ধর্মবাজ বনাম মুক্তবাজ: জাত পাত যার যার; আত্মদর্শন সবার পর্ব-২

বলন কাঁইজি
বলন কাঁইজি
14 মিনিটে পড়ুন

ধর্মীয় অনুভুতি কথাটি ভুল, ভুয়া ও অন্তঃসারশূন্য।
ধর্মীয় অনুভুতি বাক্যটিও যেমন ভুয়া, এর ব্যবহারও তেমন ভুল। কারণ ধর্ম বলতে পদার্থের বৈশিষ্ট্যকে বুঝায়। যেমন আগুনের ধর্ম দাহ্য করা, চুম্বকের ধর্ম লোহাজাতীয় পদার্থকে আকর্ষণ করা, দিকনির্ণায়কের (Compass) ধর্ম দিক নির্ণয় করা ও জলের ধর্ম নিম্নগামিতা। যেমন- কোনো আগুন যদি দাহ্য না করে, কোনো চুম্বক যদি লোহাজাতীয় পদার্থকে আকর্ষণ না করে, কোনো দিকনির্ণায়ক যদি দিক নির্ণয় না করে এবং কোনো জল যদি নিম্নগামী না হয়, তবে তাদের ধর্মীয় অনুভুতি নষ্ট হয়ে গেছে। তারা ধর্ম হারিয়ে ফেলেছে।

মানুষের নির্মিত ঈশ্বরের কাঁধে পা রেখে মানুষের নির্মিত মতবাদকে ধর্ম বলে চালানো, মানুষের নির্মিত সাম্প্রদায়িক মতবাদকে ধর্ম বলে চালানো কতটুকুইবা যুক্তিযুক্ত? এখন আমাদের দেশে হয়তো সাম্প্রদায়িক মতবাদ নয়তো সাম্প্রদায়িক মতবাদকে ধর্ম বলে চালানো হচ্ছে। গত ১,৯৬০ খ্রিস্টাব্দে সর্ব প্রথম কলকাতায় বাংলা অভিধান প্রণিত হয়। তারপর বাংলাদেশে ১,৯৮৪ খ্রিস্টাব্দের পর হতে বাংলা একাডেমির মাধ্যমে বাংলা অভিধানের আংশিক প্রকাশিত হয়। তবে ১,৯৯০ খ্রিস্টাব্দের পর হতে পূর্ণাঙ্গ বাংলা অভিধান প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশে বাংলা একাডেমির মাধ্যমে প্রকাশিত বাংলা অভিধানে ধর্ম এর যেসব অভিধা গ্রহণ করা হয়েছে-


ধর্ম (রূপ)বি. ১. বিভিন্ন সম্প্রদায়ের শাস্ত্রনির্দিষ্ট বিধিবিধান; (religion) ২. সৎকর্ম; পুণ্যকর্ম; সদাচার; কর্তব্যকর্ম (ক্ষমা শ্রেষ্ঠ ধর্ম) ৩. স্বভাব; প্রকৃতি; প্রত্যেক জীব বা বস্তুর নিজস্ব গুণ (মানবধর্ম, আগুনের ধর্ম) ৪. পুণ্য (ধর্মের সংসারে পাপ) ৫. ন্যায়-অন্যায় পাপ-পুণ্যের বিচারকর্তা; বিশ্ববিধাতা (দোহাই ধর্মের) ৬. মনুষ্যত্ব; মানুষের কর্তব্য-অকর্তব্য সম্বন্ধে জ্ঞান (তার ধর্মজ্ঞান নেই) ৭. আইন; নীতি ৮. সাধনার পথ (সুফি ধর্ম) ৯. সতীত্ব (সতী নারীর ধর্মনাশ) ১০. (জ্যোশা) রাশিচক্রের লগ্ন থেকে নবমস্থান। (৭ম পুনর্মুদ্রণ, জুন ২,০০৫ খ্রিস্টাব্দ)। এর মধ্যে “২. সৎকর্ম; পুণ্যকর্ম; সদাচার; কর্তব্যকর্ম (ক্ষমা শ্রেষ্ঠ ধর্ম) ৪. পুণ্য (ধর্মের সংসারে পাপ) ৫. ন্যায়-অন্যায় পাপ-পুণ্যের বিচারকর্তা; বিশ্ববিধাতা (দোহাই ধর্মের) ৬. মনুষ্যত্ব; মানুষের কর্তব্য-অকর্তব্য সম্বন্ধে জ্ঞান (তার ধর্মজ্ঞান নেই) ৮. সাধনার পথ (সুফি ধর্ম) ৯. সতীত্ব (সতী নারীর ধর্মনাশ)” এসব অভিধা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ এসব ধর্ম পরিভাষাটির অভিধা হওয়ার অযোগ্য। ধর্ম পরিভাষাটির অভিধা যা হওয়া উচিত নিচে দেখানো হলো।

