যখন আমিরের জ্ঞান ফিরল, তখন সে নিজেকে একটি রুমের ভেতর বিছানায় শোয়া অবস্থায় দেখতে পেল। সে চারপাশে তাকালো এবং রুমটিকে ভাল করে লক্ষ্য করল। এটা ছিল ছোট একটি কক্ষ, জায়গায় জায়গায় দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়েছে। দরজার কাঠের নিচের অংশ ও জানালা নষ্ট হয়ে গেছে। যেহেতু বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলছিল, তাই সে আন্দাজ করল এখন সন্ধ্যার সময়। কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর তার সবকিছু মনে পড়ল।
সময়টা ছিল বিকেল বেলা, আমির তার বন্ধুদের সাথে মাঠে খেলছিল। হঠাৎ করে তার সাথে একটি ছেলের ঝগড়া হল, ঘুষি বিনিময়ও হল। অবশ্য, তার বন্ধুদের হস্তক্ষেপে তারা শান্ত হয়েছিল, কিন্তু আমিরের খুব মন খারাপ হয়েছিল। তাই সে মাঠ থেকে বেরিয়ে সোজা রাস্তায় চলে এলো। রাস্তা থেকে অল্প দূরত্বেই নদী, সে নদীর পারে এসে দাঁড়াল। ঝিরি ঝিরি বাতাস আর নদীর জলে ঢেউ বয়ে যাচ্ছে। আমির নদী দেখতে লাগলো। এমন সময় তার সামনে একটি গাড়ি এসে থামল। গাড়ি থেকে একজন লোক নামলো এবং তার কাছে একটি দোকানের কথা জিজ্ঞেস করল। রাস্তা বলে দিতে আমির গাড়িটার কাছে গেল। তৎক্ষণাৎ লোকটি তার পকেট থেকে একটি রুমাল বের করে তার মুখে চেপে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে সে লোকটির বাহুর উপর ঢলে পড়ল এবং লোকটি তাকে টেনে গাড়িতে ভেতরে প্রবেশ করিয়ে নিয়ে গাড়িটি জোরে চলতে লাগল।
আমির তার ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে এলো। ‘‘মনে হচ্ছে আমি অপহৃত হয়েছি। কিন্তু কেন? এটা কোন জায়গা? আমি কি এখান থেকে বের হতে পারব?’’ ভাবছিল আমির। এটা ভাবতে ভাবতেই সে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ছিল। সে বুঝতে পারছিল না তাকে কী করা উচিত! হঠাৎ তার বাবার কিছু কথা তার মনে পড়ল। ‘‘যদি কারো তার নিজের প্রতি বিশ্বাস থাকে, তাহলে সে সবকিছু করতে পারে। আত্মবিশ্বাস মানুষকে এমন শক্তি প্রদান করে যে, সে ইচ্ছে করলে চাঁদও জয় করতে পারে!’’
ধীরে ধীরে আমিরের আত্মবিশ্বাস বাড়তে থাকে। সে শক্তি ও সাহস দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলার সিদ্ধান্ত নিল। সে বুঝতে পারল, সাহস হারালে চলবে না। এই কক্ষ থেকে পালাতে হলে তাকে অবশ্যই শক্তি, সাহস ও বুদ্ধিমত্তার সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে।
আমির বিছানা থেকে প্রায় উঠেই যাচ্ছিল, এমন সময় সে দরজায় কতগুলো পায়ের শব্দ শুনতে পেল। সে সাথে সাথেই আবার বিছানায় শুয়ে পড়ল এবং ঘুমের ভান করতে লাগল। দরজা খুলে গেল এবং দুজন মানুষ রুমে প্রবেশ করল। একজনের হাতে একটি খাবারে প্লেট এবং আরেকজনের হাতে পানির গ্লাস। সেগুলো টেবিলের উপর রেখে একজন তার মুখে পানির ঝাপটা দিল। ঘুমের ভান করা আমির উঠে বসল।
অপহরণকারীদের একজন তাকে জিজ্ঞেস করল,‘‘তোমার বাবার নাম কী? তিনি কী করেন? আমির এমন ভাব করল, যেন সে কিছুই শুনে নাই। তখন আরেকজন বলল, ‘‘আরে শালা, সে ক্ষুধার্থ। খাওয়ার পর সে সবই বলবে।’’
আমির রাগের মাথায় খাবারের প্লেট মেঝেতে ছুড়ে ফেলল এবং চিৎকার করে বলল, ‘‘তোমরা আমাকে এখানে আটকে রেখেছো কেন? আমাকে যেতে দাও, আমার বাবা-মা চিন্তা করছে।’’
