একদিকে ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রী, তথা শাসক দল তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় রয়েছেন জেলে। তার বান্ধবীর বাড়ি থেকে কোটি কোটি নগদ টাকা উদ্ধারের ঘটনা সারাবিশ্ব টিভির পর্দায় দেখেছে। এর পরের ধাপে শিক্ষা দপ্তরের প্রায় সব শীর্ষ আধিকারিক, উপদেষ্টারা জেলে ঢুকেছেন। আর অন্যদিকে খোলা রাস্তায় দিনের পর দিন নাগাড়ে বসে চাকরির দাবিতে আন্দোলন করছেন প্রকৃত টেট উত্তীর্ণ চাকরিপ্রার্থীরা।
চাকরিপ্রার্থীদের প্রতি সহানুভূতি দেখানো তো দূরের কথা, উল্টো গত সপ্তাহের শেষ দিকে মধ্যরাতে আন্দোলনকারীদের জবরদস্তি সরিয়ে দিয়েছিল রাজ্য সরকারের পুলিশ। সেই ঘটনায় নতুন করে উত্তাল হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। সরকারের বিরুদ্ধে ক্রমশ তীব্র হচ্ছে জনরোষ। চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলনের প্রতি সমর্থন-সহানুভূতি জানাতে এবার রাস্তায় নেমে পড়েছেন বুদ্ধিজীবীরাও।
টেট চাকরি প্রার্থীদের ধর্নামঞ্চ থেকে পুলিশের টেনে হিঁচড়ে তুলে দেওয়ার ঘটনার পর থেকে সরগরম এপার বাংলা। মমতা সরকারকে নজিরবিহীন আক্রমণ করেছেন পরিচালক কমলেশ্বর মুখার্জি। বিশিষ্ট এই পরিচালক বলেন, এই রাজ্যে চোর পুলিশ হাত মিলিয়ে আন্দোলন ভাঙে।
কমলেশ্বর আরও বলেন, পরপর দু’দিন, নির্লজ্জ পুলিশ চোরেদের ক্ষেত্রে আইনের শাসন জারি করতে অপরাগ। চাকুরিপ্রার্থীরা ও প্রতিবাদকারীদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অগণতান্ত্রিকভাবে আঘাত করছে। এর থেকে সরকারের স্বৈরাচারী মনোভাব সুস্পষ্ট। স্বৈরাচার ও মিথ্যাচার দুয়ে মিলে এক অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করেছে পশ্চিমবঙ্গে। একটা ভয়াবহ সংকটের দিকে রাজ্য এগিয়ে চলেছে।
দুর্গাপূজার সময় কলকাতায় সিপিআইএমের বই বিপনী কেন্দ্র ভাঙার জেরে প্রতিবাদ মিছিল থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল পরিচালক কমলেশ্বরকে। কালী পূজা মিটতে না মিটতেই তিনি ফের তৃ়ণমূল কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। কোথাও তিনি লিখছেন, পথে রক্ত, দেওয়াল তবু নীল-সাদায় রাঙে/ চোর পুলিশ হাত মিলিয়ে আন্দোলন ভাঙে। আবার কখনো বলছেন, পুলিশ প্রশাসনকে ধিক্কার।
কমলেশ্বরের পাশাপাশি টলিপাড়ায় বাম-ঘনিষ্ঠ অভিনেত্রী শ্রীলেখা মিত্র সরব হয়েছেন। তিনি আবার আরও একধাপ এগিয়ে রাজ্যের মানুষকে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার ও কন্যাশ্রীর ভিখিরি বলে কটাক্ষ করেছেন।