ধর্ম (রূপ)বি. স্বভাব, প্রকৃতি, গুণ, নিয়ম, রীতি (পবি) প্রত্যেক জীব বা বস্তুর নিজস্ব গুণ (জ্যোশা) রাশিচক্রের লগ্ন থেকে নবমস্থান (প্র) ১. পুরাণে বর্ণিত একটি চরিত্রবিশেষ ২. সাম্প্রদায়িক পণ্ডিতদের মতে যুগোপযোগী সামাজিক সংস্কার বিশেষ, শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠন ও সমাজ শাসনমূলক মতবাদ, মানুষের কর্তব্যাকর্তব্য সম্বন্ধে জ্ঞান, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের শাস্ত্র নির্দিষ্ট বিধিবিধান (শ্ববি) পৌরাণিক সাহিত্যের ওপর ভিত্তি করে গড়ে তোলা সামাজিক শাসনমূলক সংস্কারবিশেষ।
রূপ বি = রূপক বিশেষ্য
বি = বিশেষ্য
পবি = পদার্থ বিজ্ঞান
জ্যোশা = জ্যোতিশ শাস্ত্র
প্র = প্রপক (পরিভাষার রূপক ব্যাখ্যা)
শ্ববি = শ্বরবিজ্ঞান (ঈশ্বর বিজ্ঞান)
বাংলা ভাষায় বিশ্বের সনাতনী সংস্কারগুলোকে ধর্ম বলার সূচনা (The countdown to said religions in Bengali language at the world sectarian cultures)
অর্থাৎ ১. ইয়াজিদিবাদ ২. ইয়াসানিবাদ (আহলি ই হক্ব) ৩. ইসলামবাদ (শান্তিবাদ) ৪. ইহুদিবাদ ৫. কনফুসীবাদ ৬. ক্যাওদাইবাদ ৭. খ্রিস্টানবাদ ৮. জরথুস্ত্রবাদ ৯. জুসিবাদ ১০. জেনবাদ ১১. জৈনবাদ ১২. তাওবাদ ১৩. তেনরিকোবাদ ১৪. দ্রুজবাদ ১৫. নিওপ্লাটোবাদ ১৬. বাহাইবাদ ১৭. বৌদ্ধবাদ ১৮. মাজদাকবাদ ১৯. মান্দাই (এশীয়) ২০. মান্দাই (মধ্যপ্রাচ্যীয়) ২১. রাস্তাফারিবাদ ২২. শাক্তবাদ ২৩. শিখবাদ ২৪. শিন্তোবাদ ২৫. শ্যামানিবাদ ২৬. সামারিতানবাদ ২৭. হিন্দুবাদ ও ২৮. হোয়াহাওবাদ- এ মতবাদগুলোকে বর্তমানকালে ধর্ম বলা হচ্ছে। এগুলো মানবরচিত বা মানুষের দ্বারা নির্মিত মতবাদ। সাধারণ মানুষের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করার জন্য সব যাজকরাই সুকৌশলে স্বস্ব মতবাদকে ঈশ্বর প্রদত্ত বাণী দ্বারা নির্মাণ করা বা ঈশ্বরের পরামর্শেই নির্মিত ইত্যাদি বলেছেন। আবার কেউ কেউ ঈশ্বর প্রদত্ত দূতের মাধ্যমে বা ঐশিদূতের পরামর্শে নির্মিত বলেছেন।

- বিজ্ঞাপন -

মানব নির্মিত মতবাদ কখনোই ধর্ম হতে পারে না। কারণ মানব নির্মিত মতবাদ চির আপেক্ষিক। এটি কিছু দিন চলতে পারে আবার নাও চলতে পারে। যেমন- আমাদের বাংলাশের অধিকাংশ স্থানে আজ হতে তিনশো-চারশো (৩০০-৪০০) বছর পূর্বেও কোথাও হিন্দুবাদ আবার কোথাও জৈনবাদ প্রচলিত ছিল। কালের বিবর্তনে ও বাতাবরণে সেই স্থানেই এখন ইসলামসহ প্রায় শতাধিক সাম্প্রদায়িক মতবাদ প্রতিষ্ঠিত।
মহাত্মা লালন সাঁইজি যথার্থই বলেছেন-

