফুল্ল। বউকে নিয়ে শহরের মুখ দেখা তার আগে হয়নি। বাড়ি ফেরার সময় রবীন্দ্র সদন থেকে বেরিয়ে পিজি হসপিটালের উল্টোদিকে বিবেকানন্দ উদ্যান, ওখানে বাস জ্যামে আটকে গেলে উঠে পড়া যায়। অনেকবার ওইভাবে অবিনাশ, মোহন, সমীর একসঙ্গে এসেছে। কিন্তু বসার সিট থাকে না। অতটা রাস্তা ঠেলাঠেলি করে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। জ্যামে আটকে গেলে দুর্ভোগে শেষ থাকে না। অবিনাশ মোহনকে বলেছিল, রবীন্দ্রসদন থেকে মেট্রো ধরে এসপ্ল্যানেড চলে গেলে সিটে বসে ফিরতে পারবি। দুলালি বউদির মেট্রো চড়াটাও হয়ে যাবে। মোহন অবিনাশের দেওয়া আইডিয়াটা নিয়েছিল। মাধব-দুলালি জীবনে প্রথমবার পাতাল রেল চড়ে মোহনের সঙ্গে। চলমান সিঁড়ি দিয়ে সবাই নামছে। দেখে দেখে তারাও বুঝে যায়। চলমান সিঁড়ি থেকে নামার সময় দুলালি শুধু মাধবকে একটু জাপটে ধরেছিল, ভয়ে। কিন্তু খুব মজা পেয়েছিল, যতক্ষণ তারা মাটির তলায় স্টেশনে দাঁড়িয়ে ছিল, চলমান সিঁড়ির দিকে দুলালি অবাক হয়ে তাকিয়েছিল। ভাবছিল, ছেলে দুটো থাকলে কী ভাল হতো। ওদের পাতালরেল চড়া হয়ে যেত। বাসে উঠে মাধব-দুলালি জানালার ধারে বসে। দুলালি একদম জানালার ধারে, পাশে মাধব। একটু দূরে পিছনের দিকে মোহন। বাস ছুটতে শুরু করে। ঠান্ডা হাওয়া এসে দুলালি-মাধবের মুখে লাগে। সকলের মতো ওরাও বাসের জানালা বন্ধ করে দেয়। কাঁচের জানালা দিয়ে দুলালি প্রথমবার রাতের কলকাতা দেখতে দেখতে বাড়ি ফেরে। গায়ের চাদরের ভেতর দিয়ে মাধবের হাতটা সে মুঠো করে ধরে। মাধব কিছু বলে না। শুধু একবার চোখাচোখি হয়। মাধব চোখটা নামিয়ে একটু হেসে দেয়। দুজনে কেমন সুখের পাখি হয়ে যায়। বাড়ি ফেরার রাস্তাটুকু কেউ কারও হাত ছাড়ে না। শুধু গায়ের চাদরটা একটু ঠিক করার জন্যে হাতটা একটু ছাড়তে হয়েছিল, একবার। দুলালি চাদরটা ঠিক মতো টেনে নিয়ে আবার মাধবের হাতটা ধরে থাকে। মোহনের প্রতি মাধব ঋণ অনুভব করে। চমৎকার সেই দিন। কতদিন পরেও সে গল্প ওরা লোকের কাছে বলে বেড়ায়। কলকাতার অনেককিছুই তাদের দেখা হয়ে গেছে, এই বিশ্বাস তাদের মনে বাতাস ছড়ায়। পারমিতা-ঝন্টু এবারে যাবে বলেছিল, সাহিত্য সম্মেলনে। ছুটকো ঝামেলায় যেতে পারল না। বেহালাতে একঘন্টা যানজট না হলে আরও আগে মোহন পৌঁছে যেত। ফতেপুরে নেমে চায়ের আড্ডায় আর একটু কবিতা চর্চা হয়ে যেত। চায়ের রাউন্ড শুরু হলে চলতেই থাকে। কখনও কখনও চার পাঁচ রাউন্ড তো হয়ে যায়। মোহনের অবস্থা সকলেই জানে, ওকে পয়সা দিতে হয় না। তবে মোহনের ইচ্ছে হয়, সকলকে খাওয়ানোর। এবারের পত্রিকা প্রকাশ অনুষ্ঠানে মাইক করার ইচ্ছে আছে। একটু আলুর দম লুচিরও ব্যবস্থা থাকবে। অন্তত পঞ্চাশজন কবিকে নিয়ে খোর্দশাসন-তাজপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হাসিখুশি-র