রবিবারের সন্ধে। বারান্দায় বসে সুবিমল কাপের গরম চায়ে খুশির চুমুক দিয়েও মনের গভীর থেকে দুর্ভাবনার ছায়া কিছুতেই দূর করতে পারছেন না। চারিদিকের অনুকূল পরিবেশ কেমন যেন প্রতিকূল হয়ে উঠছে। হাত ঝাড়লেই পর্বত, সেই পরিস্থিতি আর নেই। এতদিনের রাজনৈতিক জীবনের হিসেব নতুন অবস্থানে ঠিকমতো মিলছে না। মালতি সেদিন রাস্তাতেই শাসিয়ে দিয়েছিল, প্রয়োজন হলে মাকে সঙ্গে নিয়ে থানায় গিয়ে ওসির কাছে সব কথা প্রকাশ করে দেবে। একটাই ভরসা, মালতি এখন আর গ্রামে থাকে না। তার উপর রাগ করে কলকাতায় চলে গেছে। এভাবে চলে যাওয়াকেও সুবিমল আদৌ ভালো মনে নিতে পারেন নি। মাঝেমধ্যে খেপ খেলার সব সুযোগ নষ্ট করে দিলে মেয়েটা। এত করে বলার পরেও তাঁর কথা শুনল না। হাসপাতাল থেকে ফেরার পর মালতির শরীরটা বেশ গুছিয়ে উঠেছিল, সেদিকে নজর থাকলেও কিছুতেই কিছু করে উঠতে পারলেন না। মেয়েটা কেন যে হঠাৎ করে এত প্রতিবাদী হয়ে উঠল, তা মাথায় এল না সুবিমলের। ছত্রছায়ায় থাকলে কোনো ঝামেলা থাকত না। সেই সুযোগটুকু নিতে পারল না কেন? তিক্ততার বিরস ছায়া ফুটে উঠল সুবিমলের মুখে। জয় এসে দাঁড়ালো উঠোনের মাঝে, সুবিমলের ভারিক্কি প্রশ্ন, সকাল থেকে একবারও দেখতে পেলুম না কেন রে?
গুরু একটু….
সুবিমল হাসলেন, বুঝিয়ে দিলেন, জয় যা বলছে, তা ভালোমতোই জানা আছে তাঁর, তবুও প্রশ্নের খোঁচা দুচোখে, শোনার আগ্রহ হৃদয় জুড়ে।
জয় তো তো করে বলল, ওকে নিয়ে একটু যেতে হয়েছিল, রেখেই চলে এসেছি।
তাহলে ভালো খাওয়া দাওয়া হয়েছে নিশ্চয়?
জয় হেসে বুঝিয়ে দিল, তা হতেই হবে, দুমাস হল, জয় দেখেশুনে একটা সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করেছে বলেই মনের অন্ধ গলিপথ ধরে সুচরির পিছনে তাকে আর ছুটতে হয় না। মেয়েটা কেমন যেন অন্য রকম, সব বোঝে কিন্তু উত্তর দেওয়ার সময় যে ন্যাকামি করে, তা জয়ের এতটুকু ভালো লাগে নি।
সুবিমল এক ঝলক মৃদু হেসে জয়ের দিকে চেয়ে থাকলেন।
হাসছেন যে?
এভাবে হেরে যাবি, বুঝতে পারি নি।
কিছুতেই মেয়েটার তল খুঁজে পাচ্ছিলুম না। বয়সও বেড়ে যাচ্ছিল।
বিয়ের পরেও কী সুচরিতার কথা মনে পড়ে তোর?
খুব মনে পড়ে সুবিমলদা, আমার প্রথম ভালোবাসা।
এভাবেই বলছিস? সুচরি কী কোনোদিন তোকে ভালোবাসার কথা বলেছে?
তা বলে নি কিন্তু আমার ভালোলাগা শেষ পর্যন্ত ভালোবাসায় পরিণত হয়েছিল, সুচরি তার মূল্য দিতে পারে নি।
আঙুর ফল টক হিসেবে সারা জীবন সংসারযাত্রা চালিয়ে যাবি?
জানেন সুবিমলদা, মাত্র দুমাস বিয়ে হয়েছে, তাতেই বুঝেছি, বিয়ের পরে পরে মানুষ এত মাংসাশি হয়ে ওঠে যে মন নিয়ে খুব বেশি দিন পড়ে থাকতে পারে না। বাধ্য হয়ে তাকে কঠোর বাস্তবে চলতে শিখতে হয়।
সুবিমল হো হো শব্দে হেসে না উঠে পারলেন না। জয়ও তাতে যোগ দিল। হাসি থামিয়ে সুবিমলের প্রশ্ন, এখন একটু থানায় যেতে পারবি?
