টাকা পরিবর্তনের আগের ঘটনা অবলম্বনে লেখা গল্প:
।।এক।।
ঘাটের উপর পরিতোষের মিষ্টির দোকান। জয় মা তারা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। পরিতোষ এখন দোকানে নেই। তার বাবা আশুতোষ রয়েছে। দোকানের চেয়ারে বসে কবেকার পুরনো চশমাটা চোখে পরে। এইসময় দক্ষিণের রাস্তা ধরে দোকানের সামনে একটা মোটরবাইক এসে দাঁড়ালো ও বাইকের উপর থেকে সুদর্শন এক ভদ্রলোক নামলো।পরনে তার কালো প্যান্ট, শাদা শার্ট, পায়ে পালিশ করা বুট জুতো,চোখে হালকা ফ্রেমের সোনালি চশমা আর ঘাড়ে বড় ফিতা অলা কাপড়ের ব্যাগ। যুদ্ধ নয় শান্তি চাই লেখা। নেমে জিজ্ঞেস করল, “কাকা, মিষ্টির দোকান কার?”
আশুতোষ বলল, “আমার ছেলের। ছেলে এখন নেই।বাড়িতে আছে। চান করতে ও খেতে গেছে। চান করে খেয়ে চলে আসবে। একটু আগেই ছিল।আমাকে বসিয়ে রেখে এক্ষুনি গেল।”
“ও, আসতে তাহলে ঘণ্টা দুয়েক দেরি হবে নাকি? যদি হয় অতক্ষণ বসা যাবেনা।”
“দেরি তো একটু হবেই। এক্ষুনি গেল না! কী ব্যাপার, আমাকে বলুন! মিষ্টি নিবেন তো? নাকি অন্য কোন দরকার আছে?”
“না না, অন্য কোন দরকার নেই। মিষ্টি নেব।”
“বলুন, কী মিষ্টি নিবেন? আমি দিচ্ছি।”
“আপনি বয়স্ক মানুষ। আপনি দিতে পারবেন?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, পারব। এ এমন কোন কঠিন কাজ নয়। কী মিষ্টি লাগবে,বলুন!”
“আপনি তাহলে আমাকে একশো টাকার ছানাবড়া দিন।”
“বসুন, দিচ্ছি।”
ভদ্রলোক একটা চেয়ারে বসল,”আমার কাছে কিন্তু ভাঙানি টাকা নেই।এক্ষুনি ব্যাঙ্ক থেকে আসছি।পঞ্চাশ হাজার টাকা তুললাম। সব পাঁচশো আর হাজার টাকার নোট দিল ব্যাঙ্ক।আগে পাঁচশো টাকা ভাঙানি আছে কি দেখুন!”
অমনি সে এক টানে ড্রয়ার খুলে দেখে নিয়ে বলল,”অসুবিধা নেই, আছে।”
“বেশ,দিন তাহলে।”
মিষ্টি নিয়ে ভদ্রলোক পাঁচশো টাকার নোট বের করে দিল, “ব্যাঙ্কের টাকা, নিন।”
টাকাটা সে ধরল, “আর কিছু লাগবে? দই? শিঙ্গাড়া? কোল্ড ড্রিংকস?”
“এখন তো লাগছেনা। যদি লাগে পরে এসে নিয়ে যাবো। এখন এটাই থাক।”
“বেশ, থাক। “বলে সে নোটটা ড্রয়ারে অমনি ভরে রাখল। নোট ঠিক আছে কিনা দেখল না। ভদ্রলোক মানুষের কাছে নোট ঠিক না থাকলে হয়? তাছাড়া ব্যাঙ্কে থেকে টাকা তুলে আনল বলছে। ব্যাঙ্ক তো আর খারাপ নোট দেবেনা। এসব মানুষ ভালো মানুষ। দেখেই বোঝা যাচ্ছে। সুতরাং ভালো টাকাই থাকবে। তাহলে টাকা দেখে শুধু শুধু সময় নষ্ট করে কী লাভ? আর তাছাড়া টাকার সে চেনেই বা কী?
