১৭ই অক্টোবর ২০১৯ কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ ভারতীয় ইতিহাসবিদদের কাছে “ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে ইতিহাসের পুনর্লিখন” করার আহ্বান জানিয়ে হিন্দু রাষ্ট্রের প্রস্তাবক বিনয় দামোদর সাভারকারকে একটি উদাহরন হিসেবে তুলে ধরার আবেদন জানিয়েছেন।
স্বাধীনতা আন্দোলন, আরএসএস (RSS) ও ত্রিবর্ণ পতাকার সম্পর্ক কি ছিল সেটা একবার দেখে নেওয়া যাক। বর্তমান সরকার ও বিজেপি দল সুনিয়ন্ত্রিত ভাবে ইতিহাসকে ধ্বংস করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছে। এখন পর্যন্ত ইতিহাসের যে সংস্করণটি আমাদের কাছে রয়েছে তাতে পুরোপুরি স্পষ্ট যে আরএসএস (RSS) ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিতে অস্বীকার করেছিল। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসও স্বাধীনতা সংগ্রামের উত্তরাধিকারের মর্যাদা একচেটিয়া দাবি করতে পারে না।
কে বি হেডগেয়ার, যিনি ১৯২৫সালে আরএসএস (RSS) প্রতিষ্ঠা করেন, প্রাথিমিকভাবে তাঁর স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে আলগা সম্পর্ক ছিল। ১৯৩০এর দশকে তিনি নিশ্চিত করেছিলেন যে খাঁকি হাফপ্যন্ট পরিহিত তাঁর ছেলেরা ঐতিহাসিক স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে দূরে থাকবে। তাঁর জীবনীকার সি পি ভিসিকার তাঁকে উদ্ধৃত করে লিখেছেন- ‘দেশপ্রেম মানে শুধু কারাবরণ করা নয়। এই জাতীয় পৃষ্টপোষোকতার দ্বারা চালিত হওয়াও সঠিক নয়।’ অন্যদিকে হিন্দু মহাসভার ভি ডি সাভারকার, যিনি বিজেপি দল ও সরকারের রোল মডেল, তিনি হেডগেওয়ারের অনেক আগে থেকেই সক্রিয় ছিলেন তবে তিনি ছিলেন পারদের মতো পরিবর্তনশীল।
তিনি কঠোর বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে কারাগারে বন্দী ছিলেন।। তবে তিনি তার মুক্তির জন্য বৃটিশ সরকারের কাছ চিঠি লেখেন। সেই চিঠিগুলিতে সরকারের সাথে পূর্ণ-সহযোগীতা করবেন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহন করবেন না বলে প্রতিশ্রুতি দেন। এমনকি আন্দোলনকারীদের গোপন খবর সরকারকে জানিয়ে দেবেন বলেও কথা দেন। সেই সময়ে এক বৃটিশ রিপোর্টে দেখা যায় ভারত ছাড়ো আন্দোলনের গুরুতর পর্যায়ে এবং অন্যন্য আন্দোলনের সময়ে, আরএসএস (RSS) কেবল অনুপস্থিত ছিল তাই নয়, বৃটিশ প্রতিবেদকের রিপোর্টে দেখা যায় সংঘ সদস্যদের ভাল আচরণ এবং বৃটিশ আইন মেনে চলায় উপনিবেশিক শাসকেরা তাঁদের উপর প্রসন্ন ছিলেন। অন্যদিকে পুরুষ, মহিলা ও শিশুদের উপর সরকার প্রচন্ড দমন পীড়ন চালাচ্ছে। আরএসএস (RSS) এবং জাতীয়তাবাদীরা তথন কী ভূমিকা পালন করেছিল দিল্লির জাতীয় লেখ্যাগারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গোয়েন্দা রিপোর্টে তা সংরক্ষিত আছে। বিজেপি জাতীয় সংগ্রামের কৃতিত্ব ছিনতাই করতে চাইছে। ইতিহাসের নতুন ধাপে সেই রিপোর্ট জনসমক্ষে প্রকাশ করা উচিত।
