আমরা বাঙালিরা রাখীবন্ধন উৎসবকে কেবলই ভাই বোনের মধ্যে আবদ্ধ রাখিনি। ধর্মীয় রাজনৈতিক গন্ডি পেরিয়ে, রাখীকে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে জায়গা দিয়েছে বাঙালিই। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে, বাংলায় রাখি বন্ধন প্রবর্তন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুন। উনিশ শতকে আমাদের বাংলায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন চরম পর্যায়ে ছিল। যা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কাছে অপরিমিত ভয়ের কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। এই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দমন করার জন্য ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নেয় তারা বাংলাকে দুই ভাগে ভাগ করবে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করতে রাখিকে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এই বছরের ২০ জুলাই সরকার বঙ্গভঙ্গের কথা ঘোষণা করেন। জানানো হয় এই আইন কার্যকর হবে ১৯০৫ এর ১৬ অক্টোবর, বাংলায় ৩০ আশ্বিন। সেই সময় জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতায় মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে শামিল হয়। ঠিক হয় ওই দিনে বাংলায় মানুষ পরস্পরের হাতে বেঁধে দেবেন হলুদ সুতলি। এই দিনকে মিলন দিবস রূপে পালন করা হয়। এ ধর্মের মানুষ ভালোবেসে জড়িয়ে ধরে হাতে রাখি পরিয়ে দিচ্ছে যার হাতে তার ধর্ম আলাদা। হাতে হাত রেখে, সাম্য, ঐক্য, সম্প্রীতির আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে, অদম্য মনোবল ও মানসিকতায় সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অভিমুখী ছুঁড়ে দেওয়া হলো প্রতীকী তীব্র প্রতিবাদ। একটা মানুষের ডাকেই ধর্ম নির্বিশেষে সারা বাংলা এক সূত্রে আবদ্ধ হয়েছিল সেদিন। প্রতিবাদের ভাষা চরিত্র বদলেছে ক্রমশ। ভাইসরয় লর্ড কার্জন বা ব্রিটিশ সরকার ভাবতেই পারেনি গণআন্দোলন এত সুদুরপ্রসারী হবে। দীর্ঘ প্রতিবাদ প্রতিরোধে শেষ পর্যন্ত ইংরেজ সরকার বঙ্গভঙ্গ রদ করেন। দীর্ঘ ৬ বছর পর ১৯১১ সালে ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ রদ করেন বাংলা ভাগের প্রস্তাব। বাংলা আবার একত্রিত হয়। কবিগুরু এই দিনটিকে রাখি বন্ধন উৎসব পালন করার ডাক দেন। বাংলায় হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে সম্প্রীতি ও সৌভ্রাতৃত্বকে ফুটিয়ে তুলতে ও পুনঃজাগ্রত করতে এই উদ্যোগ নেন রবীন্দ্রনাথ কিন্তু সেই রাখি বন্ধন উৎসব শ্রাবণ মাসে বা পূর্ণিমা কোনোটাতেই হয়নি। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে প্রত্যক্ষ অংশ নিয়ে বিজয় সম্মেলন নামক এক ভাষণও রবীন্দ্রনাথ দিয়েছিলেন। কলকাতার উপকণ্ঠে প্রখ্যাত নাখোদা মসজিদের উপস্থিত হয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ মসজিদের মুসল্লিদের হাতে রাখি বেঁধে দেন। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের ব্যাপকতায় ব্রিটিশ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনের পথ উন্মুক্ত করে। শুধু বোনেরা নয় এই দিন প্রত্যেক মানুষের মধ্যে একতাই ছিল রাখি বন্ধনের মূল বিষয়। এই রাখি বন্ধন উৎসবে সম্প্রীতি যেভাবে জায়গা করে নিয়েছিল তা আজকের দিনে ও প্রাসঙ্গিক ও অতীব গুরুত্বপূর্ণ। রবীন্দ্রনাথ এই রাখি বন্ধন উৎসব নিয়ে এই গান লিখেছিলেন- “বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার ফল। পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক, হে ভগবান।” মূল উদ্দেশ্যই ছিল মানবিকতা, সম্প্রীতি ও একতা। সে দিক থেকে বিচার করে বলতে গেলে রাখি বন্ধন একটি ধর্মনিরপেক্ষ মিলনোৎসব। এই রাখি বন্ধন উৎসব মূলত ভাই বোনের বন্ধন ও ভালোবাসার সম্পর্ককে উৎসাহিত, পুন জাগ্রত করার উৎসব। এই দিনটি একে অপরের প্রতি আরও দায়বদ্ধ হওয়ার দিন। এমনিতেই সোশ্যাল মিডিয়ার দাপটে রাখি এখন অনেকটা কোণঠাসা। কিন্তু তবু রাখির একটা গুরুত্ব আছে। রাখির সাথে সম্পৃক্ত ও পরতে পরতে জুড়ে আছে আবেগ, ভালোবাসা। এই পৃথিবীর সমস্ত কিছুই একে অপরের সঙ্গে এক নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ। উৎসবের মূলমন্ত্র হল মিলনের মন্ত্র, ঐক্যের, সম্প্রীতির সুর।
বর্তমানে দেশ ভক্তির নামে যেভাবে উগ্র জাতীয়তাবাদী শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে সম্প্রীতির চিরায়ত বুনোটকে ক্ষতবিক্ষত করে চলেছে, কায়েমী স্বার্থে পূরণে বিভাজন ও সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিচ্ছে, প্রতিনিয়ত মানবতা, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, সৌজন্যবোধকে গলা টিপে ধরছে, তৎসহ করোনা বিবিধ সংকটে মানবতা চরমভাবে বিপর্যস্ত, বিধ্বস্ত, ঠিক সেই বাস্তবিক প্রেক্ষাপটেই আমাদের প্রত্যেকের কাছেই একমাত্র মহামিলনের বার্তা, শাশ্বত বাণী নিয়ে আসতে পারে এই সম্প্রীতির রাখি বন্ধন উৎসব। এই নিদারুণ সংকটকালে আমরা সবাই পারস্পরিক দূরত্ব, স্বাস্থ্যবিধি, বিধি নিষেধ, প্রশাসনিক রীতিনীতি ও মুখাবরণ পরে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সম্প্রীতির চিরায়ত স্রোতে ভেসে গিয়ে এই রাখি বন্ধন উৎসব পালন করি এবং তার আবহমান আদর্শকে মননে স্মরণ করি। সম্প্রীতির রাখি বন্ধনের মধ্যে দিয়ে আমাদের মধ্যে সমস্ত মলিনতা বিষন্নতা সাম্প্রদায়িকতা জাতিবিদ্বেষ বর্ণ বৈষম্য ভেদাভেদ দূর করে বাঙালি চেতনায় বাঙালি এক অখন্ড বাঙালিত্ব ।তবেই এই মহামিলনের বঙ্গ ভঙ্গ বিরোধী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রবর্তিত সম্প্রীতির রাখি উৎসব হয়ে উঠবে পরিপূর্ণ প্রাসঙ্গিক, চিরন্তন, শাশ্বত এবং সময়োপযোগী।