টাকাটা নেওয়ার পরে সে বলল, “দোকানে আগে আমিই বসতাম। বছর চারেক থেকে আমি আর বসি না। ছেলেকে ছেড়ে দিয়েছি। এখন ছেলেই বসে। তবে একেবারে বসি না বললে ভুল বলা হবে। এই দুপুর টাইমে ঘণ্টা দুয়েক বসি। ছেলে বাড়ি গিয়ে চান করে খেয়ে আসা পর্যন্ত।”
“ভালো করেন। ঠিক আছে, আসছি।”
“আচ্ছা, আসুন! আর পরে যদি মিষ্টি লাগে তো এসে নিয়ে যাবেন। এখানে ভালো মিষ্টি পাবেন সবসময়। ভালো দইও পাবেন।”
“আচ্ছা আচ্ছা।”দোকান থেকে বেরিয়ে ভদ্রলোক এবার বাইকে চাপল ও যে রাস্তা ধরে এসেছিল সেই রাস্তা ধরে চলে গেল।
খানিক বাদে একই রাস্তা ধরে আরেক ভদ্রলোক এসে ঢুকলো ও সেও একশো টাকার মিষ্টি নিল। তবে সে ছানাবড়া নিল না। রাজভোগ নিল। নিয়ে পাঁচশো টাকার নোট দিয়ে চারশো টাকা ফেরত নিল। টাকা ফেরত দেওয়ার আগে আশুতোষ এই ভদ্রলোকের নোটটা একবার দেখল।
ভদ্রলোক তখন বলল, “নোটের কী দেখছেন? আমাদের নোটের দেখার কিছু নেই। আমরা কারও কাছে খারাপ নোট নিই না, কাউকে খারাপ নোট দিই না। খারাপ নোট আমাদের কাছে কখনও থাকেনা। আমাদের কাছে সবসময় ব্যাঙ্কের টাটকা নোট পাবেন।আমরা ভদ্রলোক মানুষ দেখে বুঝতে পারছেন না? আমাদের সম্মানের দাম আছে। …আমাদের নোট আজ পর্যন্ত কেউ দেখেনি। আর আপনি দেখছেন? ঠিক আছে, দেখুন!” বলায় নোটটা আর দেখল না আশুতোষ।ভদ্রলোকও বেরিয়ে চলে গেল।
পরে ওদিক থেকে আরেক জন ভদ্রলোক এসে ঢুকল,”কাকা, দই নেব, ভালো দই আছে?”
“আছে তো।”
“দই টক হবেনা তো? টক হলে চলবেনা। পরে ফেরত আসবে। আগেই বলে নিচ্ছি কিন্তু।”
“না না, টক হবেনা। খুব ভালো দই হবে।”
“আপনার মুখের কথা বিশ্বাস করে নিয়ে যাচ্ছি কিন্তু।”
“আপনি চোখ বন্ধ করে নিয়ে যেতে পারেন।”
“বলছেন যখন দু’কিলো দই দিন। নিয়ে গিয়ে খেয়ে দেখি। আর হ্যাঁ, কত টাকা কিলো?”
“ষাট টাকা। সব জায়গায় যে দাম আমাদের কাছেও একই দামে পাবেন। কারও কাছে বেশি নেবো না।”
“বেশ, দু’কিলো দিন।”
ফ্রিজের ভিতর থেকে বের করে আশুতোষ ভদ্রলোককে দু’কিলো দই দিল। দই নিয়ে আগের দুই ভদ্রলোকের মতো এই ভদ্রলোকও পাঁচশো টাকার নোট দিল। আশুতোষ বলল, “আপনার কাছে ভাঙানি টাকা নেই? সবাই যদি পাঁচশো টাকার নোট দেয় অত ভাঙানি তাহলে পাবো কোথায়? ভাঙানি আছে কি দেখুন!”
ভদ্রলোক বলল,”নেই বলেইতো নোট দিলাম। থাকলে কি আর নোট দিতাম? কেন,আপনার কাছে ভাঙানি নেই?”
“আছে। কিন্তু ভাঙানি টাকা সব শেষ হয়ে যাচ্ছে তো।”
“তাতে কী হয়েছে? আবার কেউ ভাঙানি দেবে। কেউ নোট দেবে কেউ ভাঙানি দেবে। ব্যবসা তো এভাবেই চলে।”
আশুতোষ নোটটা হাতে নিয়ে এবার হিসাব করতে লাগল, “আপনি কত ফেরত পাচ্ছেন তাহলে?”
“আপনার দইয়ের দাম একশো কুড়ি টাকা হচ্ছে। আমি তাহলে তিনশো আশি টাকা ফেরত পাচ্ছি।”
আশুতোষ তিনশো আশি টাকা ফেরত দিল। ভদ্রলোক টাকা নিয়ে চলে গেল। যাওয়ার সময় বলল, “আপনার ড্রয়ারে আরও ভাঙানি টাকা থাকল তাই না?”
