সমাজ তখন ব্যাভিচার, কুঃসংস্কারে মেঘাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে ৷ সতীদাহ প্রথা, বাল্যবিবাহ, কৌলিন্য প্রথার মতন কুঃসংস্কার সমাজকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে ৷ অষ্টাদশ এবং উনিশ শতকের মধ্যভাগে ব্যাভিচার সমাজকে এমনভাবে গ্রাস করলো যে সে সময়ের নারী সমাজও এর থেকে রেহাই পেলো না৷ বাল্য বিবাহের ক্ষেত্রেও আট নয় বছরের মেয়েরা বৃদ্ধ স্বামীর ঘর করতো৷ যখন সেসব মেয়েরা যুবতী হতো ততদিনে তাদের স্বামীরা মরেও যেতো৷ ঘরে ঘরে স্বামী পরিত্যক্তা কুলীন কন্যা ও বিধবাদের ব্যাভিচার সমাজকে অধঃপতনের চূড়ান্ত সীমায় নামিয়ে আনলো৷
সমাজে পতিতার সংখ্যা এত বৃদ্ধি পেল যে তৎকালীন পুরুষ সমাজ পথভ্রষ্ট হলো৷ কুলীন কন্যাদের নামে মাত্র বিবাহ হতো এবং তারাও বাল্য বিধবাদের মতন স্বধর্ম নষ্ট করতো৷ সবচেয়ে বিপদের কথা এই যে বাল্যবিধবা বা স্বামী পরিত্যক্তা কুলীন কন্যাদের কোথাও স্থান হতো না৷ তারা গিয়ে পতিতালয়ে আশ্রয় নিতো৷
এদিকে বহুবিবাহ সার্বজনীন হয়ে পড়লো৷ পঞ্চান্ন বছরের কুলীন পাত্র একশো সাতজন কন্যার পাণি গ্রহন করেছেন, এরকম দৃষ্টান্তও আছে৷
ওদিকে সতীদাহ প্রথা তখন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। অজ্ঞ নারীদের অক্ষয় স্বর্গ লাভের প্রলোভন দেখিয়ে তাদের স্বামীদের সঙ্গে সহমরণে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে। মিসেস স্পেয়ার এবং মিসেস ক্লিম্যানের গ্রন্থদ্বয়ে সতীদাহের বহু জ্বলন্ত উদাহরণ পাওয়া যায়। উলার মুক্তারাম নামে এক ব্যক্তির তেরো জন স্ত্রী ছিল। তিনি যখন মারা যান সবাই তার সঙ্গে সহমৃতা হন। কিন্তু তার মধ্যে একজন পালাবার চেষ্টা করলে তাকে জোর করে চিতায় নিক্ষেপ করা হয়। বাগনান পাড়ায় এক ব্রাহ্মণের একশো জন স্ত্রী ছিল। তার মৃত্যুর পর সায়ত্রিশ জন স্ত্রী সহমৃতা হন। এই মানুষ নিধন যজ্ঞ তিন দিন ধরে চলেছিল।
পলাশীর যুদ্ধের পঞ্চাশ বছর আগে থেকেই বাঙালির চরিত্র স্খলন শুরু হয়ে গিয়েছিল। পুরুষদের ভ্রষ্ট নীতি, মনুষ্যত্ব হীনতা, লোভ লালসা সমাজকে গ্রাস করেছিল৷ সেখানে নারীর কোনও আলাদা জীবনদর্শন থাকতে পারে না, এটাই স্বাভাবিক৷ এরকম অস্থির একটা সময়ের মধ্যেই আনন্দময়ী দেবী, গঙ্গা মনি দেবীর মত বিরল কাব্যপ্রতিভার জন্ম হয়েছিল৷
