ভারতের যোধপুরের ভোপালগড়ে ৬ শতাধিক বছর ধরে বংশপরম্পরায় মুসলিম পরিবারই করে আসছেন একটি দুর্গা মন্দিরে পৌরহিত্য। মন্দিরের পাশেই রয়েছে মসজিদ। দুর্গা আরতির মতো সেখানেও নিয়মিত নামাজ হয়। জামালুদ্দিন মসজিদে নামাজও পড়াতেন। এখন মসজিদের দায়িত্বে তাঁদেরই বংশধর। জামালউদ্দিন খান এখন পুরোপুরিভাবে থাকেন মন্দিরেই। যখন মসজিদে থাকতেন তখনও প্রতিদিন এই মন্দিরে এসে দুর্গাপুজো করে গিয়েছেন তিনি।
রাজস্থানের অনন্য সমৃদ্ধ এক জনপদ যোধপুর। ভারতের মরুভূমি প্রধান অঞ্চল রাজস্থানের ভোপালগড় এমনই মরু অঞ্চল। আছে ছোট ছোট পাহাড়ও। বাগোরিয়া এমনই মরু-পাহাড়ের গ্রাম। এখানে পাহাড়ের উপরে আছে একটি দুর্গামন্দির। সমস্ত নিয়ম রীতি মেনে এখানে নিত্য পুজো হয় এই মন্দিরে। নবরাত্রিতে হয় বিশেষ পুজো। এই মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের নাম জামালউদ্দিন খান। ৮৩ বছর বয়সী জামালউদ্দিন খান। শুধু আরাধনা করা নয়, দুর্গা মন্দিরেই বাস তাঁর।
বাগোরিয়া গ্রামের দুর্গা মন্দিরটি একটি পাহাড়ের ওপরে অবস্থিত। ৪শতাধিক সিঁড়ি ভেঙে দর্শনার্থীরা মন্দিরে প্রবেশ করেন। আশেপাশের গ্রামের বাসিন্দারা অসুর বধের কাহিনী শুনতে আসেন মন্দিরের প্রধান পুরোহিত জামালউদ্দিন খানের কাছে।
জনশ্রুতি রয়েছে, দীর্ঘ ৬০০ বছর আগে সিন্ধ প্রদেশের (পাকিস্তান) বাসিন্দা ছিলেন জামলুদ্দিনের পূর্বপুরুষ। সেসময় দেখা গিয়েছিল প্রাকৃতিক বিপর্যয়, তীব্র খরা। জামলুদ্দিনের পূর্বপুরুষ পরিবারের সকলকে নিয়ে পাড়ি দিয়েছিলেন ভারতের উদ্দেশ্যে। পথিমধ্যে তাদের বাহন উটের দুটি পা ভেঙে যায়। ফলে মরুভূমিতেই পুরো পরিবার সহ তিনি আটকে পড়েন। পানীয় জল ও খাবারের অভাবে মৃত্যুর মুখে পড়েছিলেন সকলে। সেই রাতে পরিবারের এক সদস্য দেবী দুর্গার স্বপ্নাদেশ পান এবং জানতে পারেন ওখানের কোন এক জায়গায় ধাপকুঁয়ো রয়েছে। সেখানে গেলেই মিলবে জলের সন্ধান। স্বপ্নাদেশ থেকে তিনি আরও জানতে পেরেছিলেন, সেখানেই রয়েছে দেবীর মূর্তি। সেই বিগ্রহের যেন আরাধনা করা হয়।
এরপর ওই ব্যক্তি পরিবারের সকলকে নিয়ে ওখানেই বসতি স্থাপন করেন। পরে দেবীর জন্য একটি মন্দির তৈরি করান ওই ব্যবসায়ী। শুরু হয় দুর্গা বন্দনা তথা পূজা। বংশ পরম্পরায় এখনও এ রীতি ধরে রেখেছেন বংশের ১৩তম প্রজন্ম জামালউদ্দিন খানের পরিবার। নিয়মিত পুজোর (DURGA PUJA) আয়োজন করা হয়। দেবী দুর্গার পুজো পদ্ধতি ও মন্ত্র শিখে রীতি মেনে ভক্তি সহকারে শুরু করা হয় পুজো। এই পরিবারই ওই স্থানে মসজিদ নির্মাণ করেন। সেখানে প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া হয়।
