‘একমপ্যক্ষরং তু যৎ শিষ্যে প্রবোধয়েৎ গুরু
পৃথিব্যাং নাস্তি তদব্যং যদ্দনৃক্ত সোহঋণী ভবেৎ’
অর্থাৎ শিক্ষক যদি কোন ছাত্রকে একটিমাত্র অক্ষর শিক্ষা দান করেন তাহলে পৃথিবীতে এমন কোন বস্তু নেই যা দিয়ে সেই ছাত্র কখনও ঋণ মুক্ত হতে পারে। হ্যাঁ, সেই প্রাচীন গুরুকুল শিক্ষাশ্রম যুগ থেকে শিক্ষকদের সম্বন্ধে এই যে সম্ভ্রমসূচক বাণী উচ্চারিত হয়ে এসেছে আজ স্বাধীন ভারতে সেই ঐতিহ্যবাহী শিক্ষকদের স্মরণের জন্য একটি বিশেষ দিবস উদযাপন করা হবে- এটাই তো স্বাভাবিক। আমাদের জাতীয় জীবনে যে সমস্ত বিশেষ দিন বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ সেগুলির মধ্যে অন্যতম হল ৫ সেপ্টেম্বর। গোটা দেশে এই দিনটি ‘শিক্ষক দিবস’ হিসেবে উদযাপিত হয়।
শিক্ষক ছাড়া কোন জাতির সর্বাঙ্গীণ উন্নতি কখনই সম্ভব নয়। তাই শিক্ষার ভার যাঁদের হাতে ন্যস্ত, তাঁরা সকলেই শ্রদ্ধার পাত্র। বলা হয়, শিক্ষককুল ‘মানুষ গড়ার কারিগর’। অজ্ঞতার অন্ধকার দূর করে তারা নবীন শিক্ষার্থীদের নিয়ে যান জ্ঞানালোকের পরম তীর্থে। অপরিণত চেতনাকে পরিণত হয় উঠতে সাহায্য করেন তাঁরা। শিক্ষার্থীদের তাঁরা শুধু পুঁথিগত শিক্ষাই দেন না তাদের মধ্যে জাগিয়ে তোলেন নীতিবোধ, মূল্যবোধ। মার্জিত করে তোলেন তাদের রুচিবোধ। তাদের সামনে তুলে ধরেন পরিপূর্ণ জীবনের আদর্শ। সেজন্য জাতীয় জীবনে শিক্ষকদের গুরুত্ব এত বেশি। সেজন্যই সমাজের কাছে এত মান্যতা তাঁদের আর তাই তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য এই দিনটিকে আলাদা করে রাখা হয়েছে। ‘শিক্ষক দিবস’ আমাদের কাছে একটি জাতীয় উদযাপনের দিবস। আবার এটি সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের দপ্তরে হওয়ার কারণে কিছুটা হলেও আন্তর্জাতিকও বটে। এই বিশেষ তারিখটিকেই বা কেন ‘শিক্ষক দিবস’ রূপে উৎসর্গীকৃত করা হয়েছে সে বিষয়ে আমাদের অবগত হওয়ার প্রয়োজন।
স্বাধীন ভারতের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের জন্মদিন ১৮৮৮ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। মাদ্রাজ (বর্তমান চেন্নাই) শহরের চল্লিশ মাইল উত্তর-পশ্চিমে তিরুতানি গ্রামে তাঁর জন্ম। ১৯০৫ সালে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন শাস্ত্রে এমএ পাস করেন তিনি। মাদ্রাজেরই প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনা শুরু। সময় ১৯০৯ সাল। ১৯১৭-তে রাজামুন্দ্রি আর্টস কলেজ। পরের বছর মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তারপর মহীশূর মহারাজা কলেজে অধ্যাপনা। মহীশূরেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ পরিচয়। সময় ১৯১৮ সাল। তার আগেই ‘দ্য ফিলজফি অব রবীন্দ্রনাথ টেগোর’ নামে তিনি রচনা করেন এক অসামান্য গ্রন্থ। ১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। ১৯৪১ পর্যন্ত দীর্ঘ কুড়ি বছর পর অধ্যাপকরূপে