‘আয় আয় ছোটবেলা/কোথা গেলি চড়তে/ সাধ হয় একবার/ মুঠো করে ধরতে–।’ গতানুগতিকতার গড্ডালিকায় গা না ভাসিয়ে ভিন্ন ভাবনায়, কিন্তু বাস্তব প্রেক্ষাপটের ওপর ভিত্তি করে লেখা এমন আরও কিছু ছড়া-কবিতায় পরিপূর্ণ একটি ভাণ্ডারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব আজ। এ ভাণ্ডারের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে কবির মুন্সিয়ানার উজ্জ্বল ছাপ। নিখুঁত শব্দচয়ন ও লিখন শৈলীতে প্রতিটি কবিতাই হয়ে ওঠেছে অনন্য ও অনবদ্য।
যার কবিতার ভাণ্ডার ঘিরে এ আলোচনা- তিনি অবশেষ দাস। ওপার বাংলার কবি। তবে শুধু কবিতাই লেখেন না তিনি, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, গবেষণাসহ সাহিত্যের অনেক শাখা-প্রশাখাতেই আছে বিচরণ। পেশায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক।
বলতে দ্বিধা নেই, এপার বাংলার পাঠক হওয়ায় এর আগে অবশেষ দাসের কবিতা আমার নজরে আসেনি। কিন্তু সুযোগটি যখন এল, তখন একপলকেই লুফে নিলাম তার ‘কিশোর কবিতা সংগ্রহ’ বইটি। একটানে, অর্থাৎ বিরতি ছাড়াই পড়তে বাধ্য হলাম। বাধ্য হলাম এই কারণে যে, অবশেষের কবিতাগুলো আমাকে খানিক অবসরেও যেতে দিল না। এক কবিতা আরেক কবিতার কাছে টেনে নিয়ে গেল কঠিন আঠার মতো। তার কবিতার পিঠে ভর করে আমি হারিয়ে গেলাম শৈশবের আমবাগানে। গাঁয়ের আলপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম কংক্রিটের টাওয়ারে। আবার কখনও জীবনপথের পিছন রাস্তা ধরে চলে গেলাম হাটখোলার মেলায়। ডুবে গেলাম হালের সীমাহীন ও অদৃশ্য ভার্চুয়াল জগতে ‘সবকিছু আজ বদলে গেছে, টুইটারে/ কোথায় এখন যত্ন করে থুই তারে!’
কী নিয়ে লিখেননি অবশেষ? একেকটি ছড়া-কবিতা যেন একেকটি আয়না। হারিয়ে যাওয়া গ্রামের আঁকাবাঁকা মেঠোপথ, গ্রামীণ হাট, রথের মেলা, পুজো, খেয়াঘাট, মাটির ঘর, ভোর, বৃষ্টি, পলাশ, শীত, ফুল, স্বপ্ন, ইন্টারনেট, ইউটিউব- সবকিছু তুলে এনেছেন সে আয়নায়। মাটিবর্তী মানুষের জীবন, সমাজবৈষম্য, নগরজীবনের কৃত্রিমতা, অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থাদি, শিশুমনের কল্পনা প্রভৃতি কোনো কিছুই নজর এড়ায়নি তার। তার ভাবনার জগত অনুধাবন করে মনে হল, এখনও যেন ঠিক কিশোরকাল পার করছেন। একদমই বুড়ো হতে চান না। হারাতে চান না কৈশোরের সোনালী দিনগুলো। সত্যিই যেন সোনার খাঁচায় পুরে রেখেছেন। আর এ কারণেই ফিরে ফিরে ছুটে যান দূরন্ত শৈশবে বা কৈশোরে- ‘আয় আয় ছেলেবেলা/ দুলে দুলে লিখি/ আঁকা বাঁকা পথে গিয়ে/ নদী হতে শিখি’ অথবা ‘থেকে যায় ছেলেবেলা/ ডেকে যায় প্রায়/ বড় হয়ে মনপ্রাণ/ ছেলেবেলা চায়।’ এরকম অনেক ছড়া-কবিতাতেই ছোটদের মনের কথাগুলো স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। বিশ্বাস করি, ছড়াগুলো পড়লে শুধু ছোটরাই না, বড়দেরও মন হু হু করে উঠবে। চোখে ভাসবে বর্ণময় দিনগুলি। ভাবনার জগত সুতীব্র বলেই অনায়াসে লিখতে পারেন, ‘গাছের ছায়া লম্বা হলে রোদের মেজাজ কমে/ বিকেল যেন চোখ পেতে দেয় সান্ধ্য মনোরমে।/ একটি দুটি তারার আলো পুব আকাশের কোণে/ চমকে ওঠা ইচ্ছেগুলো ঢেউ খেলে নির্জনে।’