১৭৫২ সাল৷ পলাশীর যুদ্ধ তখনও হয়নি! ইংরেজ বণিকের মানদণ্ড তখনো রাজদন্ডে পরিণত হয়নি৷ এইসময় পূর্ববঙ্গের বিক্রমপু্রের প্রসিদ্ধ সাধক কবি লালা রামগতি সেন ও কাত্যায়নী দেবীর কোল আলো করে জন্ম নিলেন মহীয়সী বিদুষী কবি আনন্দময়ী দেবী৷ রামগতি সেন স্বহস্তে কন্যার শিক্ষার ভার গ্রহণ করে তাকে সম্পূর্ণরূপে শিক্ষিত করার জন্য নিজেকে নিয়োজিত করলেন! ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে পয়গ্রামবাসী প্রভাকার বংশীয় রূপরাম কবিভূষণের পুত্র অযোধ্যারাম সেন এর সঙ্গে আনন্দময়ী দেবী বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হলেন৷ লালা রামপ্রসাদ সেন ছিলেন আনন্দময়ী দেবীর দাদু৷ তিনি আনন্দময়ী এবং অযোধ্যারামের সঙ্গে নাম মিলিয়ে ‘আনন্দী রাম সেন’ নামে বৃত্তি প্রদান করলেন! অযোধ্যারাম সংস্কৃত ভাষায় সুপন্ডিত ছিলেন। কিন্তু আনন্দময়ী দেবীর বিদ্যার খ্যাতি তার যশকে খর্ব করেছিল।
একবার আনন্দময়ী দেবীর ইচ্ছা হয়েছিল শিব পূজা করার। সে সময় রাজনগরবাসি পন্ডিত শ্রেষ্ঠ ছিলেন কৃষ্ণদেব বিদ্যাবাগীশ। তাকে পূজা পদ্ধতি লিখে দেবার জন্য আনন্দময়ী অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু তিনি ব্যস্ত থাকায় তার পুত্র হরিদেব বিদ্যালঙ্কার আনন্দময়ীকে শিবপূজা পদ্ধতি লিখে দিয়েছিলেন। সেই শিবপূজা পদ্ধতি দেখে আনন্দময়ী প্রচণ্ড রেগে গেলেন। কারণ সেখানে অনেক জায়গায় ভুল ছিল। আনন্দময়ী স্বয়ং বিদ্যাবাগীশ মহাশয়কে তার পুত্রের অধ্যায়ন সম্পর্কে যথেষ্ট অনীহা আছে এই বলে অভিযোগ জানালেন। বিদ্যাবাগীশ এই অভিযোগ মেনে নিয়েছিলেন এবং পরে সঠিক পূজা পদ্ধতি আনন্দময়ী কে লিখে পাঠিয়েছিলেন।
একবার মহারাজা রাজবল্লভ অগ্নিষ্টোম যজ্ঞ করবেন বলে মনস্থির করেছিলেন। তখন তিনি যজ্ঞের প্রমাণ ও যজ্ঞকুন্ডের প্রতিকৃতি জানতে চেয়ে রামগতি সেন এর কাছে চিঠি লিখেছিলেন। কিন্তু রামগতি তখন অন্যত্র থাকায় এই কাজের দায়িত্ব পড়লো আনন্দময়ীর উপর। আনন্দময়ী যথাসময়ে প্রমাণ ও প্রতিকৃতি একে পাঠালেন। তার বিদ্যাবত্তা ও পাণ্ডিত্য দেখে রাজসভায় সবাই তার নামে ধন্য ধন্য করতে লাগলেন। সওদাগর পুত্র চন্দ্রভানুর সঙ্গে সুনেত্রার ‘বাসি বিবাহ’ উপলক্ষে আনন্দময়ীর একটি কাব্য প্রতিভার বিবরণ দেওয়া হলো ——
হের চৌদিকে কামিনী লক্ষে লক্ষে
সমক্ষে,পরক্ষে, গবাক্ষে ,কটাক্ষে৷৷
কতি প্রৌঢ়া রূপা ওরূপে মজন্তি৷
হসন্তি, স্খলন্তি, দ্রবন্তি,পতন্তি৷৷
কত চারু বক্ত্র সুবেশা, সুকেশা৷
সুনাসা,সুহাসা ,সুবাসা ,সুভাষা৷৷