আশুতোষ বলল, “সে থাকল। কিন্তু আপনার মতো আর একজন এলেই তো সব শেষ।”
দোকান থেকে বেরিয়ে একটু গিয়ে একটা বাঁক। ভদ্রলোক ওই বাঁকে দাঁড়িয়ে ফোন করল, “আর একটা হবে, কুইক চলে আয়।”
প্রথম ভদ্রলোক তারপর আবার চলে এল, “বাড়ি থেকে ফোন করে একটা কোল্ড ড্রিংকস ও আরও দু-তিন রকমের ভ্যারাইটিজ মিষ্টি নিয়ে যেতে বলল। আপনি একটা কোল্ড ড্রিংকস ও একশো টাকার মিষ্টি দিন।”
“ঠিক আছে, দিচ্ছি।”
ভদ্রলোক সেগুলো নিয়ে এবারও পাঁচশো টাকার নোট বের করল।
“ভাঙানি হবে?” আশুতোষ প্রশ্ন করল।
“সে কী! তখন তো অনেক ভাঙানি ছিল দেখলাম।”
“আপনার পরে আরও দু’জনকে ভাঙানি দিলাম তো। সবাই নোট দিলে কত ভাঙানি টাকা থাকবে, আপনিই বলুন!”
“সে তো ঠিকই। তাও একবার দেখুন! হয়ে যাবে বলে মন হচ্ছে।”
ড্রয়ার খুলে দেখে আশুতোষ বলল ,”আপনারটা কোন রকম ভাবে হবে। কিন্তু—-“
“কোন কিন্তু নয়, আপনি আমাকে দিন।”
“আপনাকে তখন আমি যে ভাঙানি গুলো দিলাম সেগুলো কী করলেন?”
ভদ্রলোক হেসে বলল, “আর বলবেন না। ওটা দিয়ে অন্য জিনিস কিনে শেষ হয়ে গেল। পকেটে এখন মাত্র বিশ টাকা ভাঙানি পড়ে আছে। এই দেখুন! “শার্টের বুক পকেট থেকে বিশ টাকার একটা নোট বের করে দেখাল।
“ঠিক আছে, নেই বলছেন যখন ভাঙানি দিচ্ছি। আমার হয়তো একটু অসুবিধা হবে। কিন্তু আপনার তো উপকার হবে। মানুষের উপকার করাই তো মানুষের কর্তব্য।এই নিন।”
ভদ্রলোক তখন হাস্য মুখে আশুতোষকে ধন্যবাদ জানাল, “ধন্যবাদ আপনাকে।আপনি খুব ভালো মানুষ, উদার মনের মানুষ। উপরঅলা আপনার খুব ভালো করবেন।”
ভদ্রলোক আশুতোষের কাছে তখন একটা ভালো মানুষ হয়ে গেল। যাকে বলে ভালো মানুষ।
।।দুই।।
ঘণ্টা খানেক বাদে দোকানের ফোনটা বেজে উঠল। আশুতোষ ফোনটা কানে ধরল এবং সে হ্যালো বলার আগে ওপার থেকে হ্যালো বলল। আশুতোষ বলল,”কে?”
“আমি গো, পরিতোষ।গলা শুনে চিনতে পারোনা?”
“কী হল, বল।”
“বলছি, এক্ষুনি আমাকে কালীতলা জগদ্বন্ধু মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে বনমালী সাহা ফোন করেছিল।”
“করে কী বলল?”
“বলল যে, সে তার বয়স্ক বাবাকে দোকানে বসিয়ে রেখে সকালে শহরে গিয়েছিল।এসে দেখে, কোথাকার তিন ভদ্রলোক এসে তার বাবাকে জাল নোট দিয়ে মিষ্টি নিয়ে পালিয়েছে। তোমারও তো এখন বয়স হয়েছে। নোট হয়তো ঠিক মতো চিনতে পারবে না। তাই বলছি, সেরকম কোন অপরিচিত লোক যদি পাঁচশো টাকার নোট দেয় তুমি নেবেনা। বলবে, ভাঙানি টাকা নেই। ভাঙানি চাইবে। না হলে তাকে যেখান থেকে পারে মাল রেখে ভাঙানি করে আনতে বলবে। আমি কী বললাম, আমার কথা বুঝতে পেরেছ?”
“আচ্ছা?”
“বলো।’
“বলছি,ভদ্রলোকগুলো দেখতে কী রকম রে! তাদের চেহারা সম্পর্কে কিছু বলল?”
“হ্যাঁ, বলল। তিনজনই নাকি দেখতে দারুণ!…বেছে বেছে তারা নাকি যে সব দোকানে বয়স্ক লোক থাকছে সেইসব দোকানে যাচ্ছে।” পরিতোষ বলল, “ব্যবসার হাল এখন এমনিতেই খুব খারাপ। অর্ডার নেই।মালের দাম বেশি। লাভ খুব সামান্য। মায়ের অসুখ আর তোমার অসুখ দেখাতে প্রতি মাসে মোটা টাকা পকেট থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। তার উপর যদি কেউ জাল নোট ঢুকিয়ে দেয় তো আমি একেবারে মার্ডার হয়ে যাবো। তাই তোমাকে আবারও বলছি, পাঁচশো টাকা, হাজার টাকার নোট হাতে একদম ধরবে না।
ঠিক আছে?”