অবশেষের কবিতা পড়ে মনে হলো তিনি সস্তা জনপ্রিয়তার ধার ধারেন না। ইচ্ছে করেই গা ভাসাতে চান না হালের গড্ডালিকা প্রবাহে। অন্ধের মতো অনুকরণও করতে চান না অন্যের লেখাঝোঁকা। নিজস্ব একটা স্টাইল তৈরি করে নিয়েছেন তিনি। এক্সপিরিমেন্ট করার একটা প্রবণতা আছে তার মধ্যে। আর সে এক্সপিরিমেন্ট করেন অত্যন্ত আন্তরিকতায়, খুব যত্ন করে। এ কারণে অনেকের সঙ্গেই মিলবে না তার কিছু ছড়া-কবিতার ঢং। তার এ স্টাইল আমার মতো অনেকের মনে ধরবে।
অবশেষ দাস একজন শিক্ষক। শিক্ষকের মতো করেই ছড়া-কবিতার মধ্য দিয়ে একরকম পাঠদানেরও চেষ্টা আছে তার। ‘আগডুম বাগডুম’ ধরনের ছড়া-কবিতা তিনি খুব একটা লেখেন বা পছন্দ করেন বলে মনে হল না। যেমন: ‘উতুন বুতুন তত্তুরি/ ঝগড়াঝাটি ভাল্লাগে না/ তাই বলেছি ধুত্তুরি।’ দুষ্টুমির ছলে হলেও সবখানে একটা বার্তা দিতে চান।
শিশু-কিশোরদের জন্য আজকালকার লেখায় অনেক বেশি অতীত-কাতরতা বা নষ্টালজিয়ার ছাপ লক্ষ্য করি। আমাদের এই ছিল, সেই ছিল, আজ এই নেই, সেই নেই- ইত্যাদি ইত্যাদি। অবশেষের ‘কিশোর কবিতা সংগ্রহ’-তেও সেরকম কিছু বিষয় আছে। কিন্তু তার চেয়েও অনেক বেশি আছে সমাজের বিবর্তন বা বদলে যাওয়ার গল্প, এগিয়ে যাবার প্রেরণা। অতীতকে যেমন ভুলতে বলেননি, আবার তা নিয়ে বসে থাকতেও বলেননি। তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করার বার্তা দিয়েছেন। তার কম্পিউটার যুগ নিয়ে ছড়া- বদলে যাচ্ছে এই পৃথিবী/ হাজারটা হুজুগে/ আমরা সবাই আবর্তিত/ কম্পিউটার যুগে।
অবশেষ দাস ভালো করেই জানেন, শিশু-কিশোররা শুধু ফুল, ফল, পাখি, নদী বা মেলা-পার্বন নিয়েই পড়ে থাকে না। তাদের ভাবনার জগত অনেক বিস্তৃত। দেশ, সমাজ, রাজনীতি, বিশ্ব নিয়েও তারা নিজের মতো করে ভাবে। তাদের মন ফুলের মতো পবিত্র। পবিত্র মনের ভাবনাগুলোও পবিত্র হয়। তাই দেশ-সমাজে বিরাজমান দুঃখ-দুর্দশায়, অনাচারে তারা ব্যথিত হন। বোঝা গেল অবশেষ তা মাথায় রেখেই লেখালেখি করেন। এ কারণে কিশোরদের ব্যথিত মনের ভাবনগুলোও নিখুঁত বয়ানে তুলে আনতে পারেন তিনি: ‘তোমরা খাবে? তার বেলা?/ গরিব খাবে চারবেলা/ আমরা জানি কমবেশি/ বড়লোকের দম বেশি।’ অথবা ‘স্বাধীনতা নামেই স্বাধীনতা/ আড়াল থেকে ডাকতে থাকে ঘুঘু/ চোখের ভুলে পায়রা মনে হলে/ রাবণ সাজে অযোগধ্যারই রঘু।’
শিশু-কিশোররা এ্যাডভেঞ্চার প্রিয়। তারা বাধাহীন ঘুরতে বা বেড়াতে পছন্দ করে। ছুটি পেলেই তাদের ছুটতে ইচ্ছে করে নতুন কোনো স্থানে বা অভিযানে। অবশেষ দাসের কবিতাগুলো পড়লে তাদের অনায়াসে বেড়ানো বা ঘোরাঘুরিও হয়ে যাবে। রবীন্দ্রস্মৃতি বিজড়িত শান্তিনিকেতন, অযোধ্যা, ডায়মন্ডহারবার, দার্জিলিং, দিঘা, উদয়পুর, বাঁকুড়া, জয়পুর, বিষ্ণুপুর, জয়রামবাটী, সুন্দরবনসহ অনেক ভ্রমণস্পটের বর্ণনা আছে লেখায়।
ছড়া-কবিতার মধ্য দিয়ে শিশু-কিশোরদের মধ্যে দেশপ্রেম জাগাতেও সচেষ্ট কবি। কিছু কবিতা যেন শপথবাক্য। মাতৃভূমির প্রয়োজনে সর্বদা প্রস্তুত থাকার অঙ্গীকার করান এভাবে: আমি তো এক সেনা/ পণ করেছি মিটিয়ে দেব/ মাতৃভূমির দেনা।/ দেশ বাঁচাতে মান বাঁচাতে/ শহিদ হবে কে না!’