ওই বিভাগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯২৬-এ বিদেশ যাত্রা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হয়ে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় অনুষ্ঠিত ‘কংগ্রেস অব দ্য ইউনিভার্সিটি অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার’- এ যোগদান। সেখান থেকে আমেরিকা যোগ দেন আন্তর্জাতিক দর্শন কংগ্রেসে। ১৯২৯ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক ধর্মের অধ্যাপক পদ গ্রহণ করেন তিনি। পরে ম্যানচেস্টার কলেজে ‘হিবার্ট’ বক্তব্য প্রদান। ১৯৩১-এ আবাসিক অন্ধ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনি প্রথম উপাচার্য। ১৯৩৬-এ ফের অক্সফোর্ড থেকে ‘স্পলডিং’ অধ্যাপক পদ গ্রহণের আমন্ত্রণ।
এভাবে স্বদেশের ও বিদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ওতপ্রতভাবে যুক্ত থেকে রাধাকৃষ্ণন শিক্ষাক্ষেত্রে অসাধারণ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি তাঁর জীবনে সোভিয়েত ইউনিয়নে ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। এরপর ছিলেন ভারতের উপরাষ্ট্রপতি। পরে ১৯৬২-তে তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতি হন। উল্লেখ্য, স্বাধীন ভারতের প্রথম তিনজন ‘ভারতরত্ন’র একজন তিনি। তাঁর বড় পরিচয় তিনি একজন আদর্শনিষ্ঠ শিক্ষক। বিদ্বান, বাগ্মী। প্রতিবছর এই মহান শিক্ষাব্রতীর জন্মদিন ৫ সেপ্টেম্বর তারিখটি ‘শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালন করা হয় এবং সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে শিক্ষা ও শিক্ষকের প্রতি দায়বদ্ধতার কথা স্মরণ করা হয়।
স্বাধীনতার সাড়ে ছয় দশক অতিক্রান্ত হলেও ভারতের প্রায় অর্ধেক মানুষ কার্যত নিরক্ষর। আর এই নিরক্ষর মানুষ অন্ধজনের সমান। কেননা তাঁদের চারিদিকে অজ্ঞানতার অন্ধকার। সেই নিরক্ষর অন্ধজনে প্রাণের প্রদীপ জ্বালাবে কে? কে জোগাবে মৃতজনে জীবনের উদ্ভাস? সে তো একজন শিক্ষক। আদর্শ শিক্ষক। একজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক। কেননা শিক্ষকরাই যুগে যুগে মানুষ গড়ার কারিগর। তাঁরাই দিনের পর দিন শিক্ষার্থীদের যথার্থ মানুষ করে তোলেন। তাঁদের কাছ থেকে পাঠ নিয়েই এই ছাত্র-ছাত্রীরা আদর্শ নাগরিক হয়ে ওঠে। দেশ ও জাতির মুখ উজ্জ্বল করে। সুতরাং সমাজে শিক্ষকের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ।আমার মতে, তারাই সর্বশ্রেষ্ঠ সমাজবন্ধু। তাঁরা সকলেই শ্রদ্ধাভাজন। এ হেন দৈনন্দিন শ্রেষ্ঠ সমাজ বন্ধুদের স্মরণে একটি বিশেষ দিন নির্দিষ্টকরণ একটি সামাজিক কর্তব্যও বটে। আর সেইটি যদি বিশিষ্ট শিক্ষাব্রতী ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণের জন্মদিনকেই উৎসর্গ করা হয় তবে তার মতো উপযুক্ত দিবস উদযাপনের তাৎপর্য আর কী বা হতে পারে।