খুব জরুরি?
তা বলতে পারিস।
গর্বিত হল জয়। এত বছর সুবিমলের সঙ্গে ছায়াসঙ্গীর মতো ঘুরতে হলেও রায়দা কোনোদিন তাকে একা একা থানায় যেতে বলেন নি। বলল, তাহলে কোন অফিসারকে কী বলতে হবে, বলে দিন।
তুই তো রত্নেশ্বরবাবুকে চিনিস, থানার সেকেন্ড অফিসার, ওঁর সঙ্গে দেখা করে জানতে চাইবি, কালিতলার ঘটনা নতুন মোড় নিল কিনা। সুযোগ পেলে অন্য খবর থাকলে তা অবশ্যই জেনে নিবি, তবে বেশি দেরি করিস নে, যাবি, কাজ সারবি আর চলে আসবি। অন্যত্র একটা প্রোগ্রাম রয়েছে, তুই এলে দুজনে মিলে সেখানে যাব।
জয় অভিনব মানসিক কৃতজ্ঞতায় জারিত হল। সুবিমলদার কারণে ব্যক্তিগত জীবনে সে একেবারে কম পায় নি। ইতিমধ্যে ব্লকভিত্তিক সংগঠনে জায়গা করে নিতে পেরেছে। গুরু বলেছেন, ছ’মাসের মধ্যে চাকরি করে দেবেন। প্রসেসিং কমপ্লিট হয়ে গেছে, যে কোনো সময় এ্যাপয়েন্টমেন্ট চলে আসতে পারে। এ নিয়ে সুবিমলের উপর তার বিশ্বাসে এতটুকু ঘাটতি নেই। লোকটা বহু অসাধ্য সাধন করতে পেরেছেন এমন দৃষ্টান্ত রয়েছে। তাই জয়ের স্থির বিশ্বাস, তার চাকরির ব্যবস্থা নিশ্চয় হয়ে যাবে। লোকটা অনেক বড়ো কপাল নিয়ে জন্মেছেন, যে কোনো কাজে হাত দিলে তা সোনা হয়ে যায়।
ভাবনার প্রবল স্রোত মাথায় নিয়ে জয় সাইকেলে এগিয়ে চলল, যেতে খুব বেশি সময় লাগল না, থানার পাশে সাইকেলটা রেখে দিয়ে ভিতরে ঢুকল। সেই প্রথম একা একা থানায় আসতে হল তাকে। বাড়তি উদ্যমের মধ্যে কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। রত্নেশ্বরবাবু সবেমাত্র অন্য কোথাও থেকে ফিরেছেন, শান্ত হয়ে চেয়ারে বসতে একটু সময় দিতে হবে। সুবিমলের সঙ্গে চলতে চলতে এ বোধ আগেই শিখে ফেলেছিল সে। আরও মিনিট দশেক গেল, রত্নেশ্বরবাবু হাত মুখ ধুয়ে রুমালে মুখ মুছে চেয়ারে জাঁকিয়ে বসে সিগারেটে সুখটান দিতে শুরু করলেন। জয় ভাবল, আর কোনো অসুবিধা নেই। বিনীত মুখে সামনে গিয়ে দাঁড়াল কিন্তু কিছুই বলতে হল না তাকে, ঘুরিয়ে রত্নেশ্বরবাবু প্রশ্ন করলেন, জয়বাবু নতুন কোনো খবর আছে কী?
রত্নেশ্বরবাবু জয়কে আগে থেকেই চিনতেন। অনেকবার সুবিমলবাবুর সঙ্গে দেখেছেন, সেই সুবাদে ভালো সৌজন্য দেখাতে ভুল করলেন না।
জয় মানসিক স্বস্তি নিয়ে বলল, সুবিমলদা পাঠিয়েছেন কালিতলার ঘটনা সম্পর্কে নতুন কোনো তথ্য থাকলে তা জেনে নিতে।
এ নিয়ে সুবিমলবাবুকে এতটুকু ভাবতে হবে না, কেস আমার হাতে থাকলেও স্বয়ং ওসি নিজেই সবকিছু ডিল করছেন। গতকাল বিকেলে প্রতিপক্ষের কয়েকজন এসেছিল কিন্তু বড়বাবুর ধমকানিতে সরে পড়তে বাধ্য হয়েছে, এতটুকু সুবিধে করতে পারে নি। তাছাড়া সুবিমলবাবু সুকৌশলে থানার উপর যে চাপ রেখে চলেছেন, তা সহজে এড়িয়ে চলা কোনো অফিসারের পক্ষে সম্ভব নয়।
জয় গুরুর গর্বে আপ্লুত না হয়ে পারল না। গম্ভীর হয়ে বলল, অন্য কোনো খবর নেই তো?
