অন্তু, এই অন্তু …
কিরে অন্তু, সাড়া দিচ্ছিস না কেন? মায়ের মৃতদেহটাও কি একবার দেখবি না! …ওরে এরপর কেঁদেও কুল পাবিনা, মায়ের মরা মুখটা দেখার জন্য কত দূর-দূরান্ত থেকে সন্তানেরা ছুটে আসে, আর তুই একই বাড়িতে থেকে…
মামাতো দাদা-বৌদি, ছোটমামা-মামী, মাসীমা ডেকেডেকে হয়রান হয়ে গেলেও, সন্ধ্যে সাতটাতেই একই বাড়ির দোতলা নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। অথচ সশরীরে অন্ত, তার স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে দরজা-জানালা বন্ধ করে একেবারে নিস্তব্ধ, নির্বাকদ।
একতলায় বড়ছেলে সন্তুর ঘরে ইন্দুমতীদেবীর দেহ শয়ান, চোখের ওপর তুলসীপাতা আর কপালে চন্দন-ফোঁটা। চারিপাশে পরিবেষ্টিত ঢিল ছোঁড়া দুরত্বের বাপের বাড়ির মহিলা ব্রিগেড, তাদের অতি প্রিয় ননদ অথবা পিসিমা, কারো পিসিশ্বাশুড়ী, কারো আদরের দিদির দেহ আগলে।
হঠাৎ ঝড়ের মত কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ঢুকেই মায়ের বুকে আছড়ে পড়ল বড় মেয়ে ঈশিতা। অবস্থা খুব খারাপ শুনে আর কোন দিকে না তাকিয়ে পার্সটা হাতে নিয়ে হাজব্যাণ্ডকে, ‘আমার মা বোধ হয় আর নেই, আমি এগোচ্ছি‘ কথা কটা বলেই বেরিয়ে পড়েছে, কটা বাজে বা ট্রেণের টাইম না জেনেই…
ভাগ্যক্রমে ষ্টেশনে পৌঁছে টিকিট কাটতে, না-কাটতেই ট্রেন ঢুকে পড়ল। দৌড়ে সামনের কম্পার্টমেন্টে উঠে দাঁড়াতেই ট্রেন ছেড়ে দিল, এতক্ষণে টনক নড়ল… কম্পার্টমেন্টটা এত ফাঁকাফাঁকা কেন? দেখল রাত প্রায় ন’টা বাজে, এত রাত্রে একা কখনই দমদম থেকে একা ট্রেনে যাওয়ার কথা ভাবতেই পারেনি ঈশিতা। এখনকার কথা তো নয়, আরো প্রায় পনের বছর আগে ২০০৫ সালের ব্যাপার। একদল মহিলার ফিরতি-পথে সময় কাটানোর জন্য কীর্তন গাইতে শুনে মনে সাহস সঞ্চার করে গন্তব্যে পৌঁছে রিক্সা নিয়ে বাড়ি ঢুকেই দেখে সামনে বাঁশ দিয়ে চালি বানানো হচ্ছে…
আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে? প্রায় রাত দশটায় ঈশিতাকে উদভ্রান্তের মত ঘরে ঢুকতে দেখে, মামী-মাসীর জিজ্ঞাসার উত্তরে সংক্ষিপ্ত জবাব শেষ হওয়ার আগেই ছোটমেয়ে তৃষিতা সপরিবারে লাউহাটি থেকে গাড়ি ভাড়া করে হাজির। তখন মোটামুটি বডি চালিতে তোলার ব্যবস্থা হচ্ছে, তৃষিতার জন্য আরো একটু অপেক্ষা করতেই হল, ইতিমধ্যে সন্তুর একমাত্র মেয়ে অনামিকাও চলে এসেছে।
রেডি করে ট্রাক ছাড়তে ছাড়তে প্রায় রাত এগারোটা…
বসে কথোপকথনেই বাকি রাত কাবার। দাহকার্য শেষ করে ফিরতে ভোর পাঁচটা, ওখানে তো তখন ইলেকট্রিক চুল্লি ছিল না, বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া কাঠেই দাহ করা হত।
নাহ, তখনও পর্যন্ত দ্বিতলবাসীরা নিঃশব্দেই বিরাজমান, তৃষিতার স্বামী স্বজল, শ্মশান থেকে ফিরেই কালবিলম্ব না করে পুত্র অনিমিখকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির রাস্তা ধরল। ঈশিতারা দু’বোনেই ঠিক করল, একেবারে মায়ের চতুর্থীটা ওখানে সেরেই ফিরবে, কারণ বাড়িতে ফিরে করতে গেলে, পুরোহিত জোগাড়ের ঝামেলা, জিনিসপত্র কেনাকাটা…
