সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ইসলাম ধর্মের অবমাননার অভিযোগে বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার রামু ও উখিয়ার বৌদ্ধ পল্লীতে হামলার এক দশক পূর্ণ হয়েছে। ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতের অন্ধকারে রামু, উখিয়া ও টেকনাফে বৌদ্ধ পল্লীতে এ হামলা এবং অগ্নিসংযোগ চালানো হয়। এ সময় ১৩টি বৌদ্ধ বিহার ও ৩০টি বসতবাড়ি ভাঙচুর এবং লুটপাট করা হয়।
সেই ঘটনার পর পুলিশ বাদী হয়ে এজাহারভুক্ত ৩৭৫ জন এবং অজ্ঞাত আরও ১৫-১৬ হাজারজনকে আসামি করে ১৮টি মামলা দায়ের করে। পরবর্তীতে এসব মামলায় প্রায় এক হাজারেরও বেশি মানুষকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। কিন্তু ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও সাক্ষীর অভাবে এখনও এসব মামলার বিচারকাজ আজও শেষ হয়নি।
এ অবস্থায় বিচার নিয়ে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নেতারা হতাশা প্রকাশ করেছেন। তারা জানান, বিচারের নামে এখন কোনো নিরাপরাধ ব্যক্তি হয়রানির শিকার হোক, সেটি তারা চান না। তারা শান্তি ও সম্প্রীতি চান।
১০ বছর আগে স্থানীয় এক যুবকের ফেসবুক আইডি থেকে ধর্ম অবমাননাকর ছবি পোস্ট করার অভিযোগে ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাত ২টার দিকে কয়েকশ লোক লাঠিসোঁটা, দা ও কিরিচ নিয়ে বিহারে হামলা চালায়। সেই সঙ্গে বিহারে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়।
তবে যার ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে এই ঘটনা ঘটে, ১০ বছর ধরে সেই স্থানীয় যুবকের খোঁজ জানেন না বাবা-মা। এমনকি ওই যুবক স্ত্রী-সন্তান নিয়ে কোথায় আছেন, সেই ব্যাপারেও কিছু পারেননি পুলিশ ও স্বজনরা।
ওই যুবকের বাবা জানান, পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্যকে ছাড়া ওই দিনের পর থেকে তারা অর্থকষ্ট আর দুরবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। সেদিনের পর থেকে এখন পর্যন্ত ছেলের সঙ্গে তাদের আর কোনো যোগাযোগ হয়নি। তবে বিভিন্ন মাধ্যমে জেনেছেন স্ত্রী-সন্তানসহ তার ছেলে বেঁচে আছে। কিন্তু কোথায় আছে তা জানা নেই।
ওই যুবকের মায়ের দাবি, ওই ঘটনায় তার ছেলে কোনোভাবেই জড়িত নয়। তাকে আদালতের সামনে উপস্থাপন করলে প্রকৃত সত্য জানা যেতো। ছেলেকে ফেরত দেওয়ার আকুতিও জানান তিনি।
বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নেতা কেতন বড়ুয়া জানান, ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা থেকে রামুতে মিছিল-মিটিং হয়েছে। ছবি-ভিডিওতে অনেককেই চেনা গিয়েছে। কিন্তু মামলার পরবর্তী প্রক্রিয়ায় অনেক চিহ্নিত ব্যক্তি যেমন বাদ পড়েছেন, তেমনি নিরাপরাধ অনেকেই হয়রানির শিকার হয়েছেন। বৌদ্ধ ধর্ম শান্তির কথা বলে। এখন সবাই শান্তি চায়। শান্তি ও সম্প্রীতির সঙ্গে এখানে বসবাস করতে চাই।
একই কথা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নেতা বিপুল বড়ুয়ার কণ্ঠেও। তিনি জানান, ১০ বছরে পর এসে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ সেই ঘটনার কথা ভুলতে বসেছে। পুঁড়িয়ে দেওয়া বিহার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নান্দনিকভাবে নির্মাণ করে দিয়েছেন। এখন শান্তিতে আছি। এর চেয়ে বেশি কিছু পাওয়ার নেই।
কক্সবাজার জেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি ও রামু কেন্দ্রিয় সীমা বিহারের আবাসিক ভিক্ষুক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু জানান, আলোচিত এ হামলার ঘটনায় এলাকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে যে সংকট তৈরী হয়েছিল তা অনেকটা কেটে গেছে। এর ধারাবাহিকতা রক্ষা করা জরুরি। প্রকৃত অপরাধিদের চিহ্নিত করা জরুরী। তবে এটা করতে গিয়ে বিচারের নামে নিরাপরাধ কেউ হয়রানির শিকার হোক, তা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
কক্সবাজার জেলা দায়রা ও জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ফরিদুল আলম জানান, ওই ঘটনায় ১৯টি মামলা হয়েছিল। এর মধ্যে পুলিশ বাদী হয়ে ১৮টি মামলা করেন। অপর একটি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তি বাদী হয়ে মামলা করলেও পরবর্তীতে বিবাদীদের সঙ্গে আপোষনামা দিয়ে খালাস করেছেন।
রাষ্ট্রপক্ষের এই আইন কর্মকর্তা জানান, মামলায় কোনোভাবেই সাক্ষীরা আদালতে এসে সাক্ষ্য দিতে রাজি হচ্ছে না। ফলে মামলা নিয়ে অনিশ্চয়তা প্রকট হচ্ছে। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নেতারাও সাক্ষ্য দিতে বা আদালতে হাজির হওয়ার ক্ষেত্রে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। এসব কারণে বিচারকাজ শেষ হয়নি।