ইরানে পুলিশের হেফাজতে কুর্দি তরুণী মাহসা আমিনির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীদের তোপের মুখে পড়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শনিবার তেহরানের আলজাহরা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে যান ইব্রাহিম রাইসি। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীরা তাকে দেখে বিক্ষোভ শুরু করেন। ছাত্রীরা ‘গেট লস্ট’ বলে স্লোগান দিতে থাকে।
একজন বিক্ষোভকারী টুইটারে একটি ভিডিও পোস্ট করেছেন। তাতে দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীরা প্রেসিডেন্টের উদ্দেশে বলছেন, ‘রাইসি গেট লস্ট’, ‘মোল্লাস গেট লস্ট’।
রাইসি একটি কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে বিক্ষোভকারীদের ‘মাছির’ সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘তারা মনে করছে, তারা তাদের খারাপ উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারবে। কিন্তু তাদের অজান্তেই আমাদের ছাত্র এবং শিক্ষকরা সতর্ক রয়েছেন। শত্রুকে তাদের খারাপ উদ্দেশ্য পূরণ করতে দেবেন না তারা।’
ইরানে ‘সঠিকভাবে’ হিজাব না করার অভিযোগে গ্রেপ্তারের পর পুলিশি হেফাজতে মারা যাওয়া মাহসা আমিনি এখন গোটা ইরানে নারীর পোশাকের স্বাধীনতার আন্দোলনের প্রতীকে পরিণত হয়েছেন।
কুর্দি নারী মাহসাকে গত ১৩ সেপ্টেম্বর তেহরানের ‘নৈতিকতা পুলিশ’ গ্রেপ্তার করে। ইরানের পশ্চিমাঞ্চল থেকে তেহরানে ঘুরতে আসা মাহসাকে একটি মেট্রো স্টেশন থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
পুলিশ হেফাজতে থাকার সময়ে মাহসা অসুস্থ হয়ে পড়েন, এরপর তিনি কোমায় চলে যান। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ১৬ সেপ্টেম্বর তার মৃত্যু হয়। এরপর থেকে ইরানজুড়ে হিজাববিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়।
তার পরিবার ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন শুরু থেকেই দাবি করছে, গ্রেপ্তারের সময় মাহসার মাথা ও শরীরের বিভিন্ন অংশে লাঠির আঘাত করে পুলিশ। এ কারণেই পরে তিনি চেতনা হারিয়ে কোমায় চলে যান।
তবে ইরান সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, মাহসার মৃত্যুর কারণ ‘অসুস্থতাজনিত’।
এদিকে দেশটির ফরেনসিক চিকিৎসকদের সংগঠন শুক্রবার এক বিবৃতিতে দাবি করে মাহসা আমিনির মৃত্যুর কারণ আঘাতজনিত নয়, বরং বিশেষ কোনো শারীরিক অসুস্থতায় তিনি মারা যান। তবে ওই বিবৃতিতে মাহসাকে আঘাতের তথ্য অস্বীকার করা হয়নি।
মাহসার মৃত্যুর প্রতিবাদে ইরানব্যাপী বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে, যা ইরানের ধর্মগুরুদের কাছে কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবাদকারীরা ১৯৭৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ইসলামী প্রজাতন্ত্রের পতনের আহ্বান জানায়।
বিক্ষোভকারীরা দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির পতনেরও আহ্বান জানিয়েছে।
ইরানের মানবাধিকার গ্রুপ হেনগাও জানিয়েছে, কুর্দি শহর সাকেজ, দিওয়ান্ডারেহ, মাহাবাদ ও সানন্দাজ শহরে ব্যাপক বিক্ষোভ চলছে।
গণবিক্ষোভের ডাক দেয়ার পর শনিবার নিরাপত্তা বাহিনী বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালায়। সানন্দাজ এবং সাকেজে বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে কাঁদানে গ্যাস ছুড়েছে পুলিশ। সানন্দাজে গাড়িতে এক ব্যক্তির মরদেহ পড়ে থাকতে দেখা গেছে। সাকেজে স্কুলছাত্রীদের ‘নারী, জীবন ও স্বাধীনতা’ বলে স্লোগান দিতেও দেখা গেছে।
তেহরানে বিক্ষোভে যোগ দিতে যাওয়ার পথে এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বলেছেন, তিনি গ্রেপ্তার বা নিহত হওয়ায় ভয় পান না।
তিনি বলেন, ‘তারা আমাদের হত্যা করতে পারে, গ্রেপ্তার করতে পারে, কিন্তু আমরা আর চুপ থাকব না। আমাদের সহপাঠীরা জেলে। আমরা কীভাবে নীরব থাকতে পারি।’
মাহসার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আন্দোলনে উত্তাল ইরানে এখন পর্যন্ত নারী-শিশুসহ অন্তত ১৫৪ বিক্ষোভকারী প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন শতাধিক। এ পর্যন্ত হাজারের বেশি বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ১৯৯৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর জন্ম নেয়া মাহসার পুরো নাম জিনা মাহসা আমিনি।
ইরান সরকারের অভিযোগ, মাহসা কুর্দি বিদ্রোহী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তবে এ অভিযোগকে সরকারের প্রোপাগান্ডা হিসেবে দাবি করেছে তার পরিবার।
তবে মাহসা কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন না বলে জানিয়েছেন তার চাচাতো ভাই এরফান মোর্তেজা।
ইরানে ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পরই নারীদের জন্য হিজাব বাধ্যতামূলক করা হয়। ইরানের ধর্মীয় শাসকদের কাছে নারীদের জন্য এটি ‘অতিক্রম-অযোগ্য সীমারেখা’। বাধ্যতামূলক এই পোশাকবিধি মুসলিম নারীসহ ইরানের সব জাতিগোষ্ঠী ও ধর্মের নারীদের জন্য প্রযোজ্য।
এই পোশাকবিধি অনুযায়ী নারীদের জনসমক্ষে চুল সম্পূর্ণভাবে ঢেকে রাখতে হয় এবং লম্বা, ঢিলেঢালা পোশাক পরতে হয়।
হিজাব আইন আরও কঠোরভাবে প্রয়োগের জন্য চলতি বছরের ৫ জুলাই ইরানের প্রেসিডেন্ট একটি আদেশ জারি করেন। এর মাধ্যমে ‘সঠিক নিয়মে’ পোশাকবিধি অনুসরণ না করা নারীদের সরকারি সব অফিস, ব্যাংক এবং গণপরিবহনে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।