সঞ্জয় গান্ধীর মৃত্যুর পরে অবশেষে রাজীব গান্ধী রাজনীতিতে অবতীর্ণ হলেন। প্রিয়দা, সৌগতদা এবং নান্টুদা সহ বহু নেতা আবার কংগ্রেসে ফিরে এলেন। এদিকে উগ্রপন্থী বিচ্ছিন্নবাদী শিখ নেতা খালিস্তানের দাবিতে আন্দোলন জোরদার করে তুলেছে। স্বর্ণ মন্দির দখল করে সেখান থেকে খালিস্তানি আন্দোলন পরিচালনা করতে লাগলেন এবং দেশবিরোধী বিবৃতি দিতে লাগলেন। সদ্য পুত্রহারা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নিজের পুত্রশোক ভুলে স্বর্ণ মন্দিরে সামরিক অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে দেশের সমস্ত বিরোধী দলের নেতাদের সাথে আলোচনা করলেন। একালের রাজনীতিতে বর্তমান শাসক দলের কাছে বিরোধী দলের মতামত গ্রহণ করা কল্পনা করা যায় না।
অপারেশন ব্লুস্টার কি ছিল? কেন এই অভিযান পরিচালনা করা হয়েছিল?
১৯৮৪ সালের জুনের প্রথম সপ্তাহে ভারতীয় সামরিক বাহিনী হরমন্দির সাহেব বা স্বর্ণ মন্দির চত্বরে একটি অভিযান চালায়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে পরিচালিত এই অপারেশনটি শিখ চরমপন্থী ধর্মীয় নেতা জারনাইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালে এবং তার সশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠীকে নির্মূল করে পবিত্র স্থানের পবিত্রতা রক্ষার জন্য করা হয়েছিল। ভিন্দ্রানওয়ালে, যিনি পাকিস্তানের আইএসআই এর সমর্থিত ছিলেন, তার দাবিগুলি স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন – তিনি চেয়েছিলেন ভারত সরকার এমন একটি প্রস্তাব পাস করুক যা ভারতকে বিভক্ত করে দেয়। যার ফলে শিখদের জন্য একটি নতুন দেশ তৈরি হয় যার নাম ‘খালিস্তান’।
উগ্র বিচ্ছিন্নতাবাদী জারনাইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালে ১৯৮২ সালে তার দাবির ভিত্তি স্থাপন শুরু করেছিলেন এবং ১৯৮৩ সালের মাঝামাঝি ভারতকে বিভক্ত করতে তিনি নিজ পরিকল্পনার সমর্থন লাভ করতে সক্ষম হন। তার অপারেশন এবং পরিকল্পনাগুলো পাকিস্তানের আইএসআই দ্বারা সমর্থিত ছিল, যা তাকে রাজ্যে জঙ্গিবাদ বিস্তারে সহায়তা করেছিল এবং তাকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করেছিল।
১৯৮৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে, ভিন্দ্রানওয়ালে এবং তার সশস্ত্র জঙ্গি গোষ্ঠী স্বর্ণ মন্দিরে (হরমন্দির সাহেব কমপ্লেক্স) প্রবেশ করে এবং এর নিয়ন্ত্রণ নেয়। তারপর তারা ভিতরে একটি ঘাঁটি স্থাপন করে। সশস্ত্র জঙ্গিদের কাছ থেকে স্বর্ণ মন্দিরের নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে নেওয়া এবং এর পবিত্রতা রক্ষা করা সহজ ছিল না। শিখদের জন্য সবচেয়ে পবিত্র স্থান হওয়ায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া আরও কঠিন ছিল। কিন্তু প্রায় এক বছর পরামর্শ এবং আলোচনার চেষ্টা করার পর, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে সামরিক অভিযানই একমাত্র উপায়- তা ছাড়া স্বর্ণ মন্দির উগ্রপন্থীদের হাত থেকে উদ্ধার করা সম্ভব নয়।। এর ফলে অপারেশন ব্লুস্টার শুরু হয়।