সাহিত্য সম্মেলন হবে। অঙ্গীকার সাহিত্য গোষ্ঠীর ব্যবস্থাপনায়। মোরগজটা ফুল, দেবদারু পাতা, পথের ধারের নাম না জানা ফুল দিয়ে ফুলের স্তবক পারমিতা তো বানিয়ে দেবে, দারুণ হবে। গ্রামের বাচ্চাদের জন্যে এক -দু কৌটো লজেন্স থাকবে। সবাইকে সে বলবে। এমন কত কথা ভাবতে ভাবতে সে বাঁশবাগানের তলা দিয়ে হাঁটছে। প্রাথমিক বিদ্যালয় সে পেরিয়ে এসেছে। হাতে টর্চ নেই। উঁচু নিচু এবড়োখেবড়ো রাস্তা দিয়ে হাঁটার অভ্যাস তার আছে। অসুবিধা কিছু হচ্ছে না। হঠাৎ তার কানে বেশ শোরগোল ভেসে আসে। আওয়াজটা আসছে তার বাড়ির দিক থেকে। বড় ধরণের কোনও গন্ডগোল বলে তার মনে হয়। হাঁটার গতি তার কমে যায়। এইরকম শোরগোল সে আগেও অনেক দেখেছে, তার মনটা আসলে অন্যমাত্রায় ছিল,তাই কেমন তাল কেটে গেল। এবার সে পা চালিয়ে হাঁটছে।
সে বসন্তর গলা পাচ্ছে। আরও অনেকের গলা। অন্ধকারে দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে না। তবে গোটা পাড়া জেগে আছে, বোঝা যাচ্ছে। খানিকটা এগিয়ে এসে কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে না, কে কাঁদছে !
পুরানো ছাতিম গাছের সোজাসুজি বসন্ত থাকে। গ্রামের ভেতর থেকে উঠে এসে ওদের চাষের জমিতে মাটি ফেলে চারটে পিলার দিয়ে ছিটেবেড়ার ঘর করেছে। জমির যেদিকে মাটি কেটেছে, ওদিকে একটা টুমটমে পুকুর হয়ে গেছে। পুকুরপাড় ধরে কটা পেঁপে গাছ, একটা লেবু গাছ। পুকুরপাড়ের নীচের দিকে জলের ওপর বাঁশ পুঁতে ছোট্ট একটা ভারা। কাটা ঝাড়ওলা কঞ্চি চাপিয়ে দেওয়া। বিনা বাধায় কটা সিমগাছ উঠেছে। জড়িয়ে জড়িয়ে তারা উজাড় হয়ে আছে। থোকা থোকা হালকা বেগুনি রঙের ফুল ধরে আছে। জলের দিকে ঝুলে আছে, এক চুপড়ির মতো নতুন সিম। এখনও হাত পড়েনি। তোলার সময় হাঁটু পর্যন্ত জলে নেমে সিম তুলতে হবে। কাপড়টা একটু উঁচু করে নিয়ে কোমড়ে গুঁজে নিলে সিম তুলতে অসুবিধা হবে না। এরকম সিম ভারা পাড়াতে আরও আছে। এই সিম ভারা থেকে হাত দশেক দূরে কলাগাছের ঝাড়।
ছোট-বড় মিলিয়ে ঝাড়টা বেশ ঝকঝকে। হাওয়া এলে পাতাগুলো যেন শান্তির দেবতাকে বাতাস দেয়। পুকুরের পূর্ব দিকে দুটো নারকেল গাছ বসেছে। বড় বড় পাতা ছাড়ছে। পুকুরের পাঁক তুলে গোড়াতে দেওয়া হয়েছে। কাঁচা পাঁক এখনও শুকোয়নি। অনেকেই বলেছে, ওই গাছে তাড়াতাড়ি ফল আসবে। একটা আম গাছও বসিয়েছে। বাড়ি এলে বসন্ত এগুলো নিয়ে থাকে, একমনে তাকিয়ে থাকে, টুমটুমে এই বাগানের দিকে। ওর একটাই মেয়ে। বছর তিনেক। বসন্ত কলকাতায় একটা মিষ্টি দোকানে কাজ করে। জিলিপি ভাজে, গজা তৈরি করে। পেটাই পরোটা বানায়, লুচি ভাজে। বাড়িতে আসে একমাস, দু’মাস ছাড়া। মালিক ছুটি দিতে চায় না। মেয়েটার জন্যে তার মন খারাপ করে। একটু চোখের দেখা না দেখলে জিলিপির পাকে তার ভুল হয়ে যায়। লুচি দুচারটে পুড়িয়ে ফেলে। বাড়ি ফিরলে মেয়ের জন্যে ব্যাগভর্তি খাবার আনে। ওর বউ পম্পা বলে বাজে খরচা। বসন্ত কথা শোনে না। মেয়ে নষ্ট করলেও তার ভাল লাগে।
অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না। বসন্তের বাড়ির সামনে দু-একটা টর্চ জ্বলছে, নিভছে। আসলে অনেক লোকজন বসন্তের বাড়ির সামনে তালগোল পাকাচ্ছে। যাদের হাতে টর্চ আছে, মাঝে মাঝে আঙুল চেপে দিলে হাতের আলোটা জ্বলে উঠছে। মোহন বসন্তের বাড়ির কাছে এসে সকলের পিছনে দাঁড়িয়ে কি হয়েছে বোঝার চেষ্টা করে। সে ভাবছে, কোনো অঘটন ঘটে যায়নি তো! দুপুরবেলা কলকাতায় যাওয়ার সময় বসন্তর বাগানের দিকে সে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল। ছোট হলেও চমৎকার লাগে, এই বাগান, বসন্তর এক ঝ্যাঁতলা সংসার। বসন্ত নেশা করে পালে-পার্বণে। বেশি নেশা করলে মালিক তাকে কাজে নেবে না। মালিক এসবের ঘোর বিরোধী। বাড়িতে থাকলে হয়তো তার নেশা বেড়ে যেত। কলকাতায় অনেকরকম নেশা সে দেখেছে। কিন্তু সেখানে নেশা করার উপায় তার নেই। বসন্তর দাদা, বাবা বেমালুম নেশা করে, মাত্রাছাড়া। মা-বোন জ্ঞান থাকে না। সেজন্যে বসন্ত উঠে এসেছে, এদিকে। মেয়ে হবার পর সে একদম সংসারী হয়ে গেছে। মেয়ে ছাড়া সে কিছু যেন বোঝে না। মেয়ের জন্যে অনেক কষ্ট সে করতে চায়। মেয়েকে মানুষ করতে চায়।
মোহন দেখে বসন্তর দাওয়ায় একটা আলো জ্বলছে। উঠোন ভর্তি লোক। রাস্তার ওপরে লোক। উঠোনের মাঝখানে একটা ভাঙা বাইক জ্বলছে, ধোঁয়া উঠছে। প্রচন্ড ধোঁয়া হট্টগোল চলছে।ঘরের ভেতরটা অন্ধকার। দরজা দেওয়া। পাশাপাশি দুটো ঘরে শিকল তোলা। একটা ঘরের ভেতর থেকে, ওর বউ পম্পা কাঁদছে। পম্পাকে পাড়ার কটা মেয়ে শক্ত করে ধরে আছে। দাওয়ার আলোতে আবছা দেখা যাচ্ছে। পাশের ঘরে পাইকপাড়ার ছেলেরা একজনকে আটকে রেখেছে। মারধোর করে সব ছিঁড়েছাঁড়ে দিয়েছে। পম্পা ভেতর থেকে কিছু দেখতে পাচ্ছে না। একটু শুধু দেখতে পেয়েছে, দশবারো জন মিলে তাকে উঠোনে ফেলে পেষাই করছে। এখনও মারছে কিনা, সে বুঝতে পারছে না। বাইকটা ধরিয়ে দিয়েছে, বসন্ত। আগুন ফুলকি মেরে উঠছে। তার আগে বাইকটা সবাই মিলে ভাঙচুরও করেছে।
পম্মা ধুনুনি তোড় দেখে আর্তনাদ করছে, ‘ওর ছেড়ে দও। মারলে, আমার মারো। ওর কোনো দোষ নি। আমি ওর ডেকিচি। ওর ছেড়ে দও। ও মরে যাবে। অত মার, ওর সহ্য হবে নে।’
বসন্ত বলছে, মরুক রে মাগী, জাত খানকি, বেশ্যা চুদি। তোর পুড়িয়ে মারব। তোর নাঙের মারব। খানকি। খানকি। খানকি।
