নিউইয়র্ক টাইমসের পাতায় “ভারতের রবিন হুড”কে নিয়ে বিশেষভাবে খবর প্রকাশিত হলো তারিখটা ১০ ই নভেম্বর ১৮৮৯। কিছুটা বিস্ময়ের, প্রশ্ন উদ্রেককারী শিরোনামে, নিতান্তই সাদামাটা আদিবাসী কৃষকের সন্তান তাঁতিয়া ভীলকে এই নামে সারা পৃথিবী চিনেছিল। ১৮৪২ সালে ভীল উপজাতি পরিবারে জন্মেছিলেন তাঁতিয়া। গ্রাম-বরদা, তহসিল-পান্ধনা, কেন্দ্রীয় প্রদেশ (মধ্যপ্রদেশ)। তাঁতিয়া ভীল বারো বছর ধরে একটানা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়েছিলেন এবং বিদেশী শাসনকে সমূলে উৎপাটন করার জন্য তার অদম্য সাহস ও আবেগের গুণে জনগণের কাছে নিজেকে মুক্তিদাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। আদিবাসী ও সাধারণ মানুষের অন্তরের অনুভূতির প্রতীক ছিলেন তাঁতিয়া। তাঁতিয়ার পদ্ধতি ছিল একেবারেই তাদের নিজস্ব। সংগঠিত দলবল নিয়ে সরকারি কোষাগার এবং ব্রিটিশ পোষিত ধনাঢ্যদের সম্পদ লুণ্ঠন করে তা গরিব মানুষের মধ্যে বেঁটে দেয়াই ছিল তার প্রতিবাদের ভাষা। প্রকৃতপক্ষে, তিনি ছিলেন দরিদ্র বঞ্চিত মানুষের মসীহ।
সকল বয়সের মানুষ তাকে ‘মামা’ বলে ডাকত। এই সম্বোধন এতটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে, ভীলরা এখনও ‘মামা’ বলে সম্বোধন করে গর্ববোধ করে। যাদের তীব্র আর্থিক সাহায্যের প্রয়োজন ছিল তাদের কাছে কি ভাবে যেন তাঁতিয়া পৌঁছে যেতেন।
তিনি ব্রিটিশদের উপযুক্ত শিক্ষা দিতে এবং ভীলদের সমমর্যাদার সমাজের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিলেন। বার বার তাঁকে গ্রেফতার করেছে ব্রিটিশ শাসকরা, কিন্তু আটকে রাখতে পারেনি, ‘জীবন-মৃত্যু, পায়ের ভৃত্য’ করে জেল ভেঙে মানুষের সাথে মিশে গেছেন অবলীলায়।
তিনি গেরিলা যুদ্ধে দক্ষ ছিলেন। ব্রিটিশদের সমকক্ষ হয়ে উঠতে তিনি বন্দুক চালাতেও শিখেছিলেন। তিনি একজন দুর্দান্ত শুটারও ছিলেন। ঐতিহ্যবাহী তীরন্দাজিতেও পারদর্শী মানুষটির প্রধান অস্ত্র ছিল ‘দাভা’ বা ফলিয়া।
অল্প বয়স থেকেই তিনি ব্রিটিশ ও হোলকার রাজ্যের সেনাবাহিনীর সাথে আপোষহীন লড়াইয়ে ঘন বন, উপত্যকা এবং পর্বতমালাকে নিজের বসবাসের ঠিকানা করে নিয়েছিলেন। তিনি পরাক্রমশালী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পুলিশের উপর প্রভাব সৃষ্টি করতেও সমর্থ হন। উর্দিধারী অনেকেই ছিল তার প্রতি দুর্বল এবং বহু বছর ধরে তাই তাদের এড়িয়ে যাবার রাস্তা তৈরী করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তাঁতিয়াকে সাহায্য করার অভিযোগে হাজার হাজার মানুষকে গ্রেফতার করা হয় এবং তাদের শত শতকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। তবুও মানুষের সমর্থন এতটুকু কমেনি তাঁতিয়া মামার প্রতি।
শেষ বারের মতো জনৈক গণপতের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে গ্রেফতার হতে হলো তাঁকে । ইন্দোরে ব্রিটিশ রেসিডেন্সি এলাকার সেন্ট্রাল ইন্ডিয়া এজেন্সি জেলে তাকে রাখা হয়েছিল। পরে তাকে কড়া পুলিশি পাহারায় জব্বলপুরে নিয়ে যাওয়া হয়। তাকে ভারী শিকল দিয়ে বেঁধে জবলপুর জেলে রাখা হয়েছিল। ব্রিটিশ অফিসাররা তাকে এ সময় অমানুষিকভাবে নির্যাতন করেছিল। তাঁর ওপর সব ধরনের নৃশংসতা চালানো হয়। ১৮৮৯ সালের ১৯ অক্টোবর জব্বলপুরের দায়রা আদালত তাকে ফাঁসির আদেশ দেয়। কিন্তু এই ফাঁসির আদেশ কার্যকর করতে ব্রিটিশ সরকার ভীত হয়ে পড়েছিল। ভীল গ্রামগুলোতে তীব্র উত্তেজনা এক বিদ্রোহের ইঙ্গিত দিচ্ছিলো। ৪ ডিসেম্বর, ১৮৮৯, বিকল্প পথ হিসেবে গোপনে তাঁর ফাঁসির আদেশ কার্যকর করে উষা লগ্নের আগেই ইন্দোরের কাছে খান্ডওয়া রেল রুটের পাটালপানি রেলওয়ে স্টেশনের কাছে তার দেহ ফেলে দেওয়া হয়েছিল। আজও সমস্ত ট্রেন চালক ‘তাঁতিয়া মামা’কে শ্রদ্ধা জানাতে ক্ষণিকের জন্য হলেও তাদের গাড়ি সেইখানে থামায়। ভয়ানক প্রভাবশালী এই সাধারণ আদিবাসী কৃষকের সন্তানটিকে “নিউ ইয়র্ক টাইমস” চিনতে ভুল করেনি। সকলের হৃদয়ে বেঁচে থাকুন ‘তাঁতিয়া মামা’ অনন্তকাল।
লেখক: শিবেস দাস
(স্যোসাল মিডিয়া থেকে)