২ জুন ১৯৮৪, গভীর রাতে ভারতীয় সেনাবাহিনী অপারেশন ব্লুস্টার চালায়। সারা পাঞ্জাবে কারফিউ জারি করা হয়েছিল। কাউকে রাজ্যে ভ্রমণ করতে দেওয়া হয়নি। যোগাযোগের সকল মাধ্যমও বন্ধ ছিল। সে সময়ে ইন্দিরা গান্ধী পরে বলেছিলেন, ‘দেশের স্বার্থে তার জীবনের সবচাইতে স্বর্ণ মন্দিরে সামরিক অভিযানের কঠিন সিদ্ধান্তটি নিতে হয়েছিল।’ এরপরে ৩১ শে অক্টবর ১৯৮৪, সকালে ইন্দিরা হত্যার সেই মর্মান্তিক করুণ ঘটনার সাক্ষী হলাম আমরা।
ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকাণ্ড: লৌহমানবী তার বিশ্বস্ত দেহরক্ষীর হাতেই খুন হলেন।
৩১ শে অক্টবর ১৯৮৪, বারাসাতে আমার কর্মস্থলে রেডিওতে একদিনের ক্রিকেটের রীলে শুনছিলাম বাংলাদেশ রেডিওতে। ভারতের বিপক্ষে কোন দেশ খেলছিল আজকে আর মনে করতে পারছি না। ভারত দারুণ ব্যাট করছিল। হঠাৎ রীলে বন্ধ হয়ে গেল। ঘোষিত হলো বিশেষ সংবাদ, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তারই বিশ্বস্ত দেহরক্ষীর দ্বারা আক্রান্ত! তাকে সঙ্কটজনক অবস্থায় হাসপাতেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আজ সকালে তার দেহরক্ষী তাকে গুলি করে। ব্যাস ঐটুকুই। রেডিও স্তব্ধ হয়ে গেল। আমি আঁতকে উঠলাম, উৎকণ্ঠ চিত্তে প্রিয় নেত্রীর অবস্থা সমন্ধে জানবার জন্য বিভিন্ন রেডিও সেন্টার ধরে খবর শুনবার জন্য চেষ্টা করলাম কিন্তু সব সেন্টার স্তব্ধ। বাইরে এসে দেখি দোকানদাররা স্বেচ্ছায় দোকানপাট সব টপাটপ বন্ধ করে দিচ্ছে। আমরাও কর্মস্থল বন্ধ করে দিলাম। সমস্ত যানবাহন চলাচল বন্ধ। যদিও কেউ জোর করে বন্ধ করেনি। আকাশের মুখটাও যেন ভারাক্রান্ত। রাস্তায় সবাই হাঁটছে বিষণ্ন মুখে। রেল লাইন ধরে মানুষের ঢল, সবাই হেঁটে বাড়ি ফিরছে, কারও মুখে হাসি নেই, সমস্ত কিছু বন্ধ বলে কেউ বিরক্তও নন। সবাই যেন অব্যক্ত ভাবে বলতে চাইছে লৌহমানবীর নৃশংস হত্যার প্রতিবাদ তো এমন করেই করা উচিৎ। আমি তখন বারাকপুর শহর ছাত্রপরিষদের সভাপতি এবং জেলা ছাত্রপরিষদের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য। বাড়ি ফিরবো কিভাবে? এক বন্ধু একটা সাইকেল আমায় যোগাড় করে দিল। সাইকেলের অবস্থা কিরকম সেটা যাচাই করার মানসিক অবস্্থা ছিল না। কিন্তু ঐ সাইকেলে চড়েই বারাসাত যেদিন ফিরবো সেদিন ভাবলাম যে এই সাইকেল চালিয়ে বারাকপুরে পৌঁছলাম কিভাবে? রাস্তা দিয়ে যখন বারাকপুরে ফিরছি দেখতে পাই রাস্তাঘাটে শোকস্তব্ধ মানুষের জটলা। দলমত নির্বিশেষে সমস্ত স্তরের মানুষ আজ শোকস্তব্ধ। বিকেলে পৌঁছলাম বারাকপুর পার্টি অফিসে, সেখানেও একই দৃশ্য, টাউন কংগ্রেসের সভাপতি, সম্পাদক ও ছাত্র-যুব কর্মীরা বিশ্বাস করতে চাইছে না যে এভাবে ইন্দিরার মৃত্যু হতে পারে। সবার ধারণা ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে মানুষের আশীর্বাদ আছে। তাছাড়া তার গলায় মন্ত্রপুত রুদ্রাক্ষের মালা তাকে রক্ষা করবে। রাত ৯ টার সময় পার্টি অফিস থেকে বেড়লাম পথে কাতারে কাতারে মানুষ হাঁটছে বাড়ি যাবে বলে, অদ্ভুত ব্যাপার করো মুখে বিরক্তির প্রকাশ নেই। রেল লাইন ধরে মানুষ হাঁটছে, শিয়ালদহ থেকে হেঁটে নৈহাটি, হালিশহর, কাঁচরাপাড়া যাচ্ছে। ক্লান্ত পায়ে হেঁটে অফিস ফিরতি মানুষগুলোর জন্য বিভিন্ন জায়গায় জল-বাতাসার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কোনো রাজনৈতিক দল নয় সাধারণ মানুষ ঐ আয়োজন করেছে। সেই শোকস্তব্ধ পরিবেশের মধ্যেও একটি শ্লোগান বাতাসকে আরও ভারি করেছিল: “যব তক্ সূরয চাঁদ রহেগা ইন্দিরা তেরা নাম রহেগা।”
একালে দাঁড়িয়ে ঐ শ্লোগানের সত্যতা মর্মে মর্মে অনুভ করতে পারছি। সেদিন মানুষ কত সত্য একটা শ্লোগান দিয়েছিল। ইন্দিরা গান্ধীর অভাব আজ সত্যিই অনুভব করছি।
৩১ অক্টোবর ১৯৮৪ সকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী লৌহমানবী ইন্দিরা গান্ধীকে হত্যা করা হয়েছিল। তার ‘শিখ দেহরক্ষী’ সৎবন্ত সিং এবং বিয়ান্ত সিং এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে ভারতীয় সেনাবাহিনী পরিচালিত ‘অপারেশন ব্লু স্টার’ এর পরই এই হত্যাকাণ্ড।
১৯৮৪ সালের জুন মাসে অমৃতসরের স্বর্ণ মন্দিরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অভিযানে শিখদের স্বর্ণ মন্দির ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শত শত মানুষ তাদের জীবন হারিয়েছিল এবং এর মধ্যে জঙ্গি এবং সেনা উভয়ই ছিল।
ব্লুস্টার অপারেশনের পরে ইন্দিরার শিখ দেহরক্ষীদের সরিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব ইল্দিরা মানেন নি। তার যুক্তি ছিল আমি দেশের প্রধানমন্ত্রী, কতিপয় শিখ উগ্রপন্থীর বেআইনি কাজের জন্য গোটা শিখ জাতিকে অবিশ্বাস করতে পারিনা।। এই জাতীয়তাবোধ এখনকার কোনো দেশ সেবকের মধ্যে দেখা যায়না। ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন দেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী এবং খুব ভালো একজন প্রশাসক। জরুরী অবস্থা এবং অপারেশন ব্লু স্টার সত্ত্বেও, তিনি জনসাধারণের মধ্যে জনপ্রিয় ছিলেন।
৩১ অক্টোবর ১৯৮৪ ইন্দিরা গান্ধী ব্রিটিশ অভিনেতা পিটার উস্তিনভের সাথে দেখা করতে যাচ্ছিলেন, যিনি আইরিশ টেলিভিশনের জন্য একটি ডকুমেন্টারি চিত্রগ্রহণ করছিলেন। তিনি তার সাক্ষাৎকার নিতে যাচ্ছিলেন। সকালে ইন্দিরা নয়াদিল্লির ১ নম্বর সফদরজং রোডের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের বাগান দিয়ে হাঁটছিলেন। তার বিশ্বস্ত দেহরক্ষী, বিয়ান্ত সিং এবং সৎবন্ত গেটে তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। সে গেট অতিক্রম করার সাথে সাথে তার বিশ্বস্ত রক্ষীরা তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে। সাব-ইন্সপেক্টর বিয়ান্ত সিং তার .৩৮ রিভলবার থেকে ইন্দিরার পেটে তিন রাউন্ড গুলি ছোঁড়ে। মাটিতে পড়ার পর সৎবন্ত সিং তার স্টার্লিং সাব-মেশিনগান থেকে গুলি ছোঁড়ে।