স্বাধীনতার প্রাক্কালে, জাতীর বেশিরভাগ অংশের মানুষ স্বাধীনতা উদযাপনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন RSSএর মুখপত্র,Organiser ঘোষনা করেছিল ভারতীয় ত্রিবর্ণ পতাকাকে “হিন্দুরা কখনই সম্মান করবেনা ও আপন করে নেবে না।’ তিন শব্দটি নিজেই কুলক্ষণ যুক্ত শব্দ এবং ৩টি বর্ণযুক্ত পতাকা অবশ্যই একটি খুব খারাপ মানসিক প্রভাব ফেলবে এটি একটি দেশের জন্য ক্ষতিকারক। অথচ ‘তিন’-এর প্রতি হিন্দুদের প্রাচীন যুগের শ্রদ্ধা ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বরের ত্রিমূর্তিতে। মানুষকে আরএসএস (RSS) এর অনুকুলে আনার জন্য উপরোক্ত আষাঢ়ের গল্পের মতো ভিত্তিহিন কথা তাঁরা প্রচার করল।
Organiser-এর পূর্ববর্তী সংখ্যগুলো যেমন ১৯৪৭ এর ১৭ এবং ২২শে জুলাই সংখ্যায় আরএসএস (RSS) এই ধরনেের বহু, জাতীয় বিষয়ের বিরোধিতা করেছিল। তবে মূল বিষয়টি জানতে, আরএসএস (RSS) এর দ্বিতীয় প্রধান এম এস গোলওয়াকার (MS Golwalkar) এর Bunch Of Thoughts বইটির সাহায্য নিতে হবে। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘আমাদের নেতারা দেশের জন্য একটি নতুন পতাকা স্থাপন করার জন্য কেন এমন করলেন? আমরা একটি গৌরবময় অতীত সহ এক প্রাচীন মহান জা্তি! তাহলে কি আমাদের নিজস্ব কোন জাতীয় পতাকা ছিল না? এই হাজার বছর ধরে আমাদের কি কোন জাতীয় প্রতীক ছিল না? নিঃসন্দেহে ছিল। তাহলে মনে এই মূর্খ শূন্যতা?’ আমরা সত্যই আলোকিত হতাম যদি গোলওয়ালকার আমাদেরকে প্রাচীন জাতীয় প্রতীক ও পতাকা দেখাতে পারতেন, যা তিনি উল্লেখ করেছিলেন। তাঁর উদ্যেশ্য ছিল দেশটির সম্মিলিত সাংস্কৃতিক পতাকাটি Bhagwa Dhwajএর সাথে প্রতিস্হাপন করা। এই গেরুয়া ‘বিভক্ত পতাকা’ আরএসএস (RSS) কেবল বিভাজনকেই নয় বরং এটি হিন্দু ধর্ম এবং হিন্দুত্বের সমার্থক, যা ভারতের বহুত্ববাদের বাস্তবতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।
১৯৩০ সালে ৩০শ জানুয়ারী গান্ধীহত্যার পর ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পটভূমি বদলে দেয়। তদানিন্তন সরকারের উপ প্রধানমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করলেন। ‘যদিও আরএসএস (RSS) সরাসরি এই হত্যাকান্ডে জড়িত নয় তবু যে ভাবে আরএসএস (RSS) ও হিন্দু মহাসভা এই হত্যকান্ডকে স্বাগত জানিয়েছে এবং গান্ধীজীর চিন্তাধারা ও নীতির সমালোচনা করেছে।’ তার জন্য সরকার এই সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করছে।
গোলওয়ালকারের বহু আকুতি মিনতীকে উপেক্ষাকরার পর যখন RSS এইবলে মুচেলেকা দিলেন ‘They will stay away from politics, not be secretive and abjure violence. More important, it had to profess, loyalty to the constitution of India and National Flag.’ এই মুচেলেকা দেওয়ার পর ১৯৪৯ সালে আরএসএস (RSS) এর উপর জারি করা নিষিদ্ধতার নোটিশের অবসান হলো।