“তুই কি এখন আসবি না?”
“এখনও তো চান করাই হল না। চান করব, খাবো তারপর তো আসব।”
“এখনও চান করিস নি! কী করছিলি?”
“মাথায় বড় বড় চুল হয়েছিল। চুল কাটিয়ে এক্ষুনি বাড়ি ঢুকলাম।”
“ঠিক আছে, রাখ।”
পরিতোষ ফোন রাখল।
।।তিন।।
রোজ বিকেল তিনটে নাগাদ পরিতোষ দোকানে চলে আসে। কিন্তু আজ তার দোকানে আসতে চারটে বাজল। এসে দেখল, তার বাবা বিষণ্ণ মনে চেয়ারে বসে রয়েছে। পরিতোষ জিজ্ঞেস করল, “তোমার মন খারাপ কেন, কী হয়েছে?”
আশুতোষ উত্তর করল না।
পরিতোষ তখন বলল, “কী হল, কথা বলছ না কেন?”
আশুতোষের চোখ থেকে তখন জল ঝরে পড়তে লাগল।
“এ কী! তুমি কাঁদছ!কেন?”
আশুতোষ বলল,”ওই তিন ভদ্রলোক আমার কাছেও এসেছিল। আমার কাছ থেকেও তারা মিষ্টি নিয়ে চারখানা পাঁচশো টাকার নোট দিয়ে চলে গেছে।”
“কী বললে!” পরিতোষ শুনে চমকে উঠল।
“হ্যাঁ, রে।”
পরিতোষ তখন বলল, “তোমাকে ফোন করে নিষেধ করলাম তাও তুমি নিলে? তোমাকে নিয়ে আর পারিনা বাবা।”
আশুতোষ মাথা নিচু করে চুপচাপ ছেলের বকুনি শুনল এবং পরে ছেলে যখন থামল তখন বলল, “ঘটনাটা তুই ফোন করার পরে ঘটেনি। ঘটেছে তুই ফোন করার আগে। তুই বাড়ি যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে।”
“ও, গড! “পরিতোষ তখন মাথা ধরে বসে গেল। খানিক বাদে বলল, “নোট গুলো দেখাও দেখি!”
আশুতোষ নোট গুলো বের করে দেখাল। পরিতোষ নোটগুলো দেখে চিৎকার করে উঠল, “এ তুমি কী করেছ গো? সব গুলো জাল নোট।হায় হায় হায়!”
আশুতোষ কোন কথা না বলে তখন শুধু বসে ভাবতে লাগল, পৃথিবীতে মানুষকে বিশ্বাস না করা মহাপাপ। যেকারণে সে তাদের বিশ্বাস করেছিল। যদি বুঝত, বিশ্বাসের মূল্য এই হবে তাহলে সে কি বিশ্বাস করত?নিজে নোট চিনতে না পারলেও অন্য কাউকে দিয়ে চিনিয়ে নিত। তার মতো সহজ সরল মনের মানুষ কী করে বুঝবে যে, ওরা ভদ্রলোক ছিল না।ছিল ভদ্রলোকের আড়ালে মুখোশধারী শয়তান। …ভগবান নিশ্চয়ই এর বিচার করবেন। …ভাবতে ভাবতে হঠাৎই আশুতোষ চেয়ার শুদ্ধ হুড়মুড় করে নিচে পড়ে গেল।
পরিতোষ হাত চারেক দূরে একটা চেয়ারে বসেছিল। সঙ্গে সঙ্গে সে বাবার কাছে দৌড়ে এল। মাথাটা তার জানুর উপর তুলে নিয়ে বলল, “বাবা, ও বাবা,কী হয়েছে তোমার? আমাকে বলো। তুমি পড়ে গেলে কেন? কথাগুলো আমি তখন তোমাকে বলিনি। তুমি আমার কথায় রাগ করোনা বাবা। বাবা, রাগ করোনা, প্লিজ! কথা বলো বাবা, কথা বলো।” পরিতোষ একা একা তার বাবাকে কথা বলানোর অনেক চেষ্টা করল কিছুক্ষণ ধরে। কিন্তু যখন না পারল “বাবা…ও বাবা….”বলে চিৎকার কান্না জুড়ে দিল। তার কান্নায় লোক জমে গেল এবং জল ঢেলে সবাই তাকে সুস্থ করার আপ্রাণ চেষ্টা করল। যখন হল না তখন হাসপাতালে নিয়ে গেল। দশদিন পর তার চিকিৎসা করানো থেকে ছেলেকে সে রেহাই দিয়ে চলে গেল।
পরিতোষের চোখে এখন গোটা দেশে ভদ্রলোক বলে কেউ নেই। সব ঠক! সব শালা ঠক!