সকাল সাড়ে ৮ টার দিকে ইন্দিরা গান্ধীকে অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিকেল সায়েন্সেস (এইমস) এ নিয়ে যাওয়া হয়। তার পুত্রবধূ তার সাথে ছিলেন। ডাক্তাররা তার অপারেশন করার সিদ্ধান্ত নিলেন। সেই সময় তার পুত্র রাজীব গান্ধী, রাজধানীতে ছিলেন না। তিনি বাংলায় নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছিলে। দ্রুতই রাজীবকে জানানো হয়েছিল যে তার মা সঙ্কটজনক এবং তাকে রাজধানীতে ফিরে যেতে হবে।
এদিকে, প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে গুলি চালানোর ছয় মিনিটের মধ্যে বিয়ান্ত সিং এবং সৎবন্ত সিংকে যথাক্রমে ইন্দো-তিব্বত সীমান্ত পুলিশ এবং গান্ধীর অন্যান্য দেহরক্ষীরা গ্রেপ্তার করে তখন তারা উভয়ে তাদের অস্ত্র ছুঁড়ে ফেলে এবং তাদের স্ব স্ব অবস্থানে দাঁড়িয়ে থাকে। এইমসের ডাক্তারদের দল ইন্দিরা গান্ধীর অপারেশন শুরু করলো। গান্ধীর দেহে যে ৩৩ টি গুলি ছোঁড়া হয়েছিল তার মধ্যে ২৩ রাউণ্ড গুলি তার শরীরের মধ্য দিয়ে গিয়েছিল এবং সাতটি গুলি দেহের ভিতরে আটকে ছিল।
ইন্দো-তিব্বত সীমান্ত পুলিশ কর্তৃক বন্দী বিয়ান্ত সিংহ হত্যাকাণ্ডের কয়েক মিনিটের মধ্যেই গুলিবিদ্ধ হন। পরে গণমাধ্যমে প্রচারিত প্রতিবেদন অনুসারে জানা যায়, বিয়ান্ত সিং এর করা গুলি চালনার ফলে ইন্দিরার মৃত্যু হয়। সৎবন্ত সিংকে গ্রেপ্তার করে মামলা করা হয়।
এদিকে রাজীব গান্ধী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কলকাতা থেকে দিল্লি ফেরেন একটি ফ্লাইটে। ইন্দিরা গান্ধী নিজ দেহরক্ষীর গুলিতে মারা যান- এই হত্যার খবর প্রায় ১০ ঘণ্টা পরে দূরদর্শনের সন্ধ্যার নিউজ ঘোষণা করা হয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রয়োজন ছাড়াই সন্ধ্যায় রাজীব গান্ধী দেশের ৬ষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। রাত ১০:০০ টায় সংবাদ পাঠিকা সালমা সুলতান দূরদর্শনে জাতির উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যু সংবাদ ঘোষণা করেন। এরপরই রাজীব গান্ধী জাতির উদ্যেশ্যে ভাষণ দেন।
ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যু সংবাদ ঘোষণা হওয়ার সাথে সাথে আমার চোখের জল আর বাঁধ মানলোনা। সেদিন অঝোরে অনেক্ষণ কেঁদে ছিলাম। আজ সেদিনের সেই নৃশংস মর্মান্তিক হত্যার ঘটনা কথা মনে করে লিখতে গিয়ে আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে। ১৯৮৪ সালে বাড়িতে যখন অঝরে চোখের জল ফেলছি তখন অশীতিপর বৃদ্ধা আমার মা আমাকে শান্তনা দিয়ে বলেছিলেন কাঁদিস না, মহান মানুষের মৃত্যু এভাবেই হয়। মহাত্মা গান্ধীকে ওরা কিভাবে মারলো জানিস না?
