ধর্মবাজ বনাম মুক্তবাজ: জাত পাত যার যার; আত্মদর্শন সবার। পর্ব-১

বলন কাঁইজি
বলন কাঁইজি
9 মিনিটে পড়ুন

মুক্তকথা বলার নামে যারা মুক্তবাজি করছে; অন্যদিকে; ধর্ম রক্ষার জন্য যারা ধর্মবাজি করছে, উভয় দলই সমাজের পুঁজিবাদী শোষক গোষ্ঠীর হাতের পুতুল। ক্ষমতাধর শাসকরাই এদের নির্মাণ করে, নিজেদের কাজে ব্যবহার করে ও প্রয়োজন শেষে নিধন করে। ২টি দলের অনেকেই বিষয়গুলো অনুধানব করতে পারে না। স্বার্থান্ধ শাসকরা হাকিম হয়ে হুকুম করে পুলিশ হয়ে ধরে। অতঃপর; সর্প হয়ে দংশন করে ওঝা হয়ে ঝাড়ে। অবলার মতো চেয়ে দেখে মুক্তবাজ ও ধর্মবাজরা। চোখের সামনেই কত মানুষ হতাহত হচ্ছে কিছুই করার নেই তাদের। মুক্তবাজরা মরলে কয় বেঁচে গেলো এবং সাম্প্রদায়িকরা মরলে কয় বেহেস্তে গেলো। এখন উভয় দলেরই শোষক-শাসকদের হীনস্বার্থে ব্যবহার হওয়ার হাত হতে মুক্তিলাভের সময় এসেছে। জঙ্গি-পুলিশ খেলা, মৌলবাদী খেলা, আস্তিক-নাস্তিক খেলা, ধর্মখেলা ও ধর্মমেলার স্বরূপ বুঝার সময় এসেছে।

মুক্তবাজ বলতে স্বঘোষিত মুক্তমনা লেখক, গবেষক, ব্লগার ও বক্তাদের বুঝানো হয়েছে। মুক্তচিন্তা, মুক্ত লেখা ও মুক্ত কথা বলারও একটা সীমা আছে। বাক্ স্বাধীনতারও একটা সীমা আছে। স্বাধীন দেশ তাই স্বাধীনভাবে চলা-বলার অধিকার সবারই আছে। অধিকার আদাইয়ের কথা বলে আর স্বাধীনতার ধুয়া তুলে একজন অন্যজনের পাকা ধানে মই দিতে পারবে না। তেমন; মুক্ত চিন্তার কথা বলে একজন অন্যজনের শাস্ত্র, মতবাদ ও সংস্কৃতিতে আঘাত দিতে পারবে না। এরূপ করলে কখনই মুক্তচিন্তা থাকে না। বরং তা চরম ধৃষ্টতা ও চরম অন্যায়।

কিছু কিছু লোক ব্লগে, ফেসবুকেঅন্যান্য প্রচার মাধ্যমে ধর্মগ্রন্থ, ধর্মাবতার ও ধর্মীয় সংস্কৃতি নিয়ে যেসব বিকৃত লেখা প্রকাশ করছে; তা সব সভ্য লোকেরই অশ্রদ্ধা বা বিতৃষ্ণা লাগার কথা। যুক্তি, দর্শন, বিজ্ঞান ও পরামর্শমূলক লেখা কখনই অন্যায় নয়।

ধেনোবিদ্বান এসব লেখকের বিকৃত লেখা মাঝে মাঝে চোখে পড়ে। এরা বিকৃত লেখা না লেখে যদি বিজ্ঞান, দর্শন, সংস্কৃতি, নদী ও পাখী ইত্যাদি নিয়ে লেখতো; তবে তারা নিজেরাও উপকৃত হতো, জাতিও উপকৃত হতো। তাদের সময়ও অনেক বাঁচতো। কারণ একটা জাতির মেরুদণ্ড হচ্ছে শিক্ষা। যে বিষয় সম্পর্কে সে জানে না, সে বিষয় নিয়ে তার লেখার কোনো অধিকারই নেই। কথায় বলে “কামারের কাজ কুমোর দ্বারা হয় না।” ধর্মীয় মতবাদ বা সাম্প্রদায়িক মতবাদ নিয়ে লেখতে হলে অবশ্যই তার সাম্প্রদায়িক বা ধর্মীয় মতবাদ নিয়ে লেখাপড়া করতে হবে ।