সেরকম কোনো খবর নেই, তবে ওই মেয়েটি গতকাল শেষ বিকেলে থানায় এসেছিল।
কে বলুন তো?
অনেকবার আপনাদের সঙ্গে ঘুরতে দেখেছি। বেশ ফর্সা, সুন্দর মুখশ্রী, দীর্ঘাঙ্গী বললে ভুল হবে না।
সুচরিতার কথা বলছেন?
হ্যাঁ হ্যাঁ ওই মেয়েটি, এতক্ষণ নামটা মনে করতে পারছিলুম না।
কী জন্যে এসেছিল বলতে পারবেন?
ওসির ঘরে বসে কথা, বেশ সময় নিয়ে, মেয়েটাকে দেখে খুব সিরিয়াস বলে মনে হল। ফিরে যাবার সময় আমার দিকে এক পলক তাকালেও কোনো কথা বলে নি। সঙ্গে আরেকজন ছিল।
ওসিকে কী বলল জানতে পেরেছেন কী?
তা সম্ভব হয় নি।
সঙ্গে থাকা ছেলেটিকে চেনেন?
অনেকবার দেখেছি। এই মুহূর্তে ওই নামটাও মনে করতে পারছি নে।
জয় আর সেই প্রসঙ্গে গেল না বরং বুদ্ধির অলিতে গলিতে যে নতুন প্রসঙ্গ উঠে এল, তার পর্যালোচনায় ব্যস্ত হয়ে উঠল। সুবিমলদা কী সুচরিকে একা একা থানা ডিল করার অনুমতি দিয়েছেন? সবেমাত্র সংগঠনে যোগদান করে মেয়েটা এত বড়ো অফার পেয়ে গেল? ভিতরে ভিতরে বেশ রুষ্ট হল জয়, এ সুযোগটুকুও তার পাওয়া উচিত বলে ভাবল। এত বছরের কঠোর পরিশ্রম, দায়েঘায়ে লেগে থাকা, সেসবের কী কোনো মূল্য নেই? মানসিক বিক্ষোভ ও প্রক্ষিপ্ত অভিমান নিয়ে জয় সাইকেলে সুবিমলের বাড়ির সামনে এসে উপস্থিত হল। রায়বাবু তটস্থ হয়ে ডাকলেন, ভিতরে আয়, নতুন কোনো খবর থাকলে শুনি।
জয় গম্ভীর হয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকল।
সুবিমলের তটস্থ প্রশ্ন, খবর কী বল?
জয় চুপ করে থাকল।
সুবিমলের মধ্যে নতুন অঙ্ক কষা শুরু হল। ডাক্তার তপতী চ্যাটার্জী তাঁর নামে ওসির কাছে কিছু বলে যায় নি তো? নাকি অন্য কোনো খারাপ প্রসঙ্গ শুনে জয় এভাবে গুরুগম্ভীর হয়ে গেল? —আরে কথা বলছিস না কেন?
শুধু শুধু বাজে বকে লাভ কী?
তোকে কাজের কথা বলতে বলেছি, রত্নেশ্বরবাবু কী জানালেন, সেটাই বলবি তো।
ওই মেয়েটাকে একা থানায় পাঠানোর অনুমতি দিয়ে ঠিক করলেন? এভাবে কী কাউকে জোর করে নেত্রী করে তোলা যায়?
কার কথা বলছিস তুই?
সুচরিতা।
সুবিমলের বুকের গভীরে ঢেঁকি পড়ার শব্দ শুরু হল যদিও তা মুখের মৃদু হাসির আড়ালে চেপে রেখে বেশ রাগত হয়ে বললেন, ওকে কে থানায় যেতে বলেছে?
রত্নেশ্বরবাবু উপযাচক হয়ে সেই খবর দিলেন।
ক’দিনেই মাথা ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়া শিখে গেল?
তাহলে আপনি যেতে বলেন নি?
এভাবে ভাবতে পারলি তুই? সংগঠনের সেকেন্ড ইন কমান্ডকে বাদ দিয়ে ওই মেয়েটাকে প্রেফার করতে যাব কেন? অবশ্য অন্য দরকারে নিজের মতো থানায় যেতেই পারে, সেই স্বাধীনতা সকলের আছে।
তপ্ত জয় গলে জল হয়ে গেল। সুবিমল হুকুমের স্বরে প্রশ্ন করলেন, একটা কাজ করতে পারবি?