ওখানকার স্থানীয় বাসিন্দাদের বেশিরভাগই হিন্দু ধর্মাবলম্বী। নবরাত্রির সময় রেওয়াজ নিরামিষ রান্নার। তবে পৌরহিত্য করেন মুসলিম।
মন্দিরের প্রধান পুরোহিত জামালুদ্দিন খান গণমাধ্যমকে বলেছেন, “৬০০ বছর ধরে আমার পূর্বপুরুষরা এই মন্দিরের পুরোহিত। এখন আমি করছি। তারপর আমার ছেলে মেহরুদ্দিন করবে। আমার কাছেই সবকিছু শিখেছে। মা দুর্গার প্রতি আমাদের বংশের সকলেরই অগাধ ভক্তি, শ্রদ্ধা।
একদিন হঠাৎ দুটো উটের পা ভেঙে গেলে পূর্বজনেরা এই মরুভূমিতেই দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য হন। কয়েকটা দিন খাবার আর পানীয় জলের অভাবে গোটা পরিবারই প্রায় মৃত্যুমুখে। তখনই একদিন রাতে পরিবারের এক সদস্য স্বপ্নে দেখেন, মা দুর্গা কাছেই এক জায়গায় পানীয় জলের ধাপ কুঁয়ো বা স্টেপ ওয়েলের সন্ধান দিলেন। পথও বলে দিলেন। আর বললেন, সেই কুঁয়োর নিচে তাঁর একটি মূর্তি পড়ে আছে। সেটিকে উদ্ধার করে তাঁরা যেন পূজোর ব্যবস্থা করেন। পরদিন সেই পথনির্দেশ মেনে সেই ধাপ কুঁয়ো পাওয়া যায়। জল পেয়ে প্রাণ বাঁচল সকলের। মূর্তিও উদ্ধার হল।
জামালুদ্দিন আরও বলেছেন, আমাদের পূর্বপুরুষরা সিদ্ধান্ত নেন, আর কোথাও যাওয়া নেই। এখানেই মায়ের পুজোর ব্যবস্থা হবে। ধীরে ধীরে তাঁরা মন্দির পড়ে তোলেন। মন্দিরে পুজো দিতে থাকেন তাঁরাই। মন্ত্র জোগাড় করে শেখেন, শেখেন পুজোর পদ্ধতিও। আবার স্বধর্মের মসজিদও পড়ে তোলেন। সেখানেও নামাজ আদায়ের দায়িত্ব নেন। সেই থেকে পাঁচ ওয়ক্ত নামাজ পড়া আর নিত্যসেবা দুটিই পরিবারের সকলের কাজ।
স্বপ্নাদেশের পরে, আমাদের পূর্বপুরুষরা সিদ্ধান্ত নেন, আর কোথাও যাওয়ার নেই। এখানেই মায়ের পুজোর ব্যবস্থা হবে। ধীরে ধীরে তাঁরা মন্দির পড়ে তোলেন। মন্দিরে পুজো দিতে থাকেন তাঁরাই। মন্ত্র জোগাড় করে শেখেন, শেখেন পুজোর পদ্ধতিও। আবার স্বধর্মের মসজিদও পড়ে তোলেন। সেখানেও নামাজ আদায়ের দায়িত্ব নেন। সেই থেকে পাঁচ ওয়ক্ত নামাজ পড়া আর নিত্যসেবা দুটিই পরিবারের সকলের কাজ।
জামালউদ্দিনের ছেলে মেহেরউদ্দিন খান গণমাধ্যমকে বলেছেন, রমজানের সময় একমাস রোজা রাখা যেমন মুসলমানদের রীতি, তেমনই নবরাত্রির সময় নয় দিন উপবাসও পালন করা হয়। যুগ যুগ ধরে এই নিয়ম চলে আসেছে। ধর্মীয় ও বৈরি সাম্প্রদায়িকতার উসকানি এই নিয়মকে ভাঙতে পারেনি।
ভারতে বাবরি থেকে দাদরি সহ বহু সাম্প্রদায়িক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে গেলেও বাগোরিয়ার মুসলিম পুজারীরা নিষ্ঠা নিয়ে দেবী বন্দনা ও নামাজ একই সঙ্গে করে চলেছেন। এখানে সাম্প্রদায়িকতা বিভিন্ন উত্তাল সময়েও থাবা বসাতে পারেনি।