দেশের অখণ্ডতা রক্ষা করতে গিয়ে তাকে মরতেও হতে পারে সেটা বোধ হয় ইন্দিরা গান্ধী জানতেন। নইলে মৃত্যুর আগের দিন উড়িষ্যাতে (৩০ শে অক্টবর ১৯৮৪ বক্তৃতার ভিডিওর লিঙ্ক দিলাম) ঐ রকম মর্মস্পর্শী বক্তৃতা করবেন কেন? তিনি বললেন- “আমি আজ বেঁচে আছি কাল হয়তো থাকব না। আমি বেঁচে থাকি বা মরে যাই তার কোনো গুরুত্ব নেই। আমি দীর্ঘ জীবন যাপন করেছি এবং আমি গর্বিত যে আমি আমার সারাজীবন আমার দেশবাসীর সেবায় ব্যয় করেছি। আমি আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত মানুষের সেবা করে যাব এবং যখন আমি মারা যাব আমার রক্তের প্রতিটি বিন্দু ভারতকে শক্তিশালী করবে। একটি অখণ্ড ভারতকে বাঁচিয়ে রাখবে।”
সত্যিই, “যব তক্ চাঁদ সূরয রহেগা ইন্দিরা তেরা নাম রহেগা।”
নৃশংস ভাবে খুন করা হলো ইন্দিরা গান্ধীকে। চারিদিকে কেমন যেন একটা শূণ্যতা, সবার মুখে একটাই কথা কি হবে দেশটার? মানুষের সেই কি হবে! দেশের চিন্তা একালের রাজনীতিতে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে মানুষ। ঐ পরিস্থিতিতে দলের ঐক্য বজায় রাখতে রাজীব গান্ধীকে কংগ্রেসের সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচিত করে প্রধানমন্ত্রী করে রাজনীতির ডামাডোল বন্ধ করা হোলো।
৩ রা নভেম্বর ১৯৮৪, শনিবার ইন্দিরার শেষকৃত্যের আয়োজন হলো। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দেশ বিদেশ থেকে অতিথিরা এলেন। এসেছিলেন প্যালেস্টাইন লিবারেশন আর্মির নেতা ইয়াসির আরাফাত, জিম্বাবুয়ের রাষ্ট্রপতি কেনেথ কাউণ্ডা, আমেরিকার থেকে প্রতিনিধি এলো এলেন না রাষ্ট্রপতি রিগ্যান ও উপরাষ্ট্রপতি জর্জবুশ, আমেরিকার সেক্রেটারি অফ স্টেট জর্জ পি. সুলৎস ও আরো দুই সাবেক মার্কিন দূত সেরম্যান কুপীর ও ড্যানিয়েল প্যাট্রিক ময়নিহান এসেছিলেন। বলিউডের প্রতিনিধি রাজ কাপুর,অমিতাভ বচ্চন ও সুনীল দত্ত ছাড়াও আরো অনেকে এসেছিলেন।
ইন্দিরা গান্ধীর শেষ যাত্রার সেই দৃশ্য আজও চোখের সামনে ভেসে ওঠে- যেন ভারতবাসীর “মা” এর মৃত্যু হয়েছে তারই শেষ যাত্রায় তার সন্তানরা বার বার মন্ত্র পড়ার মতো শ্লোগান দিয়ে চলেছে “ভারত মাতা কি জয়” “যব তক্ সূরজ চাঁদ রহেগা ইন্দিরা তেরা নাম রহেগা” “ইন্দিরা মাতা অমর রহে”… ইত্যাদি। কাতারে কাতারে সর্বস্তরের মানুষ পাগলের মতো শবযাত্রার শববাহী গাড়ির