তারচেয়ে এখানের জানাশোনা পুরোহিত, দরকারি জিনিসপত্র ও নিজেই জোগান দেবে, পরিবর্তে মূল্য ধরে দিলেই হবে। দু’বোনে পাশাপাশি বসে কাজ করে নিল, তারপর ছোটমামী ডেকে মাছের ঝোল, তরি-তরকারি রান্না করে বসিয়ে খাইয়ে দিল। মায়ের চেয়ে বয়সে বেশ ছোট হলেও দুজনের মধ্যে হৃদ্যতা ছিল খুবই, একসঙ্গেই দুজনে বেরতো প্রয়োজনে।
ছোট থেকেই ওরা দেখেছে এক বেলা ছোটমামী ওদের বাড়ি আসত, আরেক বেলা মা যেত মামাবাড়ি…
ও বাড়ির মেয়ে-বউদের চুল বেঁধে দেওয়ার অছিলায়। সবাই পিসিমার কাছে চুল বাঁধতে পছন্দও করত খুব…
সেদিন বিকেলেই দু’বোনে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল তবে দাদাকে কথা দিয়ে এল মায়ের শ্রাদ্ধের সময় অবশ্যই আসবে।
সেদিন সকালের দিকেই দুজনে পৌঁছে গেছিল মায়ের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে। ওদের প্রথা অনুযায়ী আদ্যশ্রাদ্ধের কাজ হয় গোয়ালঘরে। সকালেই গোরু বার করে দিয়ে ভাল করে পরিস্কার করে নিয়ে ওখানেই উনান তৈরি করে পিণ্ডদানের জন্য নতুন মাটির হাঁড়িতে পাটকাঠির জ্বালে ভাত রান্না হয়, পাশেই আদ্যশ্রাদ্ধের ক্রিয়াকর্ম চলতে থাকে সঙ্গে গীতাপাঠও…
অনেকের কাছেই ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত মনে হতেই পারে, কিন্তু ওরা যে কান্যকুব্জ ব্রাহ্মণ। আদ্যশ্রাদ্ধের পরদিন থাকে সপিণ্ডকরণ, সাতপুরুষকে পিণ্ডসহ জলদান। সেদিন সকাল এগারোটায় শুরু করলে একেএকে সাতপুরুষের কাজ সারতে রাত আটটা-ন’টা হয়ে যায়। এটা করা থাকলে আর বাৎসরিক শ্রাদ্ধ না-করলেও চলে, তবে অধিকাংশ ছেলেরাই নিয়মিত বাৎসরিক কাজও করে থাক…
এ দুদিনও অন্তুদের টিকিটিও দেখা গেল না, আশ্চর্য্যভাবে পরদিন অর্থাৎ নিয়মভঙ্গ বা মৎস্যমুখের দিন, দ্বিতল থেকে জোরেজোরে মন্ত্রোচ্চারণের শব্দ এবং কয়েকজনের কলরব সঙ্গে রান্নার গন্ধও পাওয়া যেতে লাগল। সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল…
কি ব্যাপার?
একটু পরেই সব পরিস্কার হয়ে গেল… একজন পুরোহিতের পরামর্শে (সম্ভবতঃ কিছু টাকার বিনিময়ে) আগের দিন অন্তু কাছা নেয় এবং নিয়মভঙ্গের দিন মাতৃশ্রাদ্ধ করা উপলক্ষে পাড়ার ঘনিষ্ঠ কয়েকজনকে এবং মামাবাড়িতেও নিমন্ত্রণ জানিয়ে আসে।
স্বভাবতই তাঁরা আগে থেকেই সন্তুর নিমন্ত্রিত, তাই পত্রপাঠ নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন, হাতে গোনা দশ/বারোজনই উপস্থিত হয়েছিলেন, সম্ভবত অমন তাজ্জব ব্যাপারটা সচক্ষে প্রত্যক্ষ করার লোভ সংবরণ করতে না পেরে।
সত্যিই তাজ্জব ব্যাপার…এ ভাবেও মাতৃভক্তি দেখিয়ে মাতৃদায় থেকে অব্যাহতি পাওয়া যায়???
বোধ হয় লাখ টাকার প্রশ্ন…
মাতৃঋণ
এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
তিনি একজন গল্পকার ও উপন্যাসিক। এ পর্যন্ত তার তিনটি সম্পূর্ণ উপন্যাস পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়েছে।
একটি মন্তব্য করুন
একটি মন্তব্য করুন