গতকাল একটি মর্মান্তিক ঘটনা শুনেছি। দেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপককে তাঁরই বিভাগের ছাত্ররা গায়ে হাত তুলে লাঞ্চিত করেছে। তাঁর অপরাধ, তিনি ক্লাসে ফ্রয়েড পড়াচ্ছিলেন। এতে নাকি ধর্মের অবমাননা হয়ে গেছে!
আমি ভদ্রলোকের ছবি দেখলাম। যদিও ফেসিয়াল এস্তেটিক্সে জ্ঞান-গরিমার সম্পর্ক আমি অতোটা খুঁজি না, তারপরও মনে হলো— তাঁর ব্যক্তিত্ব, জেন্টলম্যানশিপ, ও পাণ্ডিত্যের ছাপ চেহারায় লেগে আছে। এরকম একজন প্রবীণ অধ্যাপককে ধর্মীয় অবমাননার ছুতো তুলে শারীরিকভাবে আক্রমণ করা হলো, এটি কল্পনা করতেই আমার গা শিউড়ে উঠছে। সভ্য সমাজ তো নয়ই, কোনো জঙ্গলেও আমি কল্পনা করতে পারি না যে, সাহিত্য পড়ানোর অপরাধে একজন শিক্ষককে তাঁর ছাত্ররা লাঞ্চিত করছে।
যারা ফ্রয়েড পড়েছেন, তারা জানবেন যে— ফ্রয়েডের সাহিত্যকর্মের একটি বড় অংশ জুড়েই রয়েছে সাইকোএনালাইসিস। তিনি লাঁকা বা কার্ল জুংদের জনক। ফ্রয়েডীয় লিটারেচারের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি মানুষের আচরণগুলোকে অবদমিত কাম, অবদমিত আকাঙ্ক্ষা বা রিপ্রেসড ডিজায়ার, এসবের সাহায্যে খুব সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করতেন। তিনিই প্রথম বৈজ্ঞানিক পন্থা অবলম্বন করে মানুষের স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। ফলে ফ্রয়েড বিষয়ে যেকোনো লেকচারে অনিবার্যভাবেই যৌনতার বিষয়টি চলে আসে। আমি আমার বিশ্বসাহিত্য ভাষণে ফ্রয়েড নিয়ে যে-পর্বটি লিখেছি, সেখানেও এ বিষয়গুলো আছে। আমার খুবই অবাক লাগছে, এরকম একটি জীবনঘনিষ্ট বিষয় কীভাবে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে! সম্ভবত শ্রোতারা সবাই নিজেরাই ফ্রয়েডের রোগী। অন্যথায় ফ্রয়েডীয় লিটারেচার তাদের গায়ে লাগার কথা নয়।
যাদের কথা ছিলো হামদ-নাত শুনে জীবন কাটানোর, তারা গিয়ে বসে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। গিয়ে ওস্তাদকে দিক-নির্দেশনা দিচ্ছে, এই এইভাবে পড়াবেন, এই এই বিষয় পড়াবেন, অন্যথায় আমাদের অনুভূতি আহত হবে। ফ্রয়েডের রোগীদের অনুভূতি খুব প্রচণ্ড থাকে, কারণ তাদের রিসেপ্টর সেল স্বাভাবিক মানুষ থেকে আলাদা। এ রোগীরা সবকিছুকে ধর্মের লেন্স দিয়ে দেখতে পছন্দ করে। ধর্মকে বুকে ধারণ করার বদলে চোখের চশমা হিশেবে ব্যবহার করতেই এরা অধিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। কারণ আমলের চেয়ে প্রদর্শনীতেই এদের জোর বেশি। এই মাস্টারবেইটিং এনিম্যালগুলো ইংরেজি সাহিত্য পড়তে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেছে, এটি খুবই আচানক ঘটনা। এতো ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে তো লিটারেচার পড়তে যাওয়ার কথা নয়। এদের সামনে সফোকলের নাটক নিয়ে কথা বলাও বিপদ হবে। লরেন্সের সান্স অ্যান্ড লাভার্স বা নবোকভের ললিতার কথা বাদই দিলাম। এমনকি এরাবিয়ান নাইটসের শেহেরজাদি চরিত্রটিও যদি আমি বিশদভাবে বিশ্লেষণ করি, তাহলে এরা পায়জামা নষ্ট করে ফেলবে। জালালুদ্দিন রুমির একটি কবিতায় সঙ্গম ও বীর্যপাতের গ্রাফিক বর্ণনা রয়েছে। এটি পড়লে এদের কী অবস্থা হবে, তা ভেবে আঁতকে উঠছি। নাকি মূর্খরা ভেবেছে, রুমি শুধু আধ্যাত্মিক কবিতাই লিখেছেন? এরকম জঙ্গলি যৌনরোগীরা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে?
আমি যখন বিশ্বসাহিত্য ভাষণের তলস্তয়, গোর্কি, দস্তায়েভস্কি, জেমস জয়েস, ও পুশকিন খণ্ডের কয়েকটি পর্ব ফেসবুকে প্রকাশ করি, তখন কিছু স্থান থেকে আমার কাছে লেকচারের আমন্ত্রণ আসে। এখন আমার মনে হচ্ছে, এ আমন্ত্রণগুলো প্রত্যাখ্যান করার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিলো। এরকম একটি বুনো এলাকায় খোলা মনে কোনো বিষয় নিয়েই কথা বলা সম্ভব নয়।
লাঞ্চনার শিকার এই প্রবীণ অধ্যাপক এখন চাকুরি ছেড়ে দিয়ে নিভৃতচারী হয়ে গেছেন। এই বয়সে সন্তানের বয়সী ছাত্রদের হাতে লাঞ্চিত হওয়া, এটি যে কতো বড় মানসিক বিড়ম্বনার বিষয়, কতো গভীর বেদনার বিষয়, তা লিখে বুঝানো সম্ভব নয়। কী লাভ হলো, এরকম একজন নির্মোহ পণ্ডিত অধ্যাপককে অপমান করে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে? এগুলো কি কোনো ইসলামসম্মত কাজ? এগুলো আল্লাহর নির্দেশনা? যে-কাজ আল্লাহর করার কথা, সে-কাজ নিজেরা করে কি ছাত্ররা আল্লাহর ওপর বিজয় ঘোষণা করে ফেলেছে? ইসলামের কাজ কি ধর্মসম্মত সাহিত্য ও ধর্মসম্মত বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠা করা? এ ধরণের পাগলামির শেষ কোথায়?
হাউ শার্পার দ্যান আ সার্পেন্ট’স টুথ ইট ইজ টু হ্যাভ আ থ্যাংকলেস চাইল্ড? (কিং লিয়ার, শেক্সপিয়ার)
লেখক: মহিউদ্দিন মোহাম্মদ
সোস্যাল মিডিয়া থেকে।