পাড়ার ছেলেরা জ্বলন্ত বাইকটা একদিকে ধরে টেনে নিয়ে পুকুরে ফেলে দেয়। অনেকে বলছে, বাস্ট করলে বিপদ হতে পারে। ঘরদোর ধরে যাবে। গাড়ির পার্টস ঠিকড়ে কারও গায়ে মাথায় লাগলে আর বাঁচবে না। আকাল মৃত্যু হবে। তাই জলে নামিয়ে দেয়, জ্বলন্ত বাইক। সাবধানে ধরেও জ্বলন্ত বাইকের আগুনে তারকের হাত পুড়ে গেছে। বারনল দিতে হবে। মোহন বুঝতে পারছে না, কি বলা উচিত। কি করা উচিত। সে তালগোল হওয়া লোকজনের পিছনে বোবা দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। সে একা নয়, বেশিরভাগ সবাই বোবা দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
মোহনের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে, জুমলার বউ। মুখরা কোনও কথা আটকায় না।
সে গলা খেঙড়ে বলে, ‘কাটা ফলে মাচি উড়তেচে। হেলে তাড়াতে অ্যাইচে। লঙ্কা বেটে ঘষে দে। জ্বলন্ত শিক ঢুকিয়ে দে। কাপড়ের ভেতরে। রাতবিরেতে কাওরা পাড়ায় ঢুকে নোংরামি। বলি সাহস আচে, গোরবেটার।
জুমলার বউকে কেউ থামায় না। সে গালিগালাজ করেই যায়। সাইকেল নিয়ে পুলিশ ফাঁড়িতে খবর দেয়, বিশু। পাড়ার সরু রাস্তা দিয়ে পুলিশ ঢুকতে পারে না। খোর্দশাসন মোড়ে জিপগাড়ি রেখে পুলিশ ফোর্স পায়ে হেঁটে আসে। একজন সেকন্ড অফিসার আর দুজন কনস্টেবল। তারা এসে লোকজন পাতলা করে দেয়। জুমলার বউ একদম চুপ। ঘর থেকে বে ঘাড় ধরে লোকটাকে বের করে আনে।
সবাই দেখে যে বিড়িওলার ছেলে। এদের কাছ থেকে বসন্তর বউ বিড়িপাতা এনে বোনে। মাঝে মাঝে বাইকে করে এসে বিড়িপাতা দিয়েও যায়। পম্পার বিড়ি বাঁধার হাত বড় চমৎকার। একদিনে সে আশি-নব্বই টাকা রোজ ফেলে।
অন্ধকারে দাঁড়িয়ে একজন ফিসফিস করে বলে, ‘একদম হাতেনাতে ধরেচে। বসন্ত আজ আসবে, মাগী তো জানে নে। হঠাৎ চলে অ্যাইচে। ঘরের দাওয়ায় উটে দ্যাকে যে মে টা একটা ঘরে ঘোমাচ্চে। আর পাশের ঘরে ওরা হাল দেচ্চে। ঘাস বাসতেচে। আর ছাড়ে দুটোর আচ্ছা করে কাবলেচে। ছিঃ ছিঃ’
সেকেন্ড অফিসার বসন্তকে ডেকে বলল, ‘পরের দিন বেলা এগারোটায় পাড়ার সদস্য, আর দুচারজন বুঝদার লোক নিয়ে ক্যাম্পে চলে আসবে। বউকে নিয়ে যাবে। ফয়সালা যা হবার কাল হবে। যা বলবার কাল বলবে। বউকে লক্ষ্য রাখো। মারধোর করবে না। সবটা শুনে তারপর সিদ্ধান্ত হবে।’
কেউ কোনও কথা বলল না। কারও মুখে রা নেই। অনেকে ভেবেছিল, পুলিশ এলে কি না কি হবে ! তাদের প্রত্যাশা মতো কিছুই হল না। তবে পুলিশ আসামাত্র ঘরের শিকল খুলে বের করে অফিসার নিজে ঘা কতক দিয়েছে। কনস্টেবলও ওষুধ দিয়েছে। পুলিশ আসার আগে পাড়ার লোকের হাতেও ঝুল ঝাড়া হয়েছে। একেবারে থেঁতো হয়ে গেছে। থেঁতো করে তবেই তো ঘরে শিকল তুলে দিয়েছিল। বসন্তর বউ ঘা কতক খেয়েছে, স্বামীর হাতে। পুলিশ এসে পম্পাকে কিছু বলেনি। শুধু ঘরের শিকল খুলে তাকে বলেছে, এসবের কি কোনও দরকার ছিল ? বসন্তর বউ কোনও উত্তর দেয়নি।
অনেকে বলছে, ‘শালা, বাপের জন্মে আর কাওরা পাড়ার এ মুখো হবে নে। বড্ড হাঁড়ি মারার ঝোঁক। একদম মওকায় পড়ে গেচে।’