কী বলুন?
আগামিকাল সন্ধেয় সুচরির বিরুদ্ধে সুচরির গ্রামে সালিশি ডাকার ব্যবস্থা করতে পারবি? তাহলে প্রদীপের মতো মেয়েটাকেও ঘেঁটে দিতে পারি।
জয় সম্পূর্ণ নিশ্চিত হয়ে গেল যে সুচরির থানায় যাওয়ার পিছনে সুবিমলদার কোনো হাত নেই কিন্তু যেটা আদৌ বুঝতে পারল না, তা হল, সুবিমলদা সুচরির থানায় যাওয়ার কথা শুনে এভাবে ভিতরে ভিতরে দুমড়ে মুচড়ে গেল কেন?
তখনও সুবিমলের বুকের গভীরে নতুন ভয়ের প্রতিধ্বনি ওঠানামা করছে। অন্ধকার পথে জড়িয়ে ধরার ঘটনা নিয়ে সুচরিতা ওসির কাছে লিখিত নালিশ জানাতে যায় নিতো? মনে পড়ল কলেজের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার প্রথম দিনে ব্লাক আউটের সময় সুচরিতার হাতের উপর তাঁর পাঁচ আঙুল চেপে বসার দৃশ্য। সুচরিতা কী মূল অভিযোগের সঙ্গে সেই প্রসঙ্গটা জুড়ে দিল? সুবিমলের মধ্যে নতুন কম্পন শুরু হল।
জয় নরম হয়ে বলল, আমাকে নিয়ে কোথায় যাবেন বলেছিলেন?
গেলে ভালো হত কিন্তু আজ আর কোথাও যেতে মন চাচ্ছে না। তুই বাড়িতে ফিরে যা, হিসেবে কেমন সব গোলমাল দেখতে পাচ্ছি, কিছুতেই অঙ্ক মিলছে না।
খুলে বলতে পারতেন।
সুবিমল ফিক্ করে হেসে ফেললেন, ওরে, এতদিনে ওসির উচিত ছিল কালিতলার ঘটনা নিয়ে ফাইনাল রিপোর্ট দেওয়া, তাহলে রত্নেশ্বরবাবু সেই রিপোর্ট তোকে দিতেন। তা আনতে পেরেছিস কী? এমনি কত গরমিল ধরা পড়ছে।
দিনটা যে অন্য কারণে সুবিমলের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ, তা প্রকাশ করলেন না জয়ের কাছে। রাজনীতি নামক সম্ভাবনার শিল্প রোজ রোজ বর্ধিত রূপ গ্রহণ করে বলেই তার ভিতরে রয়েছে গোপনীয়তার সূক্ষ্ম মারপ্যাচ। সুবিমল তা মর্মে মর্মে বোঝেন বলেই তাৎক্ষণিক পরিস্থিতির জটিলতা জয়কে এতটুকু জানতে দিলেন না।
সন্ধের বুকে দখিনে বাতাস, অন্ধকারের ভ্রূকুটি বেড়েই চলেছে। সুবিমল সদর গেটে লক্ করে দিয়ে ছাদের উপর উঠে গেলেন। যতক্ষণ না খবর আসছে ততক্ষণ তাঁকে এভাবেই অপেক্ষা করতে হবে, তবে রঘুর উপর পরিপূর্ণ আস্থা রয়েছে তাঁর। দুজন বাহবা পাওয়ার মতো সঙ্গী পেয়েছে ছেলেটা। কেল্টে ভোল্টের হাত চলে রঘুর চেয়ে অনেক বেশি কিন্তু মাথা মোটা বলেই রঘু নেতৃত্বে থেকে গেছে।
রাত আটটা, সুবিমল ছাদের উপর চেয়ারে বসে থাকতে থাকতে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়লেন, সময় গোনার ক্লান্তি তাঁর সারা শরীর জুড়ে। নটার মধ্যে এ্যাকশন শেষ হলে নিশ্চয় কেউ না কেউ তাঁকে খবর দিতে আসত। প্রত্যাশ্যার গভীরে সুবিমল এত বেশি ঢুকে পড়লেন যে শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে অভিনব হাঁপানি শুরু হয়েছে, বিষধর কেউটের শিস মারার মতো।
বাড়ির সামনে বড়ো কৃষ্ণচূড়া গাছ। থোকা থোকা লাল ফুলে ভরে উঠেছে কিন্তু সুবিমল অন্ধকার ফুঁড়ে কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। দেখার জন্যে ভিতরের খিদেও ছিল না। দু’কান সজাগ রেখে বসে থাকলেন মানুষের পদধ্বনি শোনার জন্যে। কাজ সারা হয়ে গেলেই ওদের কাছে আত্মরক্ষার প্রশ্ন বড়ো হয়ে উঠবে, তাঁর কাছে না এসে পারবে না। একটু পরে শুনলেন দৌড়ে আসার সেই প্রত্যাশিত পায়ের শব্দ, মনে হল দু’তিনজন একসঙ্গে ছুটে আসছে।
সুবিমল দ্রুত ছাদ থেকে নেমে এসে পশ্চিম প্রান্তের ঘরের ভিতরে দাঁড়িয়ে সামনের জানালা খুলে দিয়ে দেখলেন, রঘু রক্তমাখা জামা গায়ে চরম উৎসুক্য মুখে দাঁড়িয়ে।
খবর কী রে?