“একেক দেশে একেক বাণী
পাঠান কি সাঁই গুণমনী
এসব মানুষের রচনা জানি
লালন কেন্দে কয়।”



কবি নজরুল বলেছেন-

“পুজিছে গ্রন্থ ভণ্ডের দল! মূর্খরা সব শোনো
মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।”

অন্যদিকে; ধর্ম হচ্ছে ঈশ্বর প্রদত্ত। ধর্ম হচ্ছে চিরন্তন, চিরঞ্জীবি, অলঙ্ঘনীয়, অপরিবর্তনীয়, অপরিবর্তনশীল ও অপরিবর্তনযোগ্য। মানুষের নির্মিত মতবাদকে ধর্ম বলা কোনমতেই কাম্য নয়। মতবাদ অনেক প্রকার হতে পারে। যেমন রাজনৈতিকবাদ, অর্থনৈতিকবাদ, বৈজ্ঞানিকবাদ, দার্শনিকবাদ, সাম্প্রদায়িকবাদ, পারম্পরিকবাদ, গুরুবাদ, বৈষ্ণববাদ, সহজিয়াবাদ, ক্যাথলিকবাদ, সুফিবাদ ও বাউলবাদ ইত্যাদি। আমাদের দেশে প্রচলিত ধর্ম হচ্ছে সাম্প্রদায়িকবাদ বা সাম্প্রদায়িক মতবাদ।

মতবাদ নির্মাতা সাম্প্রদায়িক নেতারা গাছ, মাছ, বাতাস, আগুন, পাহাড়, জল বা নিরাকার অজানা সত্তাকে ঈশ্বর বলবে আর বুদ্ধিজীবী ও বিবেকবানরা তা যাচাইবাছাই না করেই মেনে নিবে এটা কোন ধরণের ধর্মীয় অনুভুতি? এক মতবাদের দেবতা ১,৬০০টি বিয়ে করেছে (ভারতীয় পৌরাণিক সাহিত্যে বর্ণিত কৃষ্ণ), অন্য মতবাদের দেবতা ৩০০টি বিয়ে করেছে (কুরানে বর্ণিত সোলেমান) আবার কোনো মতবাদের দেবতা ১৪টি বিয়ে করেছে (কুরানে বর্ণিত মুহাম্মদ)। কোনো মতবাদের দেবতা শতাধিক যুদ্ধ করেছে। আবার কোনো মতবাদের দেবতা ৪৭টি যুদ্ধ করেছে (কুরানে বর্ণিত মুহাম্মদ কথিত ইসলামের ইতিহাস)। কোনো মতবাদে একাধিক দেবতা স্বশরীরে স্বর্গে গমন করেছেন। যেমন ভারতীয় পৌরাণিক সাহিত্যে বর্ণিত যুধিষ্ঠির ও রাবণ। এছাড়াও; অমৃতসুধা আনবার ছলে গরুড়ও একবার স্বশরীরে স্বর্গে প্রবেশ করেছিলেন বলে কথিত আছে। অন্যদিকে; মুসলমানদের মতে; হযরত ইদরিস ও মরিয়মপুত্র ইসা স্বশরীরে স্বর্গে গমন করেছেন বলে কথিত আছে (কাসাসুল আম্বিয়া)। আবার খ্রিস্টানদের একদলের মতে; হযরত ইসা স্বশরীরে স্বর্গে গমন করেছেন বলে বর্ণিত আছে। অন্যদিকে; ইসলামী মতবাদে বর্ণিত আছে যে; কুরানে বর্ণিত মুহাম্মদ স্বশরীরে স্বর্গে গিয়ে ঈশ্বরের সাথে দেখা করার চেষ্টা করেও ঈশ্বরের দেখা পাননি। এসব কে বিশ্বাস করবে? কত রূপকগল্প বিশ্বাস করবে? আর গ্রিক মিথোলজির গল্পের তো শেষ নেই!

কেউ বিপক্ষে যুক্তি-দর্শন উপস্থাপন করলে তাদের বলা হবে নাস্তিক, যবন, ধর্মত্যাগী কিম্বা কাফের। এসব নিয়ে কথা বলতে গেলে বা লেখালেখি করতে গেলে বলা হবে এটি সেন্সেটিভ ব্যাপার, কারো ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত করা ঠিক নয় ইত্যাদি। যারা এসব কথা বলছেন তাদেরও এখন ভেবে দেখতে হবে ধর্ম ও ধর্মীয় অনুভুতি কী?

