ইরানে চলমান বিক্ষোভে এক দিনেই ৪০ জনের বেশি প্রাণ হারিয়েছেন। ফলে পুলিশি হেফাজতে কুর্দি তরুণী মাহসা আমিনির মৃত্যুর পর ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে দেশজুড়ে চলমান বিক্ষোভে নিহতের সংখ্যা বেড়ে হলো ১৩৩ জন।
প্রতিবাদকারীদের দমনে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগের পথ বেছে নিয়েছে নিরাপত্তা বাহিনী। ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ ব্লকসহ ইন্টারনেটে ব্যাপক বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। তবে এর পরও থামছে না বিক্ষোভ-সহিংসতা।
দেশটির সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ হিসেবে পরিচিত তেহরানের শরিফ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরাও প্রতিবাদে যোগ দিয়েছেন। তাদের দমনে ক্যাম্পাসে তাণ্ডব চালানোর অভিযোগ উঠেছে নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন ভিডিওতে রোববার শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে নিরাপত্তা বাহিনীকে গুলি ও টিয়ার সেল ছুড়তে দেখা গেছে।
মাহসার মৃত্যুর পর এক দিনে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটে গত শুক্রবার। অসলোভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন ইরান হিউম্যান রাইটসের (আইএইচআর) তথ্য অনুযায়ী, দেশটির সিস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশের জাহেদান শহরে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে ওই দিন ৪০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হন।
এ ঘটনাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন আইএইচআরের পরিচালক মাহমুদ আমিরি-মোগাদ্দাম। তিনি বলেন, ‘ইরানে, বিশেষ করে জাহেদানে বিক্ষোভকারীদের হত্যা একটি মানবতাবিরোধী অপরাধের সমান। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত এটিসহ ইরানের সম্প্রতি অন্য অপরাধগুলোর তদন্ত করা।’
ইরানে এক দিনেই নিহত ৪১, তেহরানে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তাণ্ডব
নারীর পোশাকের স্বাধীনতার দাবিতে উত্তাল ইরান
মাহসা আমিনির মুত্যুর পাশাপাশি চাবাহার শহরে পুলিশ কর্মকর্তার হাতে এক কিশোরী ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে জাহেদানে শুক্রবার জুমার নামাজের পর শুরু হয় বিক্ষোভ। এতে নিরাপত্তা বাহিনী গুলি চালালে বহু মানুষ হতাহত হন। বেলুচ অ্যাক্টিভিস্ট ক্যাম্পেইন সেদিন নিহত ৪১ জনের নাম প্রকাশ করে।
তবে সিস্তান-বেলুচিস্তানের গভর্নরের দাবি, জাহেদানে ১৯ জন নিহত এবং ২০ জন আহত হয়েছেন।
জাহেদানে বিক্ষোভের সময় সিস্তান-বেলুচিস্তানে ইসলামি বিপ্লবি গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) গোয়েন্দা প্রধান আলী মুসাভিও গুলিবিদ্ধ হন। পরে হাসপাতালে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
অন্যদিকে মাহসা আমিনির মৃত্যুর ঘটনায় ইরানের অন্যান্য এলাকায় চলমান বিক্ষোভ ও সহিংসতায় অন্তত ৯২ জন নিহত হয়েছেন বলে দাবি করেছে মানবাধিকার সংগঠন আইএইচআর। সংস্থাটির হিসাবে ১৮ দিনের টানা বিক্ষোভে সব মিলিয়ে প্রাণহানির সংখ্যা ১৩৩।
নিরাপত্তা বাহিনীকে শক্তি প্রয়োগের সর্বোচ্চ ক্ষমতা দেয়া হলেও বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ছে দেশজুড়ে।
ইরানে এক দিনেই নিহত ৪১, তেহরানে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তাণ্ডব
তেহরানের শরিফ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রোববার বিক্ষোভে হামলা চালায় নিরাপত্তা বাহিনী
রাজধানী তেহরানের শরিফ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রোববার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় নিরাপত্তা বাহিনী। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, গুলির মুখে শিক্ষার্থীরা নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে ছুটছেন। আরেক ভিডিওতে মোটরসাইকেল আরোহী নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের একটি গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে দেখা গেছে। ওই গাড়ির আরোহী তার মোবাইল ফোনে ভিডিও ধারণ করছিলেন।
নিরাপত্তা বাহিনী শিক্ষার্থীদের অবস্থানের পাশাপাশি ছাত্রাবাস লক্ষ্য করে গুলি চালায় বলেও অভিযোগ উঠেছে।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, বিক্ষোভ দমনে নিরাপত্তা বাহিনী সরাসরি গুলি করছে, যা আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট ও চরম লঙ্ঘন।
মাহসার মৃত্যুর পর শুরু হওয়া বিক্ষোভ এরই মধ্যে দেশটির প্রায় সব শহরে ছড়িয়ে গেছে।
পোশাকের স্বাধীনতার দাবিতে বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারীদের ‘ইসরায়েলের সেনা’ হিসেবে অবিহিত করছে সরকার ও হিজাবপন্থিরা। এরই মধ্যে তারাও বিক্ষোভ করেছে এবং সেই বিক্ষোভ সরাসরি সম্প্রচার করা হয় ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে।
কুর্দি নারী মাহসা আমিনিকে গত ১৩ সেপ্টেম্বর তেহরানের ‘নৈতিকতা পুলিশ’ গ্রেপ্তার করে। ইরানের দক্ষিণাঞ্চল থেকে তেহরানে ঘুরতে আসা মাহসাকে একটি মেট্রো স্টেশন থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি সঠিকভাবে হিজাব করেননি।
পুলিশ হেফাজতে থাকার সময়েই মাহসা অসুস্থ হয়ে পড়েন, এরপর তিনি কোমায় চলে যান। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ১৬ সেপ্টেম্বর তার মৃত্যু হয়। পুলিশ মাহসাকে হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করলেও পরিবারের অভিযোগ গ্রেপ্তারের পর তাকে পেটানো হয়।
মাহসার মৃত্যুর পর রাস্তায় বিক্ষোভের পাশাপাশি ফেসবুক ও টুইটারে #mahsaamini এবং #Mahsa_Amini হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে চলছে প্রতিবাদ।
ইরানে ১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের পরই নারীদের জন্য হিজাব বাধ্যতামূলক করা হয়। দেশটির ধর্মীয় শাসকদের কাছে নারীদের জন্য এটি ‘অতিক্রম-অযোগ্য সীমারেখা’। বাধ্যতামূলক এই পোশাকবিধি মুসলিম নারীসহ ইরানের সব জাতিগোষ্ঠী ও ধর্মের নারীদের জন্য প্রযোজ্য।
হিজাব আইন আরও কঠোরভাবে প্রয়োগের জন্য চলতি বছরের ৫ জুলাই ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি একটি আদেশ জারি করেন। এর মাধ্যমে ‘সঠিক নিয়মে’ পোশাকবিধি অনুসরণ না করা নারীদের সরকারি সব অফিস, ব্যাংক এবং গণপরিবহনে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এ ঘটনায় গত জুলাইয়েও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে #no2hijab হ্যাশট্যাগ দিয়ে শুরু হয় প্রতিবাদ। দেশটির নারী অধিকারকর্মীরা ১২ জুলাই সরকারঘোষিত জাতীয় হিজাব ও সতীত্ব দিবসে প্রকাশ্যে তাদের বোরকা ও হিজাব সরানোর ভিডিও পোস্ট করেন।