আকিমন বিবি মাছ ভাজছিলো। ভাতুরিয়া বিলের মাছের খ্যাতি এ তল্লাট জুড়ে। শীতকালে আশপাশের সব গাঁয়ের খাল-নালা যখন খটখটিয়ে আসে, ডোবাগুলোর তলায় যখন ডানকিনা ছাড়া আর তেমন কিছু মেলে না, তখনো ভাতুরিয়ায় নামলে খালই ভরে দশ পদের মাছ নিয়ে ঘরে ফেরা যায়। এ বিলের মাছের স্বাস্থ্যও খুব। কইগুলো ইয়া বড় বড়। টাকি-শোলগুলোন এত মোটা আর শক্তিশালী যে গিন্নীর হাতে জোর না থাকলে বাগে আনা শক্ত।
কথায় কয় – কই মাছের জান। হলুদ-নুন-বাটালঙ্কা মাখা কই মাছগুলো যখন আকিমন বিবি ফুটন্ত গরম তেলে ছাড়ছিলো তখন সেই মাছ এত জোরে লাফ দিয়ে উঠছিলো যে দুয়েকটা মাছ কড়াই ছেড়ে বাইরে পড়ছিলো। রওজান বিবির পরিষ্কারের বাতিক আছে। নিজ হাতে সে চুলোর পাড় রোজই আলো মাটি দিয়ে লেপে। মাছ তাই কড়াইয়ের বাইরে পড়লেও তাতে ময়লা-মাটি মাখে না। তবু সেই মাছ তুলে ধুয়ে আবার কড়াইতে ছাড়তে দেখলে রওজান বিবি আপত্তি করে, মাছখান বিলেইরে দেও বৌ। ওর বরাতে আছে বুলেই তো নাফ দে মাটিতি পড়িছে।
আকিমনের কাছে ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি ঠেকে। কই মাছ খুব দামী পদার্থ বলে নয়; কথা হলো – মাছটা কুটে-ধুয়ে, ঝাল-নুন মাখাতে যে কষ্টটা করতে হইছে তা তো বিড়ালের ভোগে লাগার জন্য না। বিড়ালে খাবে? খাক না। কোটা-বাছার আগে খাক।
চুলোর পাড়ে বসে বেগুন কুটে দিতে দিতে হিরণবালা ফিরে ফিরে বিড়ালের মাছ খাওয়া দেখে। ছোঁচা বিড়াল মাছটা ছুঁড়ে দেয়া মাত্র ছোঁ মেরে নিয়ে আরেকটু দূরে যেয়ে পিছন ফিরে খেতে শুরু করছে। আকিমন বিবি দাঁত কটমটিয়ে বলে, বিলেই মাছ খাচ্ছে দেহে কি তুমার নাল পড়তেছে? আরেকখেন মাছ নাফ দিলি তুমিই ধরে খায়ো।
হিরণবালা মাথা বটির ডগায় ঠেকিয়ে রেড়ির তেলে জ্বালা পিদিমের ক্ষীণ আলোয় বেগুন কাটতে থাকে। হঠাৎ কী হয় – হিরণবালা উহ্ করে ওঠে। অদূরে বসে রওজান বিবি দুটো পাটকাঠির আগায় জ্বালতে থাকা আগুন কড়াইয়ের কাছে বিভিন্ন কৌশলে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ধরে সেই আলোয় আকিমন বিবির মাছ ভাজায় সহযোগিতা করছিলো। হিরণবালার উহ্ শুনে রওজান বিবি পাটকাঠির আলোটা তার দিকে বাড়ায়ে ধরে জানতে চায়, কী হৈলো?
হিরণবালা বাঁ হাত দিয়ে ডানহাতের একটা আঙ্গুল চেপে ধরে কাতর শব্দ করে। আকিমন মাছ উল্টানো থামায়ে একবার চেয়ে দেখে। রওজান বিবি আগুনসহ পাটকাঠি চুলোয় গুঁজে দিয়ে উঠে আসে হিরণবালার পাশে। রেড়ির পিদিমটা উঁচায়ে ধরে জানতে চায়, কহানে কাটিছে?