- বিজ্ঞাপন -

তবে কেউ যদি বোকার মতো আবোলতাবোল লেখে, যাচ্ছেতাই লেখে, অযৌক্তিক কথা বলে তাদের ব্যাপারটা একেবারেই ভিন্ন ও দুঃজনক। দুয়েকজন কুলাঙ্গারের জন্য সারাদেশের সব মানুষের জ্ঞানচর্চা বন্ধ হতে পারে না। যারা সাম্প্রদায়িকদের দিকনির্দেশনা না দিয়ে, যুক্তি-দর্শন উপস্থান না করে কেবল গালাগালি করে, তারা যেমন লেখক নয় তেমন গবেষকও নয়। তাদের উদ্ভবই হয় কোনো শোষক-শাসক শ্রেণির হাত ধরে। তারা সমাজের ধনীক শ্রেণি, পুঁজিবাদী ও শোষক শ্রেণির হাতের পুতুল। তারা তাদের ক্রীড়ানক কর্তাবাবুদের কথায় কিছুদিন অশ্লীল ভাষায় লেখিলেখি করবে, তারপর তারা তাদের ঐ কর্তাবাবুদের স্বার্থসিদ্ধির পুঁজার পুষ্পরূপে আত্মাহুতি দিবে। যে কর্তাবাবুরা তাদের অর্থ ও সাহস দিয়ে অপব্যাখ্যা ও অপপ্রচার করিয়ে নিচ্ছে, সে-ই কর্তাবাবুরাই কবে কোথায় কিভাবে তাদের প্রাণনাশ করছে, তা তারা কেউ জানতে পারছে না।

সবচেয়ে বড় কথা হলো, ধর্মবাজ, ধর্ম ব্যবসায়ী, ধর্মজীবী, ধর্মভুক ও ধর্মভৃৎ ঠাক-পুরুৎ ও মোল্লা-মুন্সিরা মঞ্চে দাঁড়িয়ে মাইক দিয়ে যখন বলে অমুক ধর্ম বাতিল, অমুক ধর্ম মানবরচিত (তাই মান্য করা যাবে না), অমুক ধর্মকে ঈশ্বর স্বীকার করেন না, অমুক ধর্মের অমুক দেবতা এ এ কাজ করেছে। অমুক ধর্মে শূকর খায়, তাদের আচরণও শূকরের মতো, অমূক ধর্মে গোরু খায়, তাই তাদের আচরণও গোরুর মতো, অমুক ধর্মের অনুসারীরা এই এই মন্দকর্ম করে —– ইত্যাদি।

তখন কি অন্য ধর্মের অনুসারীদের ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত লাগে না? তখন কি সেসব সেন্সেটিভ হয় না? কই তাদেরকে তো কেউ নাস্তিক বলে না। তাদেরকে তো কেউ হত্যার হুমকি দেয় না। বরং আরও অধিক হাসাহাসি ও ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে। আরও অধিক আনন্দ করে। তাহলে মুক্তমনা ও মুক্ত জ্ঞানচর্চাকারীদের কেন নাস্তিক, যবন ও ধর্মত্যাগী ইত্যাদি বলা হয়? কেন এদের হত্যার হুমকি দেওয়া হয়? মুক্ত জ্ঞানচর্চা করলে, সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে গিয়ে লেখালেখি করলে, তাদের ইচ্ছেমতো নাস্তিক, যবন ও ধর্মত্যাগী বলা হবে, তাদেরকে হত্যার হুমকি দেওয়া হবে, তাদেরকে হত্যা করা হবে। তারপরও দেশের প্রশাসনিক কর্মকর্তাগণ বলেন কারো ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত লাগে এমন লেখালেখি হতে আপনারা বিরত থাকবেন।