- বিজ্ঞাপন -

মতবাদ, শাস্ত্র, সংস্কার ও সংস্কৃতি নিয়ে টিটকারী না মেরে, সমালোচনা না করে, ঠাট্টা না করে যদি তারা সংশোধনের চেষ্টা করতো, ভুল ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতো, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করার চেষ্টা করতো, তবে দেশ ও জাতি অনেক উপকৃত হতো।

মুক্তমনা, মুক্তবাজ, মুক্তজীবী ও মুক্তভৃৎরা মুক্তচর্চা করতে করতে এমন এক স্থানে গিয়ে উপস্থিত হয়েছে যে; শেষ পর্যন্ত তারা প্রত্যেকেই সমাজের শোষক শ্রেণীর বলির পাঁঠায় পরিণত হয়েছে। চিরদিনেই সমাজের পুঁজিবাদী শোষক-শাসক শ্রেণি, ধনীক শ্রেণি ও স্বার্থান্ধ শাসক গোষ্ঠী সমাজের এসব মুক্তবাজদের বলির পাঁঠারূপে ব্যবহার করে নিজেদের হীনস্বার্থে। যারা এদের প্রশ্রয় দিয়ে লালন করে, স্বার্থসিদ্ধির জন্য সুযোগ বুঝে তারাই আবার তাদের নিধন করে। চিরদিনই কথিত মুক্তমনা নামের এরূপ নির্বোধরা বিশ্বের পুঁজিবাদী ধনীক শ্রেণির হাতের পুতুল বা ক্রীড়ানক হয়ে থাকে।

ধর্মবাজ (Sectarian)

অন্যদিকে; ধর্মবাজ বলতে অন্ধভাবে সাম্প্রদায়িক মতবাদ বিশ্বাসী ও গোঁড়া শাস্ত্র-অনুসারীদের বুঝানো হয়েছে। গোঁড়া শাস্ত্রবাদীরা অনেকই জানে না যে; ধর্ম, শাস্ত্র ও মতবাদ কী, কাকে বলে এবং কত প্রকার? ধর্মবাজরা যাকে ধর্ম বলছে তা আদৌ ধর্ম নয়। বরং তা হচ্ছে মতবাদ। অন্যদিকে; ধর্ম হলো পদার্থের বৈশিষ্ট্য বা গুণাগুণ।

ধর্ম চিরন্তন, অনন্ত ও অবিনশ্বর। অন্যদিকে; মতবাদ, ক্ষণস্থায়ী ও আপেক্ষিক। ধর্ম Autogenous (অটোজেনাস) অন্যদিকে; মতবাদ মানুষের সৃষ্টি। ধর্মের ক্ষয়-লয় ও উত্থান-পতন নেই। অন্যদিকে; মতবাদের ক্ষয়-লয় ও উত্থান-পতন চিরাচরিত। এযাবৎ পৃথিবীতে কত মতবাদ সৃষ্টি হয়েছে আর মুখধুবড়ে ধ্বংস হয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এখনও পৃথিবীতে প্রায় ২,৫০০ মতো সাম্প্রদায়িক মতবাদ (কথিত ধর্মীয়) রয়েছে। তার মধ্যে ১৯ মতবাদ বৈশ্বিক। সব ধর্মীয় মতবাদের নির্মাণশৈলি এক ও অভিন্ন। সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, সংহারকর্তা, দৈবদূত, বসিধ, আদিমানব, আদিমানবী, অবতার, পাপ-পুণ্য, বিচার, স্বর্গ-নরক ও পরিণতি ন্যূনাধিক সব মতবাদেই আছে। বিশ্বের সব সাম্প্রদায়িক মতবাদেই একজন করে স্বর্গীয়দূত আছে- For this reason the Gabriel is called the Narada of India and the Hermes of Greek. অর্থঃ এজন্য; কুরানোক্ত জিব্রাইলকে ভারতের নারদ বা গ্রিকের হার্মিস বলা হয়। অর্থাৎ হিন্দু ও বৈদিকদের মতে ব্রহ্মার বাণীবাহক হচ্ছেন নারদ, গ্রিকদের মতে ঈশ্বরের বাণীবাহক হচ্ছেন Gabriel বা Hermes.
সবাই যার যার মতবাদ, শাস্ত্র, সাম্প্রদায়িক অবতার, সাম্প্রদায়িক পরিভাষা, সংস্কৃতি ও শাস্ত্রকর্ম ভালোবাসে। সাম্প্রদায়িকরা সবাই যার যার শাস্ত্রকে ঈশ্বর প্রদত্ত ও স্রষ্টা প্রদত্ত গ্রন্থ বলেই মান্য করে থাকে। যেমন- শিখ ধর্মগুরু নানক অগ্নিবীর গ্রন্থে পরিষ্কারভাবে লিখেছেন- “ওমকার বেদ নির্মায়ে।” অর্থঃ “ঈশ্বর বেদের নির্মাতা।”

