নতুন জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে ঘরছাড়া তরুণের সংখ্যা বাড়ছে। হিজরতের নামে নিরুদ্দেশ থাকা আরও ৫৫ জনের বিষয়ে তথ্য পাওয়ার কথা জানিয়েছে র্যাব। তাঁদের মধ্যে ৩৮ জনের পূর্ণাঙ্গ নাম–ঠিকানা প্রকাশ করা হয়েছে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন গতকাল সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে এ তালিকা প্রকাশ করেন। তিনি জানান, এসব তরুণ পার্বত্য এলাকার দুর্গম অঞ্চলে পাহাড়ি বিচ্ছিন্ন সংগঠনের ছত্রচ্ছায়ায় প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে পার্বত্য অঞ্চলে বিভিন্ন বাহিনীর সমন্বয়ে অভিযান চলছে।
তবে সংশ্লিষ্ট একটি গোয়েন্দা সূত্র বলছে, পাহাড়ি যে সশস্ত্র গোষ্ঠীর ক্যাম্প বা আস্তানায় জঙ্গিরা প্রশিক্ষণ নিচ্ছে, সেখানে অভিযানের বিষয়টি আঁচ করতে পেরে তারা সরে যাওয়ার চেষ্টা করছে। তারা মিজোরাম সীমান্তের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারে—এই আশঙ্কায় ওই সীমান্তবর্তী এলাকায় গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
জঙ্গিবাদে জড়িয়ে বাড়ি ছেড়ে যাওয়া তরুণদের মধ্যে আরও তিনজনকে র্যাব গ্রেপ্তার করেছে। তাঁরা হলেন পুরান ঢাকার সূত্রাপুরের রাকিব হাসনাত ওরফে সুমন (২৮), পটুয়াখালীর কুয়াকাটার মো. হোসাইন (২২) ও নোয়াখালীর মো. সাইফুল ইসলাম। একই সঙ্গে তরুণদের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধকরণে যুক্ত দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁরা হলেন শাহ মো. হাবিবুল্লাহ হাবিব (৩২) ও নেয়ামত উল্লাহ (৪৩)। র্যাব বলছে, গত রোববার রাজধানীর যাত্রাবাড়ী ও কেরানীগঞ্জ এলাকা থেকে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ২৩ আগস্ট কুমিল্লা থেকে আট কলেজছাত্র নিখোঁজ হন। কিছুদিন পর তাঁদের একজন ফিরে এলে এই তরুণদের জঙ্গিবাদে জড়িয়ে ‘হিজরতের’ নামে ঘরছাড়ার বিষয়টি জানাজানি হয়। এর কদিন পর কুমিল্লা শহরের কুবা মসজিদের ইমাম শাহ মো. হাবিবুল্লাহ আত্মগোপনে চলে যান।
এরপর ৫ অক্টোবর সাতজনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। তাঁদের মধ্যে কুমিল্লার দুজনসহ নিখোঁজ চার তরুণ ছিলেন। বাকি তিনজন জঙ্গি সংগঠক ও আশ্রয়দাতা। ৬ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলন করে র্যাব জানায়, এঁরা নতুন জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। এই সংগঠনের নাম জামাতুল আনসার ফিল হিন্দিল শারক্বীয়া (যার বাংলা অর্থ: পূর্ববর্তী হিন্দের সাহায্যকারী দল)।
র্যাব বলেছে, গ্রেপ্তার হাবিবুল্লাহ কুমিল্লার কুবা মসজিদে নামাজ পড়াতেন। এ ছাড়া তিনি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতেন। তিনি ২০২০ সালে নেয়ামত উল্লাহর মাধ্যমে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ সংগঠনটিতে যুক্ত হন। তাঁর নেতৃত্বে কুমিল্লা অঞ্চলে দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালিত হতো। তিনি সংগঠনের জন্য বিভিন্নভাবে অর্থ সংগ্রহ করতেন ও উগ্রবাদী কার্যক্রমে অর্থ সরবরাহ করতেন। পার্বত্য অঞ্চলের নাইক্ষ্যংছড়িতে তিনি প্রায় দুই বছর ধরে একটি মাদ্রাসা পরিচালনা করছেন। তিনি পাহাড়ের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ছাত্র সংগ্রহ করে তাঁর মাদ্রাসায় রাখতেন। তিনি এ পর্যন্ত ১৫ থেকে ২০ জন সদস্য সংগ্রহ ও প্রশিক্ষণে পাঠিয়েছেন।
গ্রেপ্তার নেয়ামত উল্লাহ কুমিল্লার একটি মহিলা মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতেন। তিনি ২০১৯ সালে নতুন জঙ্গি সংগঠনে যুক্ত হন। তিনি সংগঠনের দাওয়াতি কার্যক্রমে যুক্ত থাকার পাশাপাশি নিরুদ্দেশ হওয়া তরুণদের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বেও জড়িত ছিলেন। বাড়ি ছেড়ে যাওয়া সদস্যদের তিনি বিভিন্ন পর্যায়ে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতেন।
র্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘আমরা এখন পর্যন্ত ৫০ জনের বেশি তরুণের বিষয়ে তথ্য পেয়েছি, যাঁরা দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে নিরুদ্দেশ হয়েছেন। তাঁরা গত দুই বছরে নিরুদ্দেশ হয়েছেন। সর্বশেষ দেড় মাস আগে কুমিল্লা থেকে সাত তরুণ নিরুদ্দেশ হন।’
সংবাদ সম্মেলনে নিরুদ্দেশ হওয়া তরুণদের জেলাভিত্তিক যে হিসাব দেওয়া হয়। তাতে দেখা যায়, ১৯ জেলা থেকে ৫৫ জন ঘর ছেড়েছেন। তাঁদের মধ্যে ৩৮ জনের নাম-ঠিকানা প্রকাশ করেছে র্যাব। এর মধ্যে দুই দফায় গ্রেপ্তার ১২ জন এই তালিকার বাইরে।
র্যাবের মুখপাত্র বলেন, ‘কোন জেলা থেকে কতজন নিরুদ্দেশ হয়েছেন, সেই তালিকা আমাদের কাছে আছে। তাঁদের কারও কারও পরিবার জানে, সন্তান বিদেশে গেছেন, তাঁরা মাঝেমধ্যে অর্থ পাঠান। কিন্তু আসলে তাঁরা জঙ্গি সংগঠনে যুক্ত হয়ে ঘর ছেড়েছেন।’
নতুন জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের পার্বত্য এলাকায় পাহাড়ি বিচ্ছিন্ন সংগঠনের ছত্রচ্ছায়ায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে বলে জানান কমান্ডার আল মঈন। তিনি বলেন, ‘সেখানে তাঁদের বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নেওয়ার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
তাঁদের নাশকতার কী পরিকল্পনা, তা জানতে অপেক্ষা করতে হবে। পার্বত্য অঞ্চলে বিভিন্ন বাহিনীর সমন্বয়ে সমন্বিত অভিযান চলছে। আরও গ্রেপ্তার হলে তারপর তাঁদের পরিকল্পনার বিষয়ে বলা যাবে।’
(সূত্র: প্রথম আলো)