বস্তুজগত ভাবজগতকে প্রভাবিত করে, তেমনি ভাবজগত আবার বস্তুজগত ও বস্তুজাগতিক চিন্তাকে প্রভাবিত করে। কোনটাই এমনি এমনি হয়, এমনটা নয়। উভয়েই একে অপরের পরিপূরক ও সম্পর্কযুক্ত। বস্তুজগৎ তার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও বিশ্ব জগত প্রকৃতি পরিবেশের পরিমন্ডল নিয়েই গড়ে উঠে এবং গড়ে উঠে তার ভাবনাজগৎ। আর ভাবজাগতিক চিন্তা বদলে দেয় প্রকৃতিকে ও পৃথিবীকে।
ধর্মকে পরিত্যাগ করেছিল যে শিল্প বিপ্লবের (রেনেঁসার) বুর্জোয়ারা। আজ কিন্তু সেই ব্যাক্তি স্বাধীনতা, মুক্তচিন্তা, বাকস্বাধীনতা ও নারী স্বাধীনতার প্রবক্তা শিল্প মালিকেরা- অধিক মুনাফা ও শ্রমিকের শ্রমশোষণের মধ্য দিয়ে এক শোষিত সর্বহারা শ্রমিকশ্রেণির জন্ম দেয়। এবং নতুন উৎপাদন সম্পর্কের ভিত্তির কারণে শ্রমিকশ্রেণী, ভূমিহীন কৃষক-ক্ষেতমজুরসহ গনতন্ত্রকামী মুক্তচিন্তার জনগন সৃষ্টি করে। অর্থাৎ পুরাতন সামন্ততান্ত্রিক সমাজের বস্তুজগৎ ও ভাবজগত পরিবর্তিত হয় এবং শিল্পবিপ্লবের পুঁজিবাদ সৃষ্ট নতুন বস্তুজগৎ ও ভাবজগত থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষিত আরও একটি নতুন ভাবজগত তৈরি হয়। যা জার্মানির বিশিষ্ট মার্ক্সবাদী দার্শনিক কার্লমার্ক্স’র মধ্য দিয়ে সমাজ অভ্যন্তরে নতুন বস্তুজগত (সমাজতান্ত্রিক সমাজ রাষ্ট্র) সৃষ্টির প্রসব বেদনার জন্ম দেয়।
এই সর্বহারা শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লবভীতির ফলে বুর্জোয়ারা একদিকে আপোষকামী, ক্ষয়িষ্ণু ও অপরদিকে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে ধর্মকে আপোষরফার মাধ্যমে রাজনীতির সাথে যুক্ত করে। এবং লড়াকু সর্বহারা শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লবের সাথে যুক্ত সহযোগী কৃষক-ক্ষেতমজুর ও শোষিত জনগনের মধ্যে বিভক্তির জন্যই ধর্মকে ব্যাবহার করতে শুরু করে। আর সেটা বুর্জোয়াশ্রেণী তাদের শ্রেণীরাষ্ট্র’কে দিয়েই করে বিপ্লবভীতির কারণ থেকে। তাহলে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদ কি আজ এতই ভঙ্গুর হয়ে গেছে বা বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলনের গতি কি এতই শক্তিশালী হয়েছে যে বুর্জোয়াশ্রেণী ও তাদের রাষ্ট্রযন্ত্র ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক চর্চা বন্ধ করে দিয়ে তার থেকে সরে আসবে? বস্তুজগৎ ও তার ভাবজগতের বৈপ্লবিক পরিবর্তন ছাড়া ধর্মভিত্তিক অপার্থিব অলৌকিক ভাবজগতের পরিবর্তন এমনি এমনি হবে বা হয়েছে সেটা মনে করার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই। এমন ব্যাখ্যা থাকা দরকার।
ধর্ম এখন শুধু মানুষের ব্যাক্তিগত পছন্দ বা অপছন্দের বা ব্যাক্তিগত পারিবারিক চর্চার ব্যাপার নয়, এটা এখন একটা বুর্জোয়াদের রাজনৈতিক শক্তি (political force) এবং সবচেয়ে কার্যকরী মিলিট্যান্ট শক্তি যাঁদের চেতনা মধ্যযুগীয়। রাষ্ট্রের আমলা, সেনাবাহিনী, বিচারবিভাগ, আইনবিভাগ বিপ্লবী অভ্যুত্থানের একটা পর্যায়ে অথর্ব বা অকার্যকর (collops) হতে পারে। এমনকি সেনাবাহিনী সহ অনেকেই বিপ্লবের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায় বিপ্লবের চূড়ান্ত মূহুর্তে। চীন-রাশিয়ার বিপ্লবের ইতিহাসে তার উদাহরণ অনেক আছে। কারণ সেখানে মধ্যবিত্ত জনগনের সন্তানের একটা বড় অংশই অবস্থান করে। তাই সে সম্ভাবনার ইতিহাস বুর্জোয়াশ্রেণী খুব ভাল করে পাঠ করে নিয়েছে। আজ বুর্জোয়াশ্রেণী ও বুর্জোয়া রাষ্ট্র পিছিয়ে পড়া মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় বা লালিতপালিত করছে, বেড়ে তুলছে এক দানবীয় পশুশক্তি। যাদের নীতি-নৈতিকতা, রুচি-সংস্কৃতি, মানবিক মূল্যবোধহীন, মানবিকতাহীন, পারলৌকিক বিকৃত স্বর্গীয় যৌনচর্চা- পার্থিব ভাবনা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছে। বুর্জোয়াদের আরও একটি নিজস্ব সবচেয়ে বিশ্বস্ত কর্পোরেট পুঁজির সৃষ্ট মিডিয়া এক ভয়ঙ্কর ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। বিপ্লবীশক্তির উত্থান ছাড়া, শুধুমাত্র কিছু সেক্যুলার মানুষ দিয়ে মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণার ধর্মীয় দর্শন ও তার মদদদাতা বুর্জোয়া ও তাদের পুঁজিবাদী রাষ্ট্রযন্ত্র কোনভাবেই রুখে দেওয়া সম্ভব নয়।
এ আমার একান্তই ব্যক্তিগত মতামত।
লেখক: অতিঙ্কর শ্যামল
(সোস্যাল মিডিয়া থেকে)