অন্তঃপুরের মসীকথা: রামী

কৃষ্ণা গুহ রায়
কৃষ্ণা গুহ রায়
5 মিনিটে পড়ুন

নির্জন রাত। শান্ত প্রকৃতি। বাসুলি দেবীর মন্দিরের পুজারি চণ্ডীদাস এক মনে কৃষ্ণের ভজন গেয়ে চলেছেন। গ্রামের কিছু মানুষ তন্ময় হয়ে সেই গান শুনছেন। উদাস প্রকৃতির মানুষ এই চণ্ডীদাস। সংসারি হওয়ার কোনও বাসনা নেই। ছেলেবেলা থেকেই দেবতার প্রতি অসীম ভক্তি আর ঐশ্বর্য বলতে পদ রচনা এবং তাতে সুর দিয়ে কণ্ঠের মায়াজাল সৃষ্টি করা। যে একবার তাঁর গান শোনে সেই মুগ্ধ হয়ে যায়। রাত ক্রমশ বাড়তে থাকে। চণ্ডীদাস গানের মধ্যে একাত্ম হয়ে পড়েন। হঠাৎ নারীকণ্ঠের চাপা কান্নার শব্দে চণ্ডীদাস সুরচ্যুত হলেন। একজন বৃদ্ধ গ্রামবাসী বলে উঠলেন, থামলে কেন? চণ্ডীদাস ইশারায় ব্যাপারটা বোঝালে।— ও তো
রামমনি কাঁদছে৷ আজকে বোধহয় কোথাও খাবার জোটেনি৷
চণ্ডীদাসের মনটা ব্যথায় ভরে উঠল৷ সকলকে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন, আমরা গ্রামের এতগুলো মানুষ থাকতে একটা মানুষ এ রকম উপোস করে থাকবে! আমরা কি ওর জন্য কোনও ব্যবস্থাই করতে পারব না?
ও তো ধোপানি। নিচু জাত। আচ্ছা, ওকে যদি মন্দির পরিষ্কারের কাজে রাখা যায় তবে কেমন হয়?
সবাই একসঙ্গে বলে উঠল, তবে তো খুব ভাল হয়। চণ্ডীদাস খুব খুশি হলেন। মনে মনে বললেন, ভালই হল। সারাদিন মায়ের সেবা করবেন আর মায়ের ভোগে ওর ক্ষুন্নিবৃত্তি হবে।
পর দিন প্রত্যুষে সূর্য উদয় হওয়া মাত্র রামমনি তথা রামী মন্দিরে এসে উপস্থিত হল। চণ্ডীদাস তখন সবেমাত্র মন্দিরের দরজা খুলেছেন। রামীকে দেখে তাঁর মুখে হাসি ফুটে উঠল— তুমি রামী?
যুবক চণ্ডীদাসকে দেখে লজ্জায় চতুর্দশী রামীর মুখ রক্তিম হয়ে উঠল।
চণ্ডীদাস বললেন, আজ থেকে তুমি মন্দিরের সব কাজকর্ম করবে। মন্দির চত্বর এমন ভাবে পরিষ্কার রাখবে, যেন সেখানে বিন্দুমাত্র ধুলো না জমে। ভোগান্ন গ্রহণ করবে। এখানে তোমার আহারের কোনও অভাব হবে না। মায়ের কাছে সব সন্তানই সমান৷ মা তাঁর কোনও সন্তানের কষ্ট দেখতে পারেন না। মা আমার বরাভয় দাত্রী।
চণ্ডীদাসের এমন কোমল ব্যবহারে রামীর অন্তর খুশিতে ভরে উঠল। রামী মন্দির পরিচর্যার কাজে নেমে পড়ল। ধীরে ধীরে এ ভাবে সময় অতিক্রান্ত হতে থাকল। রামমনি এখন অষ্টাদশী। বাসুলি দেবীর কৃপায় রামীর এখন অন্ন-বস্ত্রের অভাব ঘুচেছে। রামীর কাজে গ্রামের সকলেই খুব সন্তুষ্ট। তার কর্মদক্ষতা তাকে সকলের কাছে আরও গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। চণ্ডীদাস মায়ের সেবা করেন আর অবসর সময়ে পদ রচনা করেন। চণ্ডীদাসের সান্নিধ্যে রামীও তত দিনে পদ রচনা করতে শিখে গেছে।
‘তুমি যে আমার আমি যে তোমার / সুহ্যদ কে আছে আর / খেদে রামী কয় /
প্রাণনাথ বিনা জগত দেখি আঁধার।’
কিন্তু তত দিনে পারস্পরিক সুর আদান প্রদানের মধ্যে দিয়ে রামীর সঙ্গে চণ্ডীদাসের কাম গন্ধহীন প্রেমের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। সমাজ তাদের এই প্রেমকে সুনজরে দেখল না। তাদের প্রেম কলঙ্কময়— এই আখ্যা দিয়ে তাদেরকে সমাজচ্যুত করল। কলঙ্কিতা রামী ওই মন্দির থেকে বিতারিত হয়ে চণ্ডীদাসকে জানালেন, ‘
“কি কহিব ও বঁধূ হে বলিতে না ফুরায়,
কাঁদিয়া কহিতে পোড়া মুখে হাসি পায়।
অনামুখো মিনসেগুলোর কিবা বুকের পাটা,
দেবী পূজা বন্ধ করে কূলে দেয় কাটা।
দুঃখের কথা কইতে গেলে প্রাণ কাঁদে উঠে,
মুখ ফোটে না বলতে পারি মরি বুক ফেটে।
ঢাক পিটিয়ে অপবাদ গ্রামে গ্রামে দেয় হে।
চক্ষে না দেখিয়ে মিছে কলঙ্ক রটায় হে।।
ঢাক ঢোলে যে জন সুজন নিন্দা করে।
ঝঞ্ঝনা পড়ুক তার মাথার উপরে।।
অবিচার পুরি দেশে আর না রহিব।
যে দেশে পাষণ্ড নাই সেই দেশে যাব।।
বাশুলী দেবীর যদি কৃপা দৃষ্টি হয়।
মিছে কথা সেঁচা জল কতক্ষণ রয়।।
আপনার নাক কাটি পরে বলে বোঁচা।
সে ভয় করে না রামী নিজে আছে সাঁচা।।

