কবি তৈমুর খান আমার বন্ধু। নিজে কবিতা লিখতে পারি না তাই একদিন তাঁকে বলেছিলাম ‘কবিতা লেখা শিখিয়ে দেবেন?’ কবি বলেছিলেন বানিয়ে বানিয়ে কবিতা উনি কোনদিন লেখেননি। কষ্ট যখন তাঁর মুখ বন্ধ করে ভেতরে ভেতরে বোবাকান্না কেঁদেছে তখনই নাকি তাঁর কাছে কবিতা আপনা-আপনি এসেছে। কবি বলেছিলেন লেগে থাকুন একদিন কবিতা এমনিতেই এসে যাবে। বলেছিলাম, শুনেছি প্রেমটেম করলে নাকি কবিতা আসে? তৈমুর বলেছিলেন প্রেমই আমার ঈশ্বর। কবিতাকে আশ্রয় করেই আমি সেই ঈশ্বরের কাছে পৌঁছোতে চাই, মানুষকে ভালবেসে দেখতে চাই তার আঘাতের তীব্রতা কতখানি। কবিতাকে আশ্রয় করে ঈশ্বরের কাছে পৌঁছে যাওয়া! এসব কথা শুনে কবিতা লেখার স্বপ্ন আমার সেদিনই শেষ হয়ে গিয়েছিল। তারপর থেকে কবিতার পাঠক হয়েই কবিতার সাথে আমার যাপন। কবিতার অর্থ আমি যেমনটা করবো সেটা একান্তই আমার। কেউ কিছু দেখতে আসবে না। বীরভূমের কবিদের কবিতা পড়ি।এবছর শারদীয় আনন্দবাজার বা দেশে যখন মলয় ঘোষ, নাসিম এ আলম,দেবগুরু বন্দ্যেপাধ্যায়দের কবিতা পড়ছিলাম একজন বীরভূমি হিসাবে কেন জানিনা বুকটা একটা অন্যরকম অনুভূতিে চওড়া হয়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল কবিরুল, মনুজেশ, সমরেশ, আদিত্য, অমিত চক্রবর্ত্তীদের পথে এঁরাও কত সহজে কলকাতার সাহিত্যাকাশকে ছুঁতে পেরেছেন। তৈমুরের দেশের কবিতাটির আলোচনা করার লোভ সামলাতে পারলাম না- জানি ভুল হলে তৈমুর বন্ধু ব’লে ক্ষমা করে দেবেন-
বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন ধারায় পয়ারে রচিত কাব্য এবং মহাকাব্যগুলির একটিই সুর বাঁধা। দৌলত কাজী-সৈয়দ আলাওল থেকে কৃত্তিবাস ওঝা-কাশীরাম দাস সকলেই পয়ারে রচনা করেছেন কবিতা। তারপর একে একে এসেছে মঙ্গলকাব্যগুলি। রামায়ণ গান থেকে মনসার ভাসান আমরা এই পয়ারের রসে উজ্জীবিত বাঙালি। আমাদের জীবনরসায়নের প্রবাহ আজও সমানভাবে পয়ারে ভেসে চলেছে। সেই ঐতিহ্য, সেই গৌরব, সেই সংস্কৃতির সমন্বয় থেকেই জেগে উঠেছেন কবি তৈমুর খান। তাই তাঁর কবিতার নাম ‘পয়ারের দেশ’। তাঁর আত্মক্ষরণ নামক প্রবন্ধের বইয়ে পড়েছি,বাল্যকালে তিনি পিতার মুখে শুনেছেন রামায়ণ-মহাভারত পাঠ। শুনেছেন প্রাচীন ‘কেসসা’ বা আখ্যান। আরব্যরজনী থেকে আলিফ লায়লা, কাসাসুল আম্বিয়া থেকে রামপ্রসাদের পাঁচালী পর্যন্ত। আর সেসব শুনে শুনেই তৈমুরের সংস্কৃতির ভিত্ তৈরি হয়েছে। শারদীয়া ‘দেশে’র এই কবিতাটি সেই অনন্যতা নিয়েই ঐতিহ্যের পরম্পরাকে ধারণ করেছে। নিজের পরিচয় দিতেই কবিতার প্রথম স্তবকে লিখেছেন:
“প্রাচীন পয়ারের দেশে জন্ম হলো আমার
বাল্মীকি-কাশীদাসী থেকে শ্রীমদ্ভাগবতে পথ হেঁটে চলেছেন বাবা
আমি হরীতকী বনের ফাঁকে ফাঁকে ছুটছি
যদিও প্রচুর আমলকী বটফল শিরীষপাতা ঝরে গেছে
দেখতে দেখতে বেহুলাকেও ভেসে যেতে দেখি”
এখানে লক্ষণীয় বিষয় হল: কবি নিজের পরিচয় ব্যক্তিগতভাবে দিতে চাননি, প্রকৃতিকে সঙ্গে নিয়েই আপন ঐতিহ্যের প্রাচীনত্বকে ধারণ করেছেন। তাই বটফল, শিরীষ পাতা, আমলকী, হরীতকীর কথা যেমন বলেছেন, তেমনি বলেছেন বাল্মীকি-কাশীদাসী- শ্রীমদ্ভাগবতের কথাও। আবার মঙ্গলকাব্যের বেহুলাকে দর্শনের কথাও উল্লেখ করেছেন। সব মিলিয়েই তাঁর এই গৌরব। পরোক্ষে তাঁর ভালোবাসার বৈভব।
তরুর ছায়ায় যেমন ‘নির্জন’ বসে থাকে, তেমনি দুপাশের জলের ঢেউয়ের নৃত্য এবং হাওয়ায় উড়ে যাওয়া শাড়ি ও গ্রীষ্মের করুণ প্রহর বাংলার—ঋতুযাপনের রোমান্টিকতার সঙ্গে বিরহাতুর জীবনের প্রতিচ্ছবিকেও তিনি মিলিয়ে দেন।
প্রাচীন গমখেতে দাঁড়িয়ে থাকা আদিম নরনারীকে ‘আদম’ এবং ‘হবা’র মতোই মনে হয়। কিন্তু তাদেরও যৌবন রসসিক্ত মাদকতার প্রলেপ চোখে-মুখে ফুটে ওঠে। শরীরী হিল্লোলে পয়ারের ছন্দ অনুভূত হয়। সেই ছন্দ থেকেই কম্পন জাগে। কবি দেখেন: ‘শরীরে পয়ার লেগে আছে, পয়ারে পয়ারে মুগ্ধতা’। রূপকথা থেকে অরূপকথা পর্যন্ত পয়ার গড়িয়ে যায়। জ্যোৎস্নায় উড়ে যাওয়া হাঁস, অথবা পাহাড়ি ঝরনায় পা ডুবিয়ে সকালের হেসে ওঠা, অথবা কুয়াশায় গড়াগড়ি খাওয়া ভবিষ্যৎ, উচ্চার নিরুচ্চার মিলে পয়ারে পয়ারে ঘর বাঁধা চলতেই থাকে। একদিকে জীবনধর্ম, অন্যদিকে প্রকৃতি; একদিকে চেতনা, অন্যদিকে নিশ্চেতনা; একদিকে পূর্ণ, অন্যদিকে শূন্য সবই পয়ারে আন্দোলিত, বিবর্তিত, সচকিত এবং বিন্যস্ত। সৃষ্টির ধারাকে এই ছন্দের অবিরল ধারায় কবি চালিত হতে দেখেছেন।
কবি কবিতাটিও অক্ষরবৃত্ত বা পয়ারেই লিখেছেন।
লেখক: সৈয়দ মাঈনুদ্দিন হোসেন