টেট পাশ চাকরি প্রার্থীদের ধর্না ভাঙতে পুলিশের জবরদস্তির প্রতিবাদে গত শনিবার কলকাতায় বিশিষ্টজনদের সমাবেশ থেকে মমতা সরকারের সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র স্লোগান ওঠে। সমাবেশ থেকে বিশিষ্ট ভাষাবিদ পবিত্র সরকার বলেন, এই নিষ্ঠুরতা শেষ হওয়া দরকার।
শুক্রবার মাঝরাতে সল্টলেক এপিসি ভবনের সামনে আমরণ গণঅনশন ভেঙে দিয়েছিল পুলিশ। চাকরি প্রার্থীদের জোর করে টেনে হিঁচড়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৪৪ ধারা জারি করার নির্দেশ দিতে হয় কলকাতা হাইকোর্টকে। আদালতের নির্দেশ পেতেই তৎপর হয় প্রশাসন। সন্ধ্যে বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই আন্দোলনস্থলে বাড়তে থাকে পুলিশের বহর। এরপর রাত সাড়ে ১২টা নাগাদ শুরু হয় পুলিশের ধরপাকড়। এর প্রতিবাদে আন্দোলনে নামে বাম ছাত্র যুব নেতৃত্ব। তাদের সঙ্গে পুলিশের খণ্ডযুদ্ধ ও ধরপাকড়ে রাজনৈতিক মহল সরগরম।
টেট চাকরি প্রার্থীদের উপর হামলার বিরুদ্ধে মিছিলে শামিল হয়েছিলেন বিশিষ্টজনরা। ছিলেন পবিত্র সরকার, পরিচালক অনীক দত্ত, অভিনেতা রাহুল সরকার, বাদশা মৈত্র, শ্রীলেখা মিত্র, কবি মন্দাক্রান্তা সেনসহ অন্যান্যরা।
পবিত্র সরকার বলেন, অন্যায় করে চাকরি প্রার্থীদের বঞ্চিত করা হয়েছে। কোটি কোটি টাকা নিয়ে অযোগ্যদের চাকরি দেওয়া হয়েছে। সারাদেশ সেটা দেখেছে। চাকরি প্রার্থীরা শান্তিভঙ্গ করেনি। তার মধ্যে অন্ধকারে পুলিশ কাপুরুষের মতো তুলে নিয়ে গেছে। এই নিষ্ঠুরতা শেষ হওয়া দরকার।
অভিনেত্রী শ্রীলেখা বলেন, প্রশাসন যদি না কথা শোনে, পুলিশ যদি না কথা শোনে তাহলে চাকরি চলে যাবে। আগামী দিনে যাতে এই মন্ত্রিসভা যাতে না থাকে সেটাই আমরা চাইব। আগামী দিনে যাতে হকের লড়াই না করতে হয়, সেকারণেই আজ সরব হয়েছি আমরা।
মিছিলে ছিলেন— বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান প্রবীণ বাম রাজনীতিবিদ বিমান বসু, সাবেক বিরোধী দলনেতা কংগ্রেসের আবদুল মান্নান প্রমুখ।
কংগ্রেস নেতা মান্নান বলেন, প্রশাসন যদি পাগল হয়, মানসিক ভারসাম্যহীন হয়, সেখানে আমরা কী আন্দোলন করব? এখন প্রশাসনকে যতদিন না তাড়ানো যায়, যতদিন না মানুষকে বাঁচানো যায়, ততদিন আন্দোলন করতে হবে। মুখ্যমন্ত্রী যেভাবে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কথা বলেন, তা মানসিক ভারসাম্যহীন ছাড়া হয় না।
চাকরি প্রার্থীদের উপর পুলিশের জবরদস্তির ঘটনায় প্রতিবাদ জানিয়ে একটি ডেপুটেশনে সই করেছেন ড. বিনায়ক সেন, অপর্ণা সেন, কুণাল সরকার, বিভাস চক্রবর্তী, সুমন মুখোপাধ্যায়, অনির্বাণ ভট্টাচার্য, কৌশিক সেন, ঋদ্ধি সেন, বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায় রেশমী সেন, বোলান গঙ্গোপাধ্যায় এবং সুজন মুখোপাধ্যায়রা।