- বিজ্ঞাপন -

তিনি তো একবারও বলেন না যে; যার যার শাস্ত্রের অবিশ্বাস্য, অযৌক্তিক, অবৈজ্ঞানিক ও অগ্রহণযোগ্য কথাগুলো হাট, বাজার, মঠ, মন্দির, গির্জা, স্টল, হোটেল, বাস, লঞ্চ ও ট্রেনে প্রচার করবেন না। উপাসনালয়ের বাইরে সর্ব প্রকার সাম্প্রদায়িক কাহিনী প্রচার বন্ধ করেন! এর অর্থ কি এমন দাঁড়ায় না যে; শাস্ত্রবাজ, ধর্মবাজ, ধর্মব্যবসায়ী, ধর্মজীবী ও ধর্মভৃৎরা স্বস্ব শাস্ত্রের রূপকথা, অবিশ্বাস্য কথা, অযৌক্তিক কথা ও অবৈজ্ঞানিক কথা প্রচার করেই যাবে; অন্যদিকে; লেখক, গবেষক, চিন্তাবিদ, দার্শনিক ও বিজ্ঞানীরা কোনো কথা বলতে পারবে না? এর অর্থ কি এমন দাঁড়ায় না যে; প্রশাসনিকভাবে ধর্মব্যবসাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে! প্রশাসনিকভাবে ধর্মজীবীদের আরও অপকর্ম করার সাহস দেওয়া হচ্ছে?

বিশ্বের অনেক দেশেই সাম্প্রদায়িক কার্যক্রম কেবল উপাসনালয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু বাংলাদেশে আজো মাইক লাগিয়ে অলিতে-গলিতে ও অঙ্গন-প্রাঙ্গনে সাম্প্রদায়িক মতবাদের সভা-সমাবেশ করা হয়। যারাই সাম্প্রদায়িক মতবাদের প্রচারক ও ধারক-বাহক তাদের পরামর্শ ও উস্কানিতেই মসজিদ, মন্দির, গির্জা ও প্যাগোডায় বোমা মারা হয়, নাকি বিশ্বের বিভিন্ন গণহত্যা, বোমাবাজি, গণ-অপহরণ, গণডাকাতির সাথে কোনো যবন, নাস্তিক ও ব্লগার জড়িত? মহামান্য প্রশাসনিক কর্মকর্তাগণ কি বলতে পারবেন কোনো মুক্ত জ্ঞানচর্চাকারী ও কোনো মুক্তমনা ওপরোক্ত অপকর্মগুলোর সাথে জড়িত? যে মুক্তমনাদের মধ্যে হতে এসেছে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বঙ্কিম, শরৎ ও জসিমুদ্দিন এর মতো বিশ্ববিখ্যত মহামানব। সেই মুক্ত জ্ঞানচর্চা যদি আবারো তাদের ভয়ে সমাজে নিষিদ্ধ হয়ে যায়, তবে সমাজে সৃষ্টি হবে শুধুই দানব। মানব আর সৃষ্টি হবে না। ভুলে গেলে চলবে না যে; সমাজে মানবের অভাবেই দানবের উদ্ভব হয়।

স্মরণীয় যে; ধর্মবাজ ও ধর্মজীবীরা চিরদিনই কোনো না কোনো শোষক গোষ্ঠীর নেতৃবৃন্দের পদলেহী। একেক সময় একেক পুঁজিবাদী গোষ্ঠী তাদের ব্যবহার করে আবার ছুড়ে ফেলে। ধর্মবাজ নেতারা কখনই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। সব সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয় এদের অনুসারী সাধারণ মতবাদপ্রবণ মানুষ- কেউ ভুয়া স্বর্গের লোভে, কেউ মতবাদকর্মকে প্রাণপ্রতিম কর্ম মনে করে, আবার কেউ মতবাদগুরুদের চাপে পড়ে। সারা পৃথিবীতে ধর্মবাজদের দ্বারা এযাৎ যত রক্তহানী, প্রাণহানী ও জনপদ ধ্বংস হয়েছে মুক্তমনাদের দ্বারা তার একভাগও কি কোথাও ঘটেছে?

তাহলে ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত লাগা, সেন্সেটিভ স্থানে আঘাত লাগা ও ধর্মের বিরুদ্ধে লেখালেখি না করা কথাটির গুরুত্ব কোথায়? সাম্প্রদায়িক মতবাদের অনুসারী যাজক, বক্তা, বৈখ্যিক, টৈকিক, অনুবাদক ও অভিধানবিদরা যাচ্ছেতাই প্রচার করবে কিন্তু বুদ্ধিজীবী, গবেষক, লেখক, দার্শনিক ও বিজ্ঞানীরা কোনো কিছুই বলতে পারবে না, লেখতে পারবে না, তাহলে মানুষের ভবিষ্যৎ যাবে কোন দিকে একবারও কি ভেবে দেখেছেন? কবি নজরুল যথার্থই বলেছেন-

“বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে আমরা তখন বসে,
বিবি তালাকের ফোতোয়া খুঁজি কুরান হাদিস চষে।”