‘‘আমরা তোমাকে ছেড়ে দিব বাপু, কিন্তু তোমার বাবার কাছ থেকে আমাদের মাত্র পাঁচ লাখ টাকা সংগ্রহ করতে হবে।’’ অপহরণকারিদের একজন বলল। এটা শুনে আমির খুবই ক্ষিপ্ত হল এবং অপহরণকারী লোকটিকে আক্রমণ করল। কিন্তু হায়! লোকটি আমিরকে ধরে ফেলল এবং তাকে তিনটি থাপ্পর দিল। অন্য লোকটি তাকে বিছানার উপর ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল এবং চিৎকার করে বলল, ‘‘এখানেই একা থাকো। তুমি কোন খাবার ও পানি পাবে না। সকালে আমরা আবার আসব।’’ এসব বলে লোক দুটি কক্ষ থেকে বের হয়ে বাইরে থেকে বন্ধ করে দিল।
আমির তার ভুল বুঝতে পারল। নিজের উপর তার রাগ হল এটা ভেবে যে, তাদের সাথে সে পেরে উঠবে না এটা ভাল করে জানার পরও সে কেন বোকার মত হামলা করে বসল। তারা তো তাকে আরও মারাত্মকভাবে মারতে পারতো বা মারাত্মক কোন ক্ষতি করে বসতে পারতো।
আমির বিছানা থেকে উঠে গেল। সে পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করল। তাই সে জানালাটা খুলে ফেলল। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। জানালার লোহার শিকগুলো খুবই শক্ত। সে ভাবল, ‘যদি কোনভাবে একটা শিক তুলে ফেলা যায়, তাহলে এটা পালানোর একটা সম্ভাব্য পথ হতে পারে।’’
আমির জানালার শিকের উপর নিজের বল প্রয়োগ করার চেষ্টা করল। কিন্তু সেটি একটু নড়লও না। ‘এখন আমার কী করা উচিত?’ ভাবল আমির। হঠাৎ তার চোখে একটা আশার আলো দেখা গেল। তার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে। সে মেঝে থেকে খাবারের প্লেট টি তুলে নিল এবং বাতি নিভিয়ে দিল। সে দরজার কাছে গেল এবং প্লেটটা দিয়ে জোরে জোরে শব্দ করতে লাগল।
শব্দ শুনে কিছু সময় পর অপহরণকারীদের একজন দৌড়ে এসে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলো। আমির কোথায় যেন পড়েছিল, কারো ঘাড়ে জোরে আঘাত করলে সে অজ্ঞান হয়ে যায়। সে প্লেট দিয়ে অপহরণকারীর ঘাড়ে পুরো শক্তি দিয়ে আঘাত করলো। লোকটি জ্ঞান না হারালেও হঠাৎ আঘাত পেয়ে ভারসাম্য হারালো। আমির এই সুযোগটির অপেক্ষাতেই ছিল। সে দ্রুত রুম থেকে বের হয়ে বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে দিল। বাইরে ছিল ঘুটঘুটে অন্ধকার, তবে দূরে আলো জ্বলছিল। সে পূর্ণ শক্তিতে সেই আলোর দিকে দৌড় দিল।
এদিকে, ঘরে আটকা পড়া লোকটি জোরে জোরে দরজায় আঘাত করতে লাগলো। শব্দ শুনে তার সহকর্মী দৌড়ে এলো এবং দরজা খুলে দিল। কিন্তু সেখানে আমিরকে দেখতে না পেয়ে সে হতবাক হয়ে গেল। তখন দুজনেই বাইরে এসে আমিরকে খুঁজতে লাগলো এবং কিছু দূরেই তারা আমিরকে দেখতে পেল। তখন হুঙ্কার দিয়ে আমিরকে ধরার জন্য তারা ধাওয়া শুরু করল। আমির যখন অপহরণকারীদের শুনতে পেল তখন সে আরও জোরে দৌড় শুরু করল, কিন্তু প্রাণপন চেষ্টা সত্বেও তার ও অপহরণকারীদের মধ্যকার দূরত্ব কমে আসতে লাগলো। তখন আমির মাঠ পার হয়ে একটি রাস্তায় চলে পৌঁছে গিয়েছিল। রাস্তার মাথায় ছিল একটা গভীর খাদ। সে রাস্তার মাথায় যেয়ে বাঁক নিতে গিয়ে খাদের মধ্যে প্রায় পড়েই যাচ্ছিল, কিন্তু ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেল। আমির পিছনে ফিরে দেখলো অপহরণকারীরা দ্রুত এগিয়ে আসছে। আর কোন উপায় না পেয়ে সে গর্তের পাশে বাঁকে লুকিয়ে থাকলো। যখন অপহরণকারীরা সেখানে ছুটে এলো, তখন সে হঠাৎ করে তাদের দিকে তার পা এগিয়ে দিল (ল্যাং মারলো)। তখন দুই বদমাশই হোচট খেয়ে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে একেবারে খাদের মধ্যে ধপাস করে গিয়ে পড়ল। আমির তৎক্ষনাৎ সেখান থেকে দৌড়ে পালালো।