সব শিশু-কিশোররাই একদিন বড় হয়। আর বড় হতে হলে জানতে হয়। দেখতে হয়। জানতে জানতে আর দেখতে দেখতেই বড় হতে হয়। অবশেষ তার ছড়া-কবিতায় সেসব বিষয়গুলোরও জানান দিতে চেষ্টা করেছেন। তার ছড়া-কবিতা পড়লে শিশু-কিশোররা যেমন রবীন্দ্রনাথ, যোগীন্দ্রনাথ, অবন ঠাকুর, নজরুল, মধুসুদন, বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দকে জানতে পাবে, তেমনি জানতে পাবে সুভাষ বসু, লালন, গৌতম বুদ্ধ বা তাদের মতো অন্য মনীষীদেরকেও। নজরুলকে নিয়ে তার একটি কবিতার লাইন- হে বুলবুল কবি নজরুল/ বাজান বিষের বাঁশি/ বাঁশির সে সুর ছড়িয়ে দিল/ স্বপ্ন রাশি রাশি।’
ছড়া-কবিতায় শিশু-কিশোরদের ইতিহাসের জানান দিতেও ভুলেননি অবশেষ। তার অনেক ছড়া-কবিতায় উঠে এসেছে দেশভাগ, একুশ ও স্বাধীনতাসহ ঐতিহাসিক নানা প্রসঙ্গ। কয়েকটি ছড়ায় দেশভাগ নিয়ে তার মনোকষ্ট খুব ষ্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়েছে: এপার ওপার কাঁটার বেড়া/ সব ডুবে যাক জলে/ বিভেদ প্রাচীর হানাহানি/ নামুক অস্তাচলে।’ অথবা ‘বন্ধু বলে রফিক আমি/ বাংলাদেশে ঘর/ এপার বাংলা ওপার বাংলা/ কেউ কারও নয় পর।’
অবশেষ দাসের অনেক কবিতাই স্বতন্ত্র বৈশিষ্টমণ্ডিত। চাইলে প্রত্যেকটি ছড়া-কবিতা নিয়ে পৃথক আলোচনাও সম্ভব। কিন্তু এতে লেখার কলেবর বাড়বে। পাঠকের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটবে। তার ‘কিশোর কবিতা সংগ্রহ’ নামক বইটিতে ছড়া-কবিতার সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। ১শ ৪৬টি। দু-চারটের কথা বাদ দিলে বেশিরভাগই আমার ভালো লেগেছে। কোনো কোনোটি মনে রীতিমতো দাগ কেটে গেছে। ছড়া-কবিতাগুলোর অন্ত্যমিলও নিখুঁত এবং প্রাঞ্জল। আশা করি ছেলে-বুড়ো সবারই বইটি ভালো লাগবে।
আর এ ভালো লাগা থেকেই অবশেষ দাসের কাছে প্রত্যাশাও আরও বেড়ে গেল। আশা করবো, তিনি সাহিত্যের আর যেদিকেই মনোনিবেশ করুন, কবিতার কলম নিশ্চল করবেন না। তার কলম সচল থাকলে আমাদের প্রাপ্তির ডালিটি আরও বাহাড়ি এবং সমৃদ্ধ হবে। অশেষ শুভকামনা অবশেষ দাসের জন্য।
কিশোর কবিতা সংগ্রহ
কবি: অবশেষ দাস
প্রকাশক : অনিমা বিশ্বাস, গাঙচিল, ‘মাটির বাড়ি’, ওঙ্কার পার্ক, ঘোলা বাজার, কলকাতা।
বিক্রয়কেন্দ্র : কলেজ স্ট্রিট মার্কেট (বর্ণপরিচয়, দোতলা, গেট ৩), স্টল নং সি (পি) ৬, কলকাতা।
দাম: ৪০০টাকা (ভারতীয় রুপি)।