পেছনে হেঁটে চলেছে। বহু কষ্টে ইন্দিরার নিথর দেহ শক্তি স্থলে পৌঁছলো। ইন্দিরার শেষকৃত্য অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে ও রাজীব গান্ধীকে সহযোগিতা করার জন্য আর কে ধওয়ান বিড়লা মল্দিরের প্রধান পুরোহিতকে অনুরোধ করলেন। রাজীব গান্ধীকে সহযোগিতা করার সময় পুরোহিত গিরিধারির হাত কাঁপছিল, তিনিও অঝরে কাঁদছিলেন।
ইন্দিরার চিতার সামনে দাঁড়িয়ে ইয়াসির আরাফাত তার বোনের মৃত্যু শোকে শিশুর মতো কাঁদছেন। আমেরিকার সেক্রেটারি অফ স্টেট এবং আরো দুই সাবেক রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিক ময়নিহান তারা দুজনেই আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ও উপ রাষ্ট্রপতি তৃতীয় বিশ্বের শীর্ষ নেতার শেষকৃত্য এড়িয়ে যাওয়ায় দুঃখ পেয়েছিলেন। আমেরিকার রাষ্ট্রপতি এবং উপরাষ্ট্রপতি তখনও ভুলতে পারেন নি। আমেরিকার হুমকি উপেক্ষা করে পাকিস্তানকে মেরে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের জয়ের রাস্তা প্রশস্ত করার মূল কারিগর ছিলেন তো এই ইন্দিরা গান্ধী, তাই তার শেষকৃত্যে তাদের আসতেতো লজ্জা করবেই।
বিকেলের দিকে জ্বলে উঠলো চিতার আগুন। সেই আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে পঞ্চভূতে বিলীন হোলেন ইন্দিরা। চারিদিকে তখন কান্নার রোল, আর শ্লোগান মুখরিত বাতাস আরো ভারী হয়ে ওঠেছে। তার পরে সবকিছু শেষ, নিস্তব্ধ।
এর পরেই ১৯৮৪ সালের অষ্টম লোক সভার নির্বাচন ঘোষণা হয়। ইন্দিরা হত্যার কারণে সহানুভুতির হাওয়ায় ভর করে রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস ৫১৫ টি আসনের মধ্যে ৪০৪ টি আসন জেতে|ঐ বছরই ভারতীয় জনতা পার্টির নির্বাচনে অভিষেক ঘটে এবং তারা জয়লাভ করেন মাত্র দুটি টি আসন একটি অন্ধ্র প্রদেশে অন্যটি গুজরাটে। পরে ১৯৮৯ সালে জ্যোতিবসু ও ভি পি সিং-র হাত ধরে বি জে পি ৮০ টি আসনে জয়লাভ করে। এখনতো ৩০০ আসন পেলেই কেউ কেউ বুক বাজাম।
১৯৮৪ সালের নির্বাচনে কালিঘাটের পটুয়াটোলা থেকে রাজনীতির মূলমঞ্চে উঠে এলেন আজকের মমতা বন্দোপাধ্যায়। তিনি দোর্দণ্ড প্রতাপশালী সি পি এম এর সোমনাথ চ্যাটার্জীকে হারিয়ে দিয়ে রাজীব গান্ধীর প্রিয় পাত্রী হয়ে উঠলেন।
ভারত: রাজনীতির সেকাল আর একাল (প্রথম পর্ব)
ভারত: রাজনীতির সেকাল আর একাল (দ্বিতীয় পর্ব)