মধ্যযুগে সাহিত্যের পথ-
চলার গতি অনেকটাই মন্থর হয়ে যায়। অর্থের মাপকাঠিতে মানুষের মর্যাদা নিয়ন্ত্রিত হতো। সেসময়কার সাহিত্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যৌন ব্যাভিচার, উৎকোচ গ্রহণ এসবের প্রাধান্যই লক্ষিত হয়।
কৌলিন্য প্রথা, বাল্যবিবাহ, সতীদাহ, সতীন নিয়ে ঘর, অকাল বৈধব্য তৎকালীন নারী সমাজকে জর্জরিত করে তুলেছিল। মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবনে নিষেধের বেড়াজাল প্রাচীর গড়ে তুলেছিল। যখন নগর পোড়ে তখন দেবালয়তো রক্ষা পায় না। তাই নারী সমাজও রক্ষা পায়নি। ভারতবর্ষে তখন মুসলমানদের অনুপ্রবেশ ঘটে গিয়েছে। বহু ভারতীয় নারী পুরুষই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। ভারতীয় সমাজে দ্রুত পরিবর্তন ঘটতে লাগলো। হিন্দুদের মত মুসলমান সমাজেও নারীদের অস্তিত্ব সংকটময় হয়ে উঠলো। নারী-পুরুষের সহজ-স্বাভাবিক মেলামেশা নিন্দনীয় হল। বাঙালি মুসলমান রমণীদের মধ্যে বাল্যবিবাহ প্রথা চালু হলো। স্বামীর মৃত্যুর পর মুসলমান স্ত্রীরাও হিন্দু রমণীদের মত মাথা কামাতো৷ রঙিন বস্ত্র, অলংকার সব পরিত্যাগ করত। নারী শিক্ষা শুধুমাত্র অভিজাত শ্রেণীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকল। শাস্ত্র চর্চার ক্ষেত্রে নারীদের বিধিনিষেধ না থাকলেও বাল্যবিবাহের কারণে নারী শিক্ষা স্বভাবতই ব্যাহত হলো।
ঠিক এরকমই একটা সময় সপ্তদশ শতাব্দীতে ফরিদপুর জেলার অন্তর্গত ধানুকা গ্রামে এক নিষ্ঠাবান প্রসিদ্ধ পণ্ডিতের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন বৈজয়ন্তী দেবী। খুব কম বয়সেই কাব্য, দর্শন প্রভৃতি বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করে তিনি খ্যাতি লাভ করেছিলেন। পরবর্তীকালে ফরিদপুর জেলার কোটালীপাড়ায় বিখ্যাত পন্ডিত কৃষ্ণনাথ সার্বভৌমের সঙ্গে তিনি বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হলেন।
তিনি সুন্দরী ছিলেন না এবং তার পিতা বংশ মর্যাদায় তার শ্বশুরবাড়ির সমকক্ষ ছিলেন না বলে যৌবন সমাগমের পরেও তাকে অনেক দিন পর্যন্ত বাপের বাড়িতে থাকতে হয়েছিল।
এই সময় তিনি একটি রূপক ধর্মী সংস্কৃত শ্লোক রচনা করে তার স্বামীকে পাঠিয়েছিলেন।
সেটি হল —
“জিতধূমসহারায় জিতব্যজন বায়বে৷
মহাকায় ময়াকায়ঃ সায়মারভ্যদীয়তে৷”
শ্লোকটির অর্থ এই যে হে স্বামী আমার কষ্টের কথা আর কি বলব। সামান্য মশারির অভাবে দুর্জয় মশকগন আমাকে নির্দয় ভাবে দংশন করছে।
এর অন্য রকম অর্থ হল যে আপনার বিরহে আমি শয়নের দ্রব্যাদি যথা শয্যা, বালিশ ও মশারি ত্যাগ করেছি। যার জন্য রাত্রিবেলা মশারা আমাকে নিষ্ঠুরভাবে দংশন করে তাদের রক্ত পিপাসা নিবৃত্ত করছে। আমার শরীরে আপনারই একমাত্র অধিকার। এখানে অন্য কেউ স্পর্শ করলে সেটা আপনারই কলঙ্ক। আপনি এই কলঙ্ক মোচনের জন্য সচেষ্ট হন।
স্বামী কৃষ্ণনাথ পত্নী বৈজয়ন্তী দেবীর এরকম সুন্দর রূপক ধর্মী পত্র পেয়ে অত্যন্ত আনন্দ পেলেন এবং অবশেষে মান-অভিমান ত্যাগ করে একখানি প্রেম পূর্ণ পত্র় লিখে পাঠালেন। কৃষ্ণনাথের পত্র পড়ে বৈজয়ন্তী দেবীও আনন্দিত হয়ে উঠলেন। বুঝলেন, এতদিন পরে তাদের দীর্ঘ বিরহ রজনীর অবসান হলো। একদিন সকাল বেলা কৃষ্ণনাথ শশুরের নিমন্ত্রণ না পেয়েও শ্বশুরবাড়ি এলেন এবং স্বামী স্ত্রীর মিলন হল। তারপর উভয়েই কোটালীপাড়ায় বসবাস করতে লাগলেন।
বৈজয়ন্তী দেবী মূলত সংস্কৃত ভাষায় কবিতা রচনা করতেন। এছাড়াও “আনন্দ লতিকা” নামে একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংস্কৃত কাব্যগ্রন্থ তারা স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে রচনা করেছিলেন। বৈজয়ন্তী দেবী তার ইষ্ট দেবতার উদ্দেশ্যে বহু স্তব রচনা করেছিলেন। সেগুলো রচনার মধ্যে দিয়ে তার অনন্য কবিসত্তার পরিচয় পাওয়া যায়।