গীতা মূলত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ওপর ভিত্তি করে রচিত একটি ধর্মগ্রন্থ, যে যুদ্ধে প্রায় চল্লিশ লক্ষ মানুষ হতাহত হয় এবং যার নেতৃত্বে ছিলেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। গীতাতে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন- “আমি জন্মহীন, অব্যয় আত্মা, ভূতগণের ঈশ্বর (শাসক, নিয়ন্তা, স্রষ্টা) হয়েও নিজ প্রকৃতিকে (অনির্বচনীয় মায়াশক্তিকে) আশ্রয় করে আত্মমায়ায় জন্মগ্রহণ করি।”

- বিজ্ঞাপন -

“গীতা সুগীতা কর্তব্যা কিমনৈঃ শাস্ত্রবিস্তরৈঃ৷ যা স্বয়ং পদ্মনাভস্য মুখপদ্মাদ্ বিনিঃসৃতা॥৪” অর্থঃ “যেহেতু; ভগবদ্ গীতার বাণী স্বয়ং পরম পুরুষোত্তম ভগবানের মুখনিঃসৃত বাণী, তাই এই গ্রন্থ পাঠ করলে আর অন্য কোনো বৈদিক পড়ার প্রয়োজন হয় না৷” গভীর নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে নিয়মিতভাবে ভগবদ্ গীতা শ্রবণ ও কীর্তন করলে সবার অন্তরে ভগবদ্ভক্তির স্বাভাবিক বিকাশ হয়৷

স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত বাণী গীতা। বিশ্বে বহু ধর্মগ্রন্থ রয়েছে। তমধ্যে বেদ প্রধান। বেদের রহস্য প্রকাশিত হয়েছে উপনিষদে। আর উপনিষদের সার হচ্ছে গীতা। তাই গীতাই বেদের মূল উপাদান। গীতা বেদ ভিন্ন অন্য কোনো গ্রন্থকে সমর্থন করে না। “যুদ্ধে জিততে হলে অস্ত্র ধরো না, গীতা ধরো। এতেই তোমার সাফল্য নিশ্চিত।”

তেমন কুরান সম্পর্কে কুরানে বলা হয়েছে- “وَإِنَّهُ لَتَنزِيلُ رَبِّ الْعَالَمِينَ” অর্থঃ “নিশ্চয় এটি বিশ্বজগতের পালনকর্তার নিকট থেকে অবতীর্ণ।” “Most surely this is a revelation from the God of the worlds.”
ইমাম গাজ্জালী ‘মিনহাজুল আবেদিন’ গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন- “স্বয়ং আল্লাহর পক্ষ থেকে আমার কাছে যে এলহাম এসেছে তা-ই আমি এ গ্রন্থে লিখেছি।”