হিরণবালা কথা কয় না, খালি একটা কাতর শব্দ করে।
আঃ! কতা কইস না ক্যা আবাগীর নাতিন? দেহি, হাত সরা।
হিরণবালা ডান হাতটা মেলে ধরে। অমনি মধ্যমার মাথা দিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত ঝরতে থাকে।
ইস্! কত হানি কাইটছে! খাড়া, ঝাড়মনি লতা নিয়ে আসি।
খোলা আসমানের নিচে উঠোনের কোনায় যে চুলোর পাড় তার ওপাশে রান্নাঘর কাম ঢেঁকিঘরের পিছনে সিঁদুরে আমগাছ, একটা ছোট বাঁশঝাড়, আর একটা খুদিজাম গাছের পিছনেই বাড়ির নাবালে বেতঝোপের গাঁ বেয়ে তরতরিয়ে ওঠা প্রচুর ঝাড়মনি লতা। কোথাও কেটে-কুটে গেলে এর পাতার রস খুব কার্যকর। রওজান বিবি পাটকাঠির আলো হাতে এসে খুব সাবধানে নাবালের দিকে একটুখানি নেমে পাতা তুলতে চেষ্টা করে। কিন্তু হঠাৎ করেই সে পা হড়কে পিছলে যায় বেশ খানিক। নিজের অজান্তেই সে আর্তস্বরে চিৎকার করে ওঠে।
রমিজ মিঞার বরাবরই দেরি করে হাট থেকে ফেরা অভ্যাস। হাটের শেষ হাটুরে ঘরমুখো যাত্রা না করা পর্যন্ত রমিজ মিঞা এ দোকান সে দোকান করে আর দ্বীন-দুনিয়ার খবর সংগ্রহ করে। ঊনিশ শতকের শেষদিকের গ্রামজীবনের পক্ষে গভীর রাত করে বাড়ি ফেরা রমিজ মিঞা এ রাতে বাড়ি ফেরে আরো যেন দেরিতে। শাশুড়ির পায়ে জলপট্টি বেঁধে ঝিমুতে থাকা আকিমন বিবি চমকে চমকে ওঠে কাতোরোক্তির শব্দে, কুকুরের ঘেউ ঘেউয়ে, শরাফতের মশা মারার আওয়াজে এবং তার বেহায়াপনার কাণ্ডে।
উত্তরঘরের মেঝেয় পাটিপাতা বিছানায় শুয়ে আছে রওজান বিবি। তার পা ভাঙ্গছে নাকি মচকেছে তা ঠিক বোঝা না গেলেও ব্যথা যে গুরুতর তা বেশ বোঝা যাচ্ছে। পাশেই একটা খেজুরপাতার পাটিতে গুটিসুটি মেরে শুয়ে ঘুমায়ে পড়েছে হিরণবালা। এত ব্যথা-বেদনার মধ্যেও রওজান বিবি সেদিকে আকিমনের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেঃ অ বৌ! দ্যাক না নাত বৌয়ের কাণ্ড! জাড় এহনো শ্যাষ হই নেই, এরোম সুময় ক্যাথা ছাড়া খালি শপে কেউ শোয়?
আকিমন বিবি শাশুড়ির কথায় অনুরুদ্ধ বোধ করে হিরণবালাকে দু-চারটে ডাক দিয়ে ক্ষান্ত দেয়। মুখের কথায় হিরণবালার ঘুম ভাঙ্গাবার সাধ্যি কারো নেই। হাঁক-ডাক, ঠেলা-ধাক্কা, এমনকি বংশ-গোত্র উদ্ধার হওয়া গালাগালিতেও হিরণবালার ঘুমে কিছুমাত্র ব্যাঘাত না ঘটলেও সেই আওয়াজের অছিলায় এসে দরজায় দাঁড়ায় শরাফত মিঞা।
মা, কী অইছে? লবাবের লাতিনের লবাবি ঘোম ভাঙ্গে না?
হ, ভাঙবি! তা তুই ঘোমেত্থে উঠে আলি ক্যা?
বাজান এহনো ফিরি নেই। আমার ঘোম আইসতেছে না।
পুত্রের এহেন পিতৃপ্রেম আকিমন বিবিরে তুষ্ঠ করে না। তিতিবিরক্ত স্বরে চিবায়ে চিবায়ে সে বলে, তুমার বাপজান হাটবারে রাইত করে বাড়ি ফেরে ইডা তুমি জানো। নুকমান নন্টন নিয়ে গেছে তারে আগায় আনতি। তুমি বাপ তুমার ঘরে যায়ে ঘুমাও।
কিন্তু তার উপদেশ কানে না তুলে পুত্র দরজা জুড়ে দাঁড়ায়ে থেকে ভেতরে গলা বাড়ায়ে কী যেনো খোঁজে। কী যে খোঁজে তা আকিমন ভালোই বোঝে। ‘ছিঃ ছিঃ!’ আকিমন ভাবে, ‘শরাফতের বাপ তো কুনোদিন এমন বেলাজ ছিলো না!’