শিক্ষক দিবস উপলক্ষে ৫ সেপ্টেম্বর দিনটিকে দেশের সর্বত্র যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে পালন করা হয়। এই দিনটিতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। প্রতিটি স্কুল কলেজে ওইদিন ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষকদের পুষ্প স্তবক দিয়ে সম্মান জানায়। নানা উপহার দেয়। মিষ্টিমুখ করায়। শিক্ষকরাও ঐদিন ছাত্র-ছাত্রীদের প্রাণভরে আশীর্বাদ করেন। তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করেন। শিক্ষক ও ছাত্রীর মধ্যে গড়ে ওঠে এক প্রীতির বন্ধন। কেন্দ্রীয় সরকার প্রতি বছর এই দিনে জাতীয় স্তরে বিভিন্ন কৃতি শিক্ষকদের সংবর্ধনা দেয়। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকেও এই দিন বিশিষ্ট শিক্ষকদের বাছাই করে সরকারিভাবে সম্মান জানানো হয়। চারিদিকে শিক্ষা বিষয়ক অনেক সেমিনার ও আলোচনাচক্র অনুষ্ঠিত হয়। শিক্ষা ও শিক্ষকের কল্যাণে অনেক কর্ম পরিকল্পনার কথা ঘোষিত হয়।
বিশেষ দিবস উদযাপন উপলক্ষে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষেরই কিছু ভাবনা কিছু দায়িত্ব ও করণীয় থাকে। আমি মনে করি, স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষে শিক্ষকদের এই দায়বদ্ধতা আরও অনেক বেশি। ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি সদয় কর্তব্যপরায়ণতা, নিষ্কলুষ চরিত্র, নিয়ম নিষ্ঠা ও সময়ানুবর্তিতা ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা শিক্ষকদের অন্যতম পালনীয় কর্তব্য। প্রতিবছর ‘শিক্ষক দিবস’ উদযাপন শিক্ষককূলের দায়িত্ব ও কর্তব্যকে যেন অনেকখানি বাড়িয়ে দেয়।
একটা সময় ছিল যখন আর্থিক দিক দিয়ে শিক্ষকতা জীবিকাটি তেমন আকর্ষণীয় ছিল না। বহু শিক্ষকের জীবন অতিবাহিত হত চরম অর্থ সংকটের মধ্যে দিয়ে। কিন্তু সময় পাল্টালেও এখনও আর্থিক সংকট কাটেনি। বেতন কাঠামোর উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয় নি। বেতন বৈষম্য রয়েই গিয়েছে। প্রতিদিনই পাল্লা দিয়ে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ছে। অথচ শিক্ষকদের ডিএ বা মহার্ঘ্য ভাতা বাড়ানো হচ্ছে না। দাবি আদায়ের জন্য শিক্ষকদের আন্দোলন করতে হচ্ছে। দাওয়াই হিসেবে অতি সক্রিয় পুলিশের লাঠি চার্জ ও জলকামানের অপব্যবহার তো আছেই। ন্যায্য অধিকারের দাবিতে শিক্ষকদের আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়েছে। চার বছর ধরে চলা এই আইনী লড়াইয়ে স্যাট ও উচ্চ আদালত দু’দুবার করে রায় দিয়েছে মহার্ঘ্য ভাতা সরকারী কর্মচারীদের অধিকার। বকেয়া ডিএ মিটিয়ে দেওয়ার জন্য উচ্চ আদালতের তরফে নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আজও তার বাস্তবায়ন হয়নি। অথচ খেলা, মেলা, মোচ্ছব, ক্লাব, পুজো কমিটিকে অনুদান খাতে দেদার অপচয় হচ্ছে।