- বিজ্ঞাপন -

এমনই ভাবে বিশ্বে এযাবৎ যেসব পুস্তক/ পুস্তিকা ধর্মগ্রন্থের মর্যাদালাভ করেছে, সেগুলো সবই ঈশ্বর প্রদত্ত। যেমন-
১. ইহুদিদের ‘Old Testament’ (তোরাত)।
২. কনফুসীদের ‘Lun-yu’ (লুন-ইউ)।
৩. খ্রিস্টানদের ‘New Testament’ (ইঞ্জিল)।
৪. জরথুস্ত্রদের ‘Avesta’ (আবেস্তা)।
৫. জৈনদের ‘জৈনধর্মদর্শন’।
৬. তাওদের ‘TaoTeChing’ (তাওতেচিং)।
৭. দ্রুজদের ‘রাসাইল আল-হিকাম’ (জ্ঞানগ্রন্থ)।
৮. নিওপ্লাটোদের ‘প্লেটোদর্শন’।
৯. বাহাইদের ‘الكتاب الأقدس’ (কিতাব ই আকদাস)।
১০. বৌদ্ধদের ‘ত্রিপিটক’।
১১. মাজদাকীদের ‘মাজদাক’।
১২. মুসলমানদের ‘কুরান’।
১৩. রাস্তাফারিদের ‘Piby’ (ফিবি)।
১৪. শাক্তদের ‘দেবীভাগবত পুরাণ’।
১৫. শিখদের ‘জ্ঞানসাহেব’ (গ্রন্থসাহেব)।
১৬. শিন্তোদের ‘Kojiki’ (কোজিকি)।
১৭. সামারিতানদের ‘Halacha’ (হ্যালেছা)।
১৮. হিন্দুদের ‘বেদ’।

তাই এসব পবিত্র গ্রন্থকে কোনভাবেই হেয় করা, ছোট করা ও গালি দেওয়া যাবে না। সাম্প্রদায়িকরা যার যার ধর্মগ্রন্থকে নিজের প্রাণের চেয়েও মূল্যবান মনে করে। ঠাক-পুরুৎ ও মোল্লা-মুন্সিরা আলোচনা করতে গিয়ে প্রায় সময় অন্যান্য মতবাদের গ্রন্থাদির মর্যাদাহানীকর ও কটুক্তিমূলক কথা বলে থাকে। মুক্তমনাদের নাস্তিক, যবন, কাফের, ধর্মত্যাগী ও ধর্মচ্যুত ইত্যাদি বলে গালাগালি করতে দেখা যায়। এ প্রকৃতির ধেনোবিদ্বান, অজ্ঞ ও মূর্খরাই প্রকৃত ধর্মবাজ। এরাই সমাজে বিচ্ছৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে অধিক পারদর্শী। শাস্ত্র ও সাম্প্রদায়িক গ্রন্থের মর্যাদা ও পবিত্রতা অটুট রাখা প্রত্যেক মানুষের নৈতিক দায়িত্ব।

অথচ বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক মতবাদের ঠাক-পুরুৎ ও মোল্লা-মুন্সিদের প্রতিনিয়তই একে অন্যের সাম্প্রদায়িক বা পারম্পরিক মতবাদগুলোকে গালাগালি ও টিটকারী করতে দেখা যায়। আর সুকৌশলে বিশ্বের শোষক-শাসক গোষ্ঠী তাদের এসব অজ্ঞতা ও দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করে থাকে। তারা ধার্মিক নামের মূর্খদের একদলকে অন্যদলের প্রতি আরও উষ্কে দেয়। অর্থ ও পদায়ন করার লোভ দেখায়। ঠাক-পুরুৎ ও মোল্লা-মুন্সিদের পিছে থাকার আশ্বাস দেয়। যখন একাধিক সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর মধ্যে সমর-সংগ্রাম আরম্ভ হয় তখন ক্ষমতাধর শোষক-শাসকরা অজ্ঞ সাম্প্রদায়িকদের কোনরূপ সাহায্য না করে বরং তাদের শোষণ করা জন্য ওঁৎ পেতে বসে। অবশেষে পুঁজিবাদী ধনীক শ্রেণির শোষকরা এদের ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির বলির পাঁঠারূপে।

এখন তথ্যপ্রযুক্তির বৈশ্বিক বিপ্লব ঘটেছে। বিশ্বের ইতিহাস জানা অত্যন্ত সহজ-সুলভ হয়েছে। ইতিহাস থেকে শিক্ষাগ্রহণ করার সময় এসেছে। এখন মুক্তবাজ ও ধর্মবাজদের সংযত হওয়ার সময় এসেছে। সময় এসেছে একে অন্যের ছিদ্রান্বেষণ ত্যাগ করে বিশ্ববাসীকে নতুন কিছু দেবার। সময় এসেছে তথ্যপ্রযুক্তির এতোসব আবিষ্কারের মধ্যে বিশ্ববাসীর জন্য আমি কি করেছি, আমি কি করছি এসব ভাবনার!

চলবে…

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
অনুসরণ করুন:
মিথলজি গবেষক
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!