আমির সময় নষ্ট না করে সুন্দীলা রেলওয়ে স্টেশনে গিয়ে পৌছে গেল এবং দ্রুত লাখনৌ’র ট্রেন সম্পর্কে অনুসন্ধান শুরু করল। তাকে বলা হল ট্রেন প্রায় এসে গেছে। আমির এক কোনায় গিয়ে বসলো এবং অধীর আগ্রহে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। যখন ট্রেন আসলো সে দ্রুত ট্রেনে উঠে গেল। ট্রেনটি ধীরে ধীরে আবার চলা শুরু করেছে মাত্র, তখন হঠাৎ অপহরণকারীদের একজন স্টেশনে এসে পড়েছে এবং আমির যে ট্রেনে উঠেছে সেটাতেই ওঠার চেষ্টা করছে। আমির তাকে দেখে ফেলল, সে চোখের পলকে নিকটে বসে থাকা এক বৃদ্ধের লাঠি নিয়ে অপহরণকারির মাথায় আঘাত করলো। আঘাতে ভিমরি খেয়ে বদমাইশটা হাত ফসকে পড়ল গিয়ে ট্রেনের বাইরে। আমির হাফ ছেড়ে বাঁচলো। এদিকে ট্রেনের ভিতরের যাত্রীরা আমিরের এই অপ্রত্যাশিত আচরণের জন্য প্রস্তুত ছিল না, তারা ঘটনার কারণ জানতে চাইলো। তখন আমির তাদেরকে সবকিছু খুলে বলল। তখন সকলেই তার সাহসিকতার প্রশংসা করতে লাগলো।
এমন সময়ে সেখানে টিকেট চেকার প্রবেশ করলো। হঠাৎ আমিরের মনে পড়লো যে তার টিকেট নেই। এছাড়া জরিমানা দেয়ার মতো কোন পয়সাও তার কাছে নেই। আমির একটু দ্বিধায় পড়ে গেলো। কিন্তু টিকেট চেকারকে কিছু বলতে যাবার আগেই এক বয়স্ক দাদু চেকারকে আমিরের ভাড়াটা দিয়ে দিলেন। কারণ, তিনি আমিরের দ্বিধা দেখে তার অবস্থাটা বুঝতে পেরেছিলেন। আমির তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের চেষ্টা করল, কিন্তু দাদুটা তাকে বললেন, “তুমি আমার নাতির মতো, আর আমি আমার সাহসী নাতির জন্য গর্বিত।” স্বাভাবিক ভাবেই আমির এতে খুব খুশি হলো।
ট্রেনটা লখনৌ স্টেশনে পৌঁছলে আমির সেখানে নামার জন্য মনস্থির করলো, কিন্তু দাদুটার কাছ থেকে বিদায় নিতে তার সত্যিই খারাপ লাগলো। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি তাকে আপন করে নিয়েছেন। যাইহোক, ট্রেন থেকে লখনৌ স্টেশনে নেমে আমির সোজা ট্যাক্সি-স্টান্ডে গেল। তখন অনেক রাত। সৌভাগ্যবশত সে ট্যাক্সি ড্রাইভার আংকেল জাগালকে দেখতে পেল। সে দ্রুত আংকেল জাগালের কাছে যেয়ে তার ট্যাক্সিতে উঠে বসলো এবং তার কাছে সব খুলে বলল। ঠিক তখনই দ্বিতীয় অপহরণকারী সেখানে চলে আসলো। সে আমিরকে চিনতে পেরেই জাগান আংকেলকে বলল, এই ছেলেটাকে আমার হাতে তুলে দাও, সে আমার বাড়ির জিনিস চুরি করেছে।
কিন্তু জাগান আংকেল ছিলেন সুঠাম দেহের অধিকারী। তিনি অপহরণকারীকে সাথে সাথে ধরে সোজা থানায় নিয়ে পুলিশ ইনস্পেক্টরের হাতে তুলে দিলেন এবং তাকে পুরো বিষয়টি খুলে বললেন। পুলিশ ইনস্পেক্টর আমিরকে লক্ষ্য করে হাসি মুখে বললেন, বাছা, এই লোকটি একজন দাগী আসামী। তাকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য সরকার নগদ অর্থ পুরষ্কার দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে এবং সেটা এখন তোমারই প্রাপ্য। এটা শুনে আমির খুবই আনন্দিত হল। সে জাগান আংকেলের ট্যাক্সিতে করেই বাড়ি ফিরলো। আমিরের আব্বু-আম্মুও তাদের সন্তানকে ফিরে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। তারা জাগানের প্রতিও অনেক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন।#
গল্প: আত্মবিশ্বাস
এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
জন্ম ৯ জুলাই, ১৯৭২, ঢাকা বাংলাদেশ। ঢাকা কলেজ থেকে তিনি বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। এ পর্যন্ত যৌবনের যত্ন (২০১৮), ছাত্রজীবন: সাফল্যের শর্তাবলী নামে দুইটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
একটি মন্তব্য করুন
একটি মন্তব্য করুন