ছাত্র-শিক্ষক অনুপাতে গোটা রাজ্যে সাড়ে তিন লক্ষ শূন্যপদ। নতুন নিয়োগ নেই বললেই চলে। যতটুকু হয়েছে তাতেও স্বচ্ছতার অভাব বলে অভিযোগ। আদালতের রায়ে প্রতিদিনই কেউ না কেউ বরখাস্ত হচ্ছেন। বলা হয়, শিক্ষকতা সম্মানজনক বিষয় অথচ অন্যদের কৃতকর্মের ফলে সাম্প্রতিক এই পরিস্থিতিতে অন্যান্য শিক্ষকদের ভাবমূর্তিও অনেকটা তলানিতে।
সমস্যা ছিল। এখনও আছে। সমস্যার সমাধানে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়ে সরকারকে এ বিষয়ে যথেষ্ট মনোযোগী,আন্তরিক ও মানবিক হতে হবে।
শিক্ষকতা এখন আর পাঁচটা আকর্ষণীয় জীবিকার পর্যায়েই পড়ে। তবুও বলা ভালো, আর পাঁচটা থেকে এই জীবিকা একেবারে স্বতন্ত্র। এ জীবিকা শুধু জীবিকামাত্র নয়। এ এক মহান ব্রত। দেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণের দায়িত্ব শিক্ষক সমাজের ওপর। ‘শিক্ষক দিবস’ সেই দায়িত্বের কথা প্রতিবছর এই দিনটিতে বিশেষভাবে স্মরণ করিয়ে দেয়।
যে কোনও সামগ্রিক কর্মযজ্ঞে সমাজের সকল স্তরের নিজস্ব ভূমিকা থাকে। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হওয়া কাম্য নয়। শিক্ষর স্বার্থে সমাজের প্রতিটি অংশ বিশেষ করে ছাত্র, অভিভাবক, সরকার ও অন্যান্য রাজনৈতিক দল বেশি মনোযোগ দেবেন এটাই কাম্য ও বিধেয়। সারা বছর ধরে শিক্ষাঙ্গনের সামগ্রিক পরিবেশ রক্ষা ছাত্র-শিক্ষক ও শিক্ষক- অভিভাবক সুসম্পর্ক বজায় রাখা, ছাত্রদের চরিত্র গঠনের প্রতি দৃষ্টি রাখা, শিক্ষকদের প্রতি উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করা এসবই সংশ্লিষ্ট সকলের একান্ত কর্ম বলে মনে করা নিশ্চয়ই অবান্তর হবে না।
তবে শিক্ষকদেরও মনে রাখতে হবে ‘শিক্ষক দিবসের’ গুরুত্ব ও তাৎপর্যের কথা। তাঁরা যদি তাঁদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন না হন, শিক্ষকতাকে কেবল একটা পেশা বা রোজগারের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেন তাহলে এই দিনটির কোনও তাৎপর্য থাকবে না।এটি হবে নিছকই একটি অনুষ্ঠান। আমি মনে করি, ‘শিক্ষক দিবসের’ মূল উদ্দেশ্য শিক্ষকদের কর্তব্য ও গুরুদায়িত্ব সম্বন্ধে সজাগ হওয়া।
আমাদের জাতীয় জীবনে শিক্ষা ও শিক্ষকের স্বার্থে ‘শিক্ষক দিবস’ উদযাপনের গুরুত্ব অপরিসীম। সমাজে শিক্ষককূল অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাঁরাই জাতির মেরুদন্ডস্বরূপ। তাঁরাই আগামী দিনের কান্ডারী-নির্মাতা। তাঁদের অবলম্বন, অনুকরণ ও অনুসরণ করেই ছাত্র সমাজ তথা ভবিষ্যতের সুনাগরিকবৃন্দ গড়ে ওঠে। তবে একথা অনস্বীকার্য, ভালো-খারাপ মিলিয়েই এই শিক্ষককূল। আমি মনে করি, উপযুক্ত শিক্ষকদের আরো শ্রদ্ধার আসনে বসাতে হবে। তাঁদের সব ধরনের নিরাপত্তা ও সুযোগ দিতে হবে। তাহলেই ভারত আত্মার শ্রেষ্ঠ প্রতীক দুর্জয়, মেধাবী, ভারত তথা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণের জন্ম দিবস তথা ‘শিক্ষক দিবস’ উদযাপন সার্থক হবে।