পুলিশের হাতে বড় বড় টর্চ। লোকটাকে নিয়ে বেশ ব্যস্ততার সঙ্গে তারা হাঁটা দেয়। দেখতে দেখতে রাস্তার বাঁকে হারিয়ে যায়, টর্চের আলো।
লোকজন ভিটভাট করতে করতে বাড়ির দিকে ফিরে যায়। বসন্ত মোহনকে দেখতে পেয়ে বলে, ‘মোহন ভাই সংসার করে কি করব, এই তো অবস্তা। কার জন্যে মুখ রগড়ে মরব। বলতে পারিস? বাঁচতে আর ইচ্ছে হয় নে। এই পাড়ায় অনেক দেকিচি, এই নোংরামি। শেষপর্যন্ত আমার ঘরেও সেটা হল।’
মোহন চুপ করে থাকে। কথা বলতে পারে না। বসন্তর কষ্টটা সে বোঝে। এ পাড়াতে হাঁড়ি মারা হুলো অনেক আছে। সংসার কম ভাঙেনি। শেখরের বউটা তো দোকান খুলে বসেছে। তার নাক-কান কিছু নেই। সবাই সব জানে। ঝন্টুর দাদা মন্টুর বউ এখন সরিষায় থাকে। যার সঙ্গে থাকে, তার ঘরেও বউ আছে। অন্যধর্মের লোক। তাই মন্টু বউ নিয়ে কোনও কথা বলে না। একবার তো সরিষার হাটে হাঁস-মুরগি বিক্রি করতে গিয়ে মন্টু তার সামনাসামনি পড়ে গিয়েছিল। সে এমন ভাব করল, যেন চেনে না। মন্টু সেদিন হাটে আর হাঁস-মুরগি নিয়ে দামাদামি করেনি, যে যা দাম দিয়েছে, সে দিয়ে দিয়েছে।
বিধবা ফামলি সে তো দু-দুবার হাতেনাতে ধরা পড়ে গেল। সে তো অসহায়। অনেকেই বলে, তার অভাবে স্বভাব নষ্ট হয়েছে। গজেনের মেয়ে পুতুল তার তের বছর হয়নি, সাত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিল, মধুবাটি। সে আবার মোচ্ছবের দিনে বসিরহাটের একটা ছেলের সঙ্গে পালিয়ে গেল। কোন্ সুখে গেল, সেই জানে। এরকম গন্ডা গল্প এই পাড়ায় ঘুরে বেড়ায়। একটা গল্প থামলে আর একটা গল্প ফুটতে শুরু করে। মাঠের আগাছার মতো মরে না, মারাও যায় না। কেবলই কচিয়ে ওঠে। মাঝেমধ্যে অশান্তির আগুন তো লেগেই যায়। ঢনঢনে পাইকপল্লীর বাঁশবাগানে রাত হলে জোনাকি পোকা জ্বলে। তাদের মধ্যে কোনও পরকীয়া আছে কিনা কে জানে! জ্যোৎস্না রাতে তালগাছে বাঁধা বাবুই পাখির বাসা স্পষ্ট দেখা যায়, তারা ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ উড়ে বেড়ায়। তাদের সংসার ছেড়ে তারা অন্য কারও কাছে নিজেদের সঁপে দেয় কিনা জানা নেই। তাদের সংসারে কথা আছে, কাকলি আছে কিন্তু অশান্তি নেই। আরও মাটির কাছে থাকা পাইপল্লী কেন এটা বোঝে না, মোহনের বারবার মনে হয়।
মোহন বসন্তকে বলে, তোমরা হলে জোড়া শালিক! ছোট একটা ঘটনা তোমাদের আলাদা করতে পারবে না। তুমি বউদিকে ভুল বুঝো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। বসন্তর বউ অগোছালো অবস্থায় আরও জোরে কাঁদতে থাকে। মোহন সবার মতো বাড়ির দিকে ফিরে যায়। বসন্ত নিজেই তার বউকে মেঝের মাটি থেকে তুলে বিছানায় শুইয়ে দেয়। বাচ্চাটাকে মায়ের পাশে শুইয়ে দেয়। রাত্রির স্তব্ধতা ধীরে ধীরে ঘনীভূত হয়ে ওঠে। পাইকপল্লী ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে যায়।
চলবে…