আমাদের দেশে আগে বিবাহ অন্নপ্রাশন প্রভৃতি মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে রমনীরা উলুর ধ্বনির সঙ্গে বিয়ের গান, অন্নপ্রাশনের গান প্রভৃতি সুমধুর ভাবে পরিবেশন করতেন যা বিশেষ উপভোগ্য ছিল। আনন্দময়ী দেবী এরকম কিছু গান রচনা করেছিলেন। তারই কিছু দৃষ্টান্ত এখানে লিপিবদ্ধ করা হলো।
বিবাহের গান
যাত্রা করি রঘুনাথ করিলেন গমন |
জানকী করিতে বিয়া চলেন নারায়ণ ৷৷
পঞ্চ শব্দে বাদ্য বাজে জনক রাজার বাড়ি ৷
রঘুনাথ করিবেন বিয়া জনক কুমারী ৷৷
সর্ব্বলোকে বলে ধন্য সীতার জননী ৷
তাহাকে দিবেন সেবা দেব রঘুমণি ৷৷
অন্নপ্রাশনের গান
ছয় মাসের রঘুনাথ জননীর কোলে ৷
কেলী করে দেখে রাজা মন কুতুহলে ৷৷
নবশশী জিনি ক্লান্তি বাড়ে দিন দিন৷
কত পূর্ণ শশী মুখ হেরিয়া মলিন ৷৷
অন্নপ্রাশনের হেতু কইলা অনুমতি৷
আসিলেন বশিষ্ঠ ঋষি অতি হৃষ্টমতি৷৷
শুভ তিথি বার আর নক্ষত্র বিহিত ৷
বিচারিয়া শুভক্ষণ কহেন পুরোহিত৷৷
নানা মত করিলেন মঙ্গল রচন ৷
নানা স্থানে নাচে গায় যত বামাগন ৷৷
আনন্দময়ীর তার কাকা জয় নারায়নকে ‘হরি লীলা’ গ্রন্থ রচনা করতে বিশেষ সাহায্য করেছিলেন। একবার জয় নারায়ন কাব্য রচনায় এত নিমগ্ন ছিলেন যে অনেক বেলা হয়ে গিয়েছিল তা সত্ত্বেও তিনি স্বানাহারের কথা ভুলে গিয়েছিলেন। আনন্দময়ী তখন কাকাকে স্বানাহারের জন্য বারবার অনুরোধ করতে লাগলেন। কবি জয়নারায়ন বললেন যে ভগবানের দশ অবতারের বর্ণনা তার অল্প বাকি আছে। সেটুকু শেষ হলেই তিনি উঠবেন। কিন্তু আনন্দময়ীর ঐকান্তিক অনুরোধ তার উপেক্ষা করা সম্ভব হলো না। স্বানাহারে যেতে তিনি বাধ্য হলেন। এই অবসরে আনন্দময়ী লিখলেন–
জলজ বনজ যুগ যুগ তিন রাম ৷
খর্বাকৃতি বুদ্ধদেব কল্কি সে বিরাম৷৷
এত সংক্ষিপ্ত ভাবে বিষ্ণুর দশ রূপের বর্ণনা যা অকল্পনীয়।
কুটিল কুন্তল তার,বন্ধন শঙ্কায়৷
নিতম্বে পড়িয়া পদ ধরিবারে ধায়৷৷
কি সুন্দর স্ত্রীলোকের কেশের বর্ণনা যা সে যুগের কাব্য সাহিত্যে এক অনন্য মাত্রা পৌঁছে দেয়।
আনন্দময়ীর রচনার মধ্যে শব্দ সম্পদ ও অনুপ্রাসের এক অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটেছিল। আনন্দময়ী শুধুমাত্র সুশিক্ষিত ছিলেন না, তার নম্র স্বভাব,ধর্মপরায়নতা সবাইকে মুগ্ধ করেছিল। যখন তার স্বামীর মৃত্যু হল তখন তিনি বাপের বাড়িতে ছিলেন। এই হৃদয় বিদারক খবর পেয়ে তিনি শোকাতুর হয়ে উঠলেন। তিনি এতই পতিব্রতা ছিলেন যে স্বামীর কাষ্ঠ পাদুকা বক্ষে ধারণ করে জ্বলন্ত চিতায় ঝাঁপ দিয়ে স্বামীর অনুগামিনী হলেন।
এভাবেই এক কবি প্রতিভার জীবনের পূর্ণচ্ছেদ হয়েছিল।