পরিশেষে বলতে চাই যে; বসন শিল্প, মৃৎশিল্প, বয়ন শিল্প, পাট শিল্প, চামড়া শিল্প, বৃহৎ শিল্প, ক্ষুদ্র শিল্প ও হস্ত শিল্পের মতো সাম্প্রদায়িক মতবাদ নির্মাণ করাও একটি শিল্প। শিল্পীরা মনের সবটুকু মাধুরী মিশিয়ে যেমন নির্মাণ করে মানুষের নিত্যদিনের নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যবহারিক দ্রব্য। সাম্প্রদায়িক শিল্পীরাও তেমন মনের রঙতুলিতে মাধুরী মিশিয়ে মানুষের দৈনন্দিন আচার আচরণ নির্মাণ করেন। নির্মাণ করেন বিশ্ববিখ্যাত, জগদ্বিখ্যাত ও কালজয়ী মহামানব। যেমন- বাল্মীকি নির্মাণ করেছেন রামকে, বেদব্যাস করেছেন কৃষ্ণকে ও ললিত করেছেন লালনকে।

সাধারণ শিল্পাদির যেমন কাঁচাদ্রব্য রয়েছে, সাম্প্রদায়িক মতবাদ নির্মাণ শিল্পেরও তেমন কাঁচাদ্রব্য রয়েছে। কাঁচাদ্রব্য রূপে যেমন চামড়া শিল্পের চামড়া, পাট শিল্পের পাট ও মৃৎশিল্পের ভালো মাটি, তেমন সাম্প্রদায়িক মতবাদ নির্মাণ শিল্পেরও কাঁচাদ্রব্য হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, সংহারকর্তা, ঐশিদূত, প্রতীতি, বর্থ্য, আদিমানব, আদিমানবী, পাপ-পুণ্য, স্বর্গ-নরক, বিচার ও এদের পৌরাণিক গল্প-কাহিনী।

সারাবিশ্বে অসংখ্য সাম্প্রদায়িক মতবাদ সৃষ্টি হয়েছে, এখনও হচ্ছে এবং আগামীতে আরও হবে। অতীতে অনেক সাম্প্রদায়িক মতবাদ ধ্বংস হয়েছে, এখনও হচ্ছে এবং আগামীতেও হবে। তাই কখনই কোনো সাম্প্রদায়িক মতবাদ নিয়ে বাড়াবাড়ি, নির্যাতন-নিপীড়ন, বধ-বলি ও হত্যা-হনন, আগ্রাসন ও গালাগালি করা কোনো বুদ্ধিমান বা বিবেকবানের কাজ হওয়া উচিত নয়। সাম্প্রদায়িক মতবাদ চির আপেক্ষিক। এসব আজ আছে কাল নেই। এখানে আছে ওখানে নেই। তাই এসব মতবাদের তালে পড়ে নিজের মূল্যবান জীবন বিপন্ন করা, ভুয়া স্বর্গের লোভে আত্মঘাতী কাজ করা, কারো প্রলোভনে পড়ে হত্যা-হননে জড়িত হওয়া ও কোনো সাম্প্রদায়িক যুদ্ধ-সংগ্রামে অংশগ্রহণ করা কোনো বুদ্ধিমান লোকের উচিত নয়।

বর্তমানকালে প্রচলিত সাম্প্রদায়িক বা ধর্মীয় মতবাদগুলোর পক্ষে ও বিপক্ষে কোনো দিকেই আত্মঘাতী অবস্থান গ্রহণ করা কারোই উচিত নয়। নিরপেক্ষ থাকাই উত্তম। যেমন কুরানে বলা হয়েছে- ‘لَكُمْ دِينُكُمْ وَلِيَ دِينِ’ উচ্চারণঃ “লাকুম দিনুকুম ওয়ালিয়া দিন” অর্থঃ “তোমাদের মতবাদ তোমাদের জন্য আমাদের মতবাদ আমাদের জন্য।” কবিগুরু যথার্থই বলেছেন- “উত্তম নিশ্চিন্তে চলে অধমের সাথে, তিনিই মধ্যম যিনি থাকেন তফাতে।” মধ্যম পন্থা অবলম্বন করাই বুদ্ধিমানের কাজ।

চলবে…

ধর্মবাজ বনাম মুক্তবাজ: জাত পাত যার যার; আত্মদর্শন সবার পর্ব-১

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
অনুসরণ করুন:
মিথলজি গবেষক
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!