পিরান কালিয়ার শরিফ। ভারত বিখ্যাত এক মুসলিম তীর্থস্থান। অতি প্রাচীন এক দরগাহ। অবস্থান হরিদ্বার জেলায়, ‘পিরান কালিয়ার’ বিধান সভার কেন্দ্রের অধীন। এর কাছেই রুরকি নগরী। হিন্দু এবং মুসলমান, উভয় সম্প্রদায়ের কাছে পিরান কালিয়ার দরগাটি এক পবিত্র তীর্থস্থান হিসাবে বিবেচিত।
উত্তর ভারতের হিমালয় পাহাড়ের পাদদেশে হরিদ্বার। উত্তরাখণ্ড রাজ্যে গঙ্গানদীর কিনারে গড়ে ওঠা প্রাচীন হিন্দু তীর্থ ক্ষেত্র। এখান থেকেই শুরু হয় হিমালয় রাজ্যে হিন্দুদের বিশেষ তীর্থ পরিক্রমা। কেদারনাথ, বদরিনাথ, গঙ্গোত্রী, জমুনেত্রি দর্শন। অন্য বহু তীর্থস্থানও আছে। পাহাড়ের মনোরম স্থানে সেগুলির অবস্থান। দর্শন শুরু হয় গঙ্গা তীরের পুন্যতীর্থ হরিদ্বার অতিক্রম করেই। সেই হরিদ্বার জেলারই দক্ষিণ প্রান্তে আবার অবস্থান করে প্রাচীন এক মুসলিম দরগাহ!
তেমন আশ্চর্যের নয়। দেশ ব্যাপী পারস্পরিক শুভেচ্ছা বার্তার নিত্য আদান প্রদান চলে। পিরান কালিয়ার শরিফ তার এক নিদর্শন।
সাধকের সমাধির উপর গড়ে ওঠে দরগাহ। পিরান কালিয়ার দরগাটি তৈরি বিখ্যাত এক সূফী সাধকের সমাধির উপর। সাধকের নাম, হজরত মখদুম আলাউদ্দিন আলি আহমেদ সবির। তাঁর জন্ম মুলতান প্রদেশ, বর্তমান পাকিস্থানে। কালিয়ার শরিফে তাঁর আগমন প্রায় হাজার বছর আগে (১২৫৩)। জীবনের চল্লিশ বছর এখানেই অতিবাহিত করেন তিনি। মৃত্যু হয় ১২৯১ সালে।
দরগার ইতিহাস অতি প্রাচীন। হজরত মখদুম আলাউদ্দিন আলি আহমেদ সবির-এর মাজারের উপর তৈরি হয় দরগাহ। তৈরি করেন তৎকালীন ভারত-সুলতান, ইব্রাহিম লোদি (১৪২১-১৪৮০)। ঐতিহাসিক দরগাটির মাহাত্ম্য আজও অম্লান। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভক্তরা আসেন পিরান কালিয়ার শরিফে। ধুমধামের সঙ্গে রবিউল মাসে (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর) পালিত হয় উরুস উৎসব। সূফী সাধকদের মৃত্যুবার্ষিকী পালনের উৎসব, উরুস।
জায়গাটির অন্য বিশেষত্বও আছে। এখান দিয়েই প্রবাহিত সোলান নদী। এক আশ্চর্য জলপ্রবাহ। নদীটি জলের অভাবে বদ্ধ খালে পরিণত হয়েছিল। গঙ্গার আপার ক্যানেলের সঙ্গে যুক্ত করে এই নদীতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কতিপয় ইঞ্জিনিয়ার। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্রিটিশ আর্মির কোলনেল, পি টি কাটলে (P.T. Cautley)। ১৮৫৪ সালের এই কর্মকাণ্ড এখনও প্রশংসিত। আর ভারতের প্রথম অ্যাকুইডাক্ট (Aqueduct) এটিই। সর্বোপরি, ইটের তৈরি ব্রিজের উপর দিয়ে রেলগাড়ি চলত, রুরকি থেকে পিরান কালিয়ার অবধি। তবে যাত্রীবাহী ট্রেন নয়।
মূলত সেতু তৈরির উপাদান নিয়ে রুরকি থেকে ট্রেন আসত পিরান কালিয়ারে। ভারতে প্রথম যাত্রীবাহী রেলপথ নির্মিত হয়েছিল মুম্বাই থেকে থানে অবধি। তার দু’বছর আগে রেল গাড়ি চলত সিয়ান নদীর উপর দিয়ে। অবশ্য সেটি যাত্রীবাহী নয়, মালগাড়ি।
বিস্ময়কর ইটের তৈরি ব্রিজ। এর নীচ দিয়ে জল বয়ে যায়, উপর দিয়েও। ১৭০ বছর ধরে বয়ে চলেছে জলধারা। রুরকি এবং সংলগ্ন অঞ্চলে জল সরবরাহ করে কৃষি কাজে সহায়তা করে চলেছে। ধান, গম, আখ, ডাল শস্য উৎপন্ন হয় প্রচুর। সমৃদ্ধ জনপদ।
কেন লিখলাম? হরিদ্বারে গাড়োয়াল বিকাশ নিগমের (GMVN) বাংলোয় থাকবার জায়গা পেলাম, তাই ছুটে গেলাম ৬ই অক্টোবর, ২০২২। অজান্তেই পৌঁছে গেলাম উরুস উৎসবের প্রাক্কালে। জানলাম নতুন এক নদীর কথা। দেখলাম প্রাচীন এক দরগাহ। উরুস উৎসবে সেখানে জমায়েত হয়েছেন দেশ বিদেশের বহু ভক্ত।