এগারো কি বারো বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিলো আকিমন বিবির। বেশি রকম বাড়ন্ত গড়নের হওয়ায় তারে দেখাতো আরো অনেক বড়। তাই বৌয়ের বয়স নিয়ে পাড়া-প্রতিবেশিদের কাছ থেকে শাশুড়ি রওজান বিবির কম কথা শুনতে হয়নি। রওজান অবশ্য এজন্য কখনো ব্যাটার বৌয়েরে দোষারোপ করেনি। নিন্দুকের মুখ বাসী আখার ছাই পুরে বন্ধ করার হিম্মত রওজানের ছিলো না। সে শুধু নরম স্বরে তাদের বোঝাবার চেষ্টায় বলতো, বয়স আর ওর কী এমন! হরিশপুরির সর্দার বাড়ির ঝি, সাত ভাইর এক বুন। মোকাম সর্দারের ছয়-ছয়ডা গুলা ভরা ধান, সায়রের মতন পুষ্কন্নী ভরা মাছ, পাঁচটা বছর বিয়েনি গাই; এই এক বিটি যা খাইছে-পিন্দিছে…..।
মোকাম সর্দারের সংসারের সচ্ছলতার বর্ণনায় নিন্দাকারিণীদের দ্বিমত না থাকলেও মতপার্থক্যের প্রকাশ ঘটত আকিমনের বয়সোনুচিত বাড়-বৃদ্ধির ব্যাপারে। গাও-গেরামের মুখরা নারী – যুক্তির ধার ধারে বড় কম। তাই ক্ষুণ্ণ মনে গলা চড়ায়ে তাদের কেউ প্রতিবাদের স্বরে বলত, সে তুমি যাই কও, বয়স এট্টু বেশিই হইছে। বৌ মানুষ দুই-চার বচ্ছর পায় মল পিন্দে ঘুরবি-ফিরবি, তা বাদে ডাঙ্গর হবি, তা না, তুমি এট্টা মোটে ছাওয়ালের বৌ ঘরে আইনলে এহনই ছাওয়ালের সুমান!
রমিজ মিঞা খাটো-ক্ষীণ দেহের মানুষ। তার তুলনায় আকিমন বিবি সে কালেই এক পাহাড়। আর বছর কয়েক পরে আড়ে-দীঘে সে এমন হয়ে দাঁড়ায় যে স্বামী হিসেবে রমিজ মিঞারে তার পাশে বড় বেমানান ঠেকত। যে কটূভাষিণীরা আগে তার বয়স নিয়ে খোঁটা দিত, তারাই পরে হাসি-মষ্করা করে রমিজ মিঞার দেহ আর আকিমনের মন আরো সঙ্কুচিত করে ফেলেছিল। স্বামীর সাথে একান্ত সময়ে আকিমনের মনে পড়ত পাড়ার মেয়েদের ঝকঝকে, ত্যাড়াবাঁকা, পানখাওয়া, গুলমাখা দাঁতের হাসি। পলকে যেন মনের সাথে তার দেহটাও গুটিসুটি মেরে যেত। আকিমনের বিশাল দেহের কোন কোনে তার মনের ঠাঁয়-ঠিকানা, বয়সকালে বহু হাতড়েও রমিজ মিঞা তার সুলুক-সন্ধান করতে পারেনি। তবু, তবু কোনো দিন কি প্রকাশ্যে এমন নির্লজ্জ্ব হয়েছিল রমিজ মিঞা?
রমিজ মিঞা ঘরে ফিরেছে। মায়ের দুর্দশা একবার চোখের দেখা দেখে সে নিজের ঘরে ঢুকে ঢাকা ভাত খেয়ে শুয়েও পড়ছে। আকিমন বিবি শাশুড়ির সিথানে মাথার নিচে বাহুকে বালিশ করে শুয়ে কখন যেন ঘুমায়ে গেছে। এ ঘরটাতে রওজান বিবি রাতে একটা খেজুর পাতার পাটির পরে কাঁথা পেতে ঘুমায় আর দিনে পাড়া-পরতিবেশিরা এ ঘরে বসে গল্প করে, পান-তামুক খায়। আকিমনও দিনের অবসরে এ ঘরে বসে কাঁথা সেলাই করে, খেজুর পাতার শপ বোনে।
রওজান বিবির একটা তেলচিটে বালিশ আর দুইখান পুরনো ক্যাথা ছাড়া এ ঘরে এমন কিছু মহার্ঘ্য বস্তু নেই যাতে চোর-ডাকাতের চোখ পড়তে পারে। কাজেই ঘরটাতে কবাট লাগানোর দায় কেউ বোধ করেনি। চাটাইয়ের বেড়ার ঘরে এক পাল্লার চাটাইঝাঁপ ঘরে শেয়াল-কুকুরের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করে। সেই ঝাঁপ গভীর রাতে যেন আপনাআপনি খুলে যায়। রেড়ির তেলের পিদিম জ্বলে জ্বলে নিভু নিভু হয়ে নিভে গেছে কখন। বেড়ার ফাঁক-ফোকর দিয়ে যেটুক জোছনার আলো ঘরে ঢোকে, সেই আলোতেই কাজ হয়। প্রভূত্বের অধিকারবোধে নির্বোধ হয়ে থাকা পৌরুষের জ্বলজ্বলে শ্বাপদ চোখ দেখতে থাকে হিরণবালাকে।
সকালে দেখা যায় হিরণবালা রওজান বিবির বুকের কাছে শুয়ে। তার দুচোখে বাসি কান্না ও ঠোঁট-গাল-গলায় রক্তজমা দাগ।
চলবে …