——-পদ সমুদ্র।

এরপরে চণ্ডীদাস গ্রাম ছেড়ে রামীকে সঙ্গে নিয়ে গৌড়ের পথে রওনা দেন৷
গৌড়ের নবাব চণ্ডীদাসকে রাজসভায় গান গাইবার অনুরোধ করেন৷ চিকের আড়ালে বসে চণ্ডীদাসের গান শুনে বেগম চণ্ডীদাসের গুণমুগ্ধ হয়ে তাঁর অনুরাগিণী হয়ে পড়েন৷ নবাবের কাছে এসে সে কথা স্বীকার করতে তাঁর কোনও রকম কুণ্ঠাবোধও হয় না৷ নবাব সে কথা শুনে প্রচন্ড রেগে ওঠেন৷ তখন তিনি আদেশ দেন হাতির পিঠে চণ্ডীদাসকে বেঁধে কশাঘাত করার৷ এই নিদারুণ কশাঘাতে চণ্ডীদাসের মৃত্যু হয়৷

রামীর রচিত একটি গীতিকা ” সাহিত্য পরিষদের” পুস্তকাগারে সংরক্ষিত করা আছে।

রামীর রচিত অন্য দুটি পদ

১/ কোথা যাও ওহে, প্রাণ বঁধু মোর, দাসীরে উপেক্ষা করি।
না দেখিয়া মুখ,ফাটে মোর বুক, ধৈরয ধরিতে নারি। বাল্যকাল হ’তে, এ দেহ সঁপিনু, মনে আন নাহি মানি। কি দোষ পাইয়া, মথুরা যাইবে, বল হে সে কথা শুনি।। তোমার এ সারথি, ক্রূর অতিশয়, বোধ বিচার নাই। বোধ থাকিলে, দুঃখ সিন্ধু নীরে, অবলা ভাসাতে নাই। পিরীতি জ্বালিয়া, যদিবা যাইবা, কবে বা আসিবে নাথ।
রামীর বচন, করহ পালন, দাসীরে করহ সাথ।।

- বিজ্ঞাপন -

২/ তুমি দিবাভাগে, লীলা অনুরাগে, ভ্রম সদা বনে বনে।
তাহে তব মুখ, না দেখিয়া দুঃখ, পাই বহু ক্ষণে ক্ষণে।।
ত্রুটী সমকাল, মানি সুজঞ্জাল, যুগ তুল‍্য হয় জ্ঞান।
তোমার বিরহে, মন স্থির নহে,ব্যাকুলিত হয় প্রাণ।
কুটিল কুন্তল, কত সুনির্মল শ্রী মুখ মণ্ডল শোভা
হেরি হয় মনে, এ দুই নয়নে, নিষেধ দিয়াছে কেবা।

রামীর পদাবলী রচনার মধ্য দিয়েই বাংলা কাব‍্যের সাহিত্যাকাশে প্রথম মহিলা কবির আবির্ভাব ঘটল৷#

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
নিবাস -পশ্চিমবঙ্গ, ভারত ৷ সন্দেশ, নবকল্লোল, শুকতারা, বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়েছে৷ কবিতা সঙ্কলন তিনটি, তার মধ্যে একটি বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে৷ বর্তমানে আমেরিকা, অষ্ট্রেলিয়া, কানাডা , বাংলাদেশ এবং ভারতের বিভিন্ন ওয়েবজিনে লেখার সঙ্গে যুক্ত৷ কলকাতা স্বপ্নরাগ পরিবার নামে একটি সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজ সেবা মূলক প্রতিষ্ঠানের সম্পাদক৷
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

একটি অ্যাকাউন্ট নেই? নিবন্ধন করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!