বরিশালের লবণ আন্দোলন

প্লাবনী ইয়াসমিন
প্লাবনী ইয়াসমিন
5 মিনিটে পড়ুন

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রখ্যাত রাজনৈতিক নেতা এবং সমাজ সংস্কারক গোপালকৃষ্ণ গোখলে বলেছেন, ‘বাংলা আজ যা ভাবে, ভারত ভাবে আগামীকাল। অন্যদিকে আর মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, যখন সমস্ত ভারত গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন ছিল, তখনও বরিশাল সদা জাগ্রত।

প্রাচীনকালে থেকে বরিশালের জনগণ সমুদ্রজল ও লবণ মিশ্রিত মাটি রোদে শুকিয়ে লবণ তৈরি করত। লবণচাষ লাভজনক দেখে পলাশীর যুদ্ধের পর ইংরেজ বণিক ও কর্মচারীরা বিনা শুল্কে বরিশালে লবণ ব্যবসা শুরু করে। ঝালকাঠিতে ইংরেজ লবণ এজেন্ট বাস করত। ইংরেজ এজেন্ট দেশীয় কৃষকদের বিনা অনুমতিতে লবণ তৈরি বন্ধ করে দেয়। ঝালকাঠির বৈদারাপুর গ্রামে এক কৃষক পরিবার নিষেধ ভঙ্গ করে লবণ উৎপাদন করে। ফলে এক ইংরেজ কর্মচারী বৈদারাপুর গমন করে এবং অত্যাচার শুরু করে। এ সংবাদ শুনে কৃষকরা ইংরেজ সাহবেকে আক্রমণ করে এবং তাকে ধরে লবণের তাফালে ফেলে দিয়ে হত্যা করে। বাংলার বুকে সাধারণ কৃষকদের হাতে কোনো ইংরেজ সাহেব হত্যার এটিই সম্ভবত ছিল প্রথম ঘটনা।

বিলাতের লবণ বিক্রির জন্য ইংরেজ সরকার এ দেশে লবণ উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। সরকারী আদেশ অমান্য করে ভোলা মহকুমার কৃষকরা দেশীয় লবণ উৎপন্ন অব্যাহত রাখে। তারা মির্জাকালু, ভোলা, দৌলতখাঁ, তজুমদ্দিন, লাল মোহন, বোরহান উদ্দীন, মনপুরা প্রভৃতি বাজারে লবণ বিক্রি করত। স্বদেশী আন্দোলনের সময় বিলেতী লবণ পরিত্যাগ করে দেশীয় লবণের আন্দোলন শুরু হয়। দৌলতখাঁ থানার মির্জাকালু লবণ বিক্রির প্রধান কেন্দ্র ছিল। সরকার এ বন্দরে লবণ উৎপাদন ও বিক্রি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু কৃষকরা সরকারের নিষেধ উপেক্ষা করে লবণ উৎপাদন করতে থাকে, ফলে অনেক কৃষক পুলিশের হাতে লাঞ্ছিত হয়।

সরকারী দমন নীতির বিরুদ্ধে ভোলার উকিল দক্ষিণারঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, দ্বারকানাথ ঘোষ, আবদুল বারি, চুনীলাল সেন, অমূল্য মুখোপাধ্যায়, নূর আহমেদ সিকদার, তোফায়েল আহমেদ চৌধুরী আন্দোলন শুরু করে।মির্জাকালু বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় হতে রাজনৈতিক আন্দোলনের জন্য বিখ্যাত ছিল। আন্দোলনের ব্যাপকতা ও সফলতার জন্য মির্জাকালুর আর এক নাম হয় স্বরাজগঞ্জ। মির্জাকালুর অনুশীলন কর্মী যোগেশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও কংগ্রেস নেতা সুরেশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে এক বিরাট প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। শুরু হলো অসহযোগ আন্দোলন। মির্জাকালু বন্দরে দেশীয় লবণ বিক্রি হতে থাকে।

- বিজ্ঞাপন -

সরকার এ সংবাদ জানতে পেরে প্রথমে পুলিশ ও গুর্খা পুলিশ প্রেরণ করে। বিক্ষুব্ধ জনতা প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। পুলিশ ও গুর্খা পুলিশ প্রথমে লাঠি চার্জ করে আন্দোলন দমন করতে ব্যর্থ হয়। ১৯২২ খৃৃস্টাব্দে, বাংলা ১৩৩০ সনে পহেলা বৈশাখ সরকারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনগণ তীব্র প্রতিবাদ জানায়। গুর্খা পুলিশ জনতার ওপর গুলি বর্ষণ করলে মোট ৫০ জন আহত হয়।প্রথম শহীদ হলেন মির্জাকালুর পেয়ারপুর গ্রামের কোরবান আলী এবং বিশারাম গ্রামের কেরামত আলী। মতিউর রহমান, পঞ্চানন বণিকসহ অনেকে আহত হলেন। রাজকুমার দত্ত, বিনয় চক্রবর্তী, চন্দ্রমাধব গাঙ্গুলী, বেলায়েত হোসেন (মাষ্টার) ও মুখলেসুর রহমান গ্রেফতার হলেন। গঙ্গাপুরের ডাঃ গোলামুল হক বেলায়েত মাস্টার ও কলসকাঠী থেকে শরবিন্দু মুখোপাধ্যায় (কষ্ট), কালীপদ মুখোপধ্যায়, মনোরঞ্জন দত্ত, মহেন্দ্র দত্ত, মহেন্দ্র দত্ত এবং মধুসুদন দত্ত আন্দোলনে অংশ গ্রহন করেন।

১৯৪৭ খৃৃস্টাব্দে পর্যন্ত- পহেলা বৈশাখ শহীদ কোরবান আলী ও শহীদ কেরামত আলীর স্মরণে এ জেলায় অনেক লবণবিহীন খাদ্য গ্রহণ করত এবং জনসভা হতো। এ বিদ্রোহী কৃষকদের আজ আর কেউ স্মরণ করছে না। অথচ তাদের স্মরণে একদিন মির্জাকালু বাংলাদেশে স্বরাজগঞ্জ নামে পরিচিত ছিল। শহীদ কোরবান আলী, কেরামত আলী বরিশালের গৌরব ও অহঙ্কার। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তাদের নাম চির ভাস্বর হয়ে থাকবে।

১৯২২ খৃৃস্টাব্দে মৃজাকালুর গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে, ১৯৩০ খৃৃস্টাব্দে পর্যন্ত এ জেলায় লবণ আন্দোলন চলে। ১৯৩০খৃৃস্টাব্দে মহাত্মা গান্ধী ধর্শনার সমুদ্র তীরে লবণ তৈরি আন্দোলন করলে সারা ভারতে লবণ আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের বৈশাখ মাসে ২২ জন পুরুষ ও ৩ জন মহিলা নিয়ে শরৎ কুমার ঘোষ বরিশাল থেকে নলচিড়া পর্যন্ত পদব্রজে গমন করেন এবং জনগণকে দেশীয় লবণ ব্যবহারে উৎসাহিত করেন। লবণ আইন অমান্যের অপরাধে শরৎ কুমার ঘোষ সহ অনেককে ইংরেজ সরকার কারাদগু প্রদান করেন। শরৎ ঘোষের অবর্তমানে তার স্ত্রী উষাঙ্গনী দেবী লবণ আন্দোলন চালিয়ে যান।

ভারতীয় উপমহাদেহে অসহযোগ আন্দোলনের পর লবণ সত্যাগ্রহই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংগঠিত ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলন। ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস “পূর্ণ স্বরাজ” প্রস্তাব গ্রহণ করার অব্যবহিত পরেই এই সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সূচনা ঘটে। ১২ মার্চ ১৯৩০ খৃৃস্টাব্দ, আমেদাবাদের কাছে তার সবরমতী আশ্রম থেকে মহাত্মা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ডান্ডি পদযাত্রা শুরু করেন। ২৪ দিনে ২৪০ মাইল (৩৯০ কিলোমিটার) পথ পায়ে হেঁটে ডান্ডি গ্রামে এসে বিনা-করে সমুদ্রের জল থেকে লবণ প্রস্তুত করেন। বিশাল সংখ্যক ভারতীয় তার সঙ্গে পায়ে হেঁটে ডান্ডিতে আসেন। ১৯৩০ সালের ৬ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৬টার সময় গান্ধীজি লবণ আইন ভেঙে প্রথম লবণ প্রস্তুত করেছিলেন। এই ডান্ডি পদযাত্রা বা সত্যাগ্রহ আন্দোলনই ছিল ঔপনিবেশিক ভারতে ব্রিটিশদের একচেটিয়া লবণ নীতির বিরুদ্ধে একটি অহিংস করপ্রদান-বিরোধী প্রতিবাদ আন্দোলন। এই আন্দোলনের মাধ্যমেই আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা হয়। কিন্তু এরও ৭ বছর পূর্বেই বরিশালে লবণ আন্দোলন শুরু হয়েছিল। লবণ পদযাত্রা ঔপনিবেশিক ভারতে ব্রিটিশদের একচেটিয়া লবণ নীতির বিরুদ্ধে একটি অহিংস করপ্রদান-বিরোধী প্রতিবাদ আন্দোলন। আর ঐতিহাসিক সেই আন্দোলনের মাধ্যমেই আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
লেখক এবং সমাজসেবক। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, বরিশাল জেলা শাখা কার্য্যকরী কমিটির সদস্য।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!