সেরে দিয়েছি গুরু কিন্তু আজকের রাতটুকু থাকব কোথায়? আপনার বাড়িতে?
পুলিশকে এত বোকা ভাবছিস? একটু পরে থানার লোকজন নিশ্চয় এখানে খোঁজ নিতে আসবে।
তা বলেছেন ঠিক কিন্তু একটা উপায় তো বের করতে হবে।
রঘুর জামার অর্ধেক রক্তে ভিজে উঠেছে, মুখেও ছোপ ছোপ রক্তের দাগ, এ অবস্থায় তাঁর বাড়িতে ধরা পড়লে তাঁর পক্ষেও তা চরম বিপদের হয়ে উঠতে পারে। একটু ভেবে নিয়ে বললেন, মাঠে নেমে আধদৌড়ে সোজা চলে যা কালিতলায়, আমার খামার বাড়িতে, চারদিক ঘেরা, কদিন আগে খড়ো ঘরটা মেরামত করেছি, থাকতে কোনো অসুবিধা হবে না। আপাতত রাতটুকু ওখানে থেকে যা, দিনেও কোথাও বের হবি না। সকালে যা করার আমিই করব, থানায় গিয়ে দ্রুত গেমপ্লান সেরে নেব। মাঠে চলতে চলতে একবারও টর্চ মারবি নে। এতক্ষণ নিশ্চয় এ ঘটনার খবর থানায় পৌঁছে গেছে, তাই বলছি সাবধান হয়ে চলতে।
অবস্থানটা রঘুর মাথায় ধরল। সুবিমলদার বাড়িতে থাকলে ধরা পড়ার ভয় যে খুব বেশি, তাও মেনে নিল। তার চেয়ে অনেক ভালো পোড়ো খামার বাড়িতে গিয়ে রাত কাটানো, পুলিশের পক্ষে সহজে সন্ধান পাওয়া সম্ভব হবে না। অনেক বেশি নিরাপদ। তাহলে আসছি সুবিমলদা।
ঘরের চাবিটা নিবি নে?
হাত বাড়িয়ে দিন।
অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে রঘুরা কেটে পড়ল। রাতটুকু সুবিমলদার খামার বাড়িতে কাটানো ছাড়া তাদের সামনে অন্য কোনো পছন্দ নেই। সকাল হলে থানায় গিয়ে নিশ্চয় একটা ভালো ব্যবস্থা করবেন। বড়বাবুর সঙ্গে সুবিমলের দহরম মহরমের খবর রঘু আগে থেকেই জানত।
সুবিমল আবার অন্ধকার ছাদে উঠে একা একা পায়চারি করতে লাগলেন,নানা ধরনের প্লট মাথায় ঘুরছে। থানার ওসি কতটা কড়া পদক্ষেপ নেবেন, তার উপর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নির্ভর করছে। একটু পরে দেখলেন, পশ্চিমের সদর রাস্তা ধরে পুলিশ ভ্যান সজোরে ছুটে আসছে তাঁর বাড়ির দিকে। হর্ণের তীব্র শব্দে একবার চমকে উঠলেন। সচকিত হয়ে দ্রুত নীচে নেমে এসে সদর গেট খুলে দিয়ে সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে বললেন, আসুন বড়বাবু, নিশ্চয় কোনো বড়ো ঘটনার কথা শোনাতে এসেছেন।
একটু নিরিবিলি কথা বলতে চাই।
তাহলে ছাদের উপরে চলুন। ওসিকে সঙ্গে নিয়ে সুবিমল সিঁড়ি ভেঙে ছাদের উপর উঠে গেলেন। ওসির প্রথম প্রশ্ন, শুনে ফেলেছেন নিশ্চয়।
এত বড়ো ঘটনা, না শোনার কী আছে।
আপনার পরামর্শ নিতে এসেছি।
যে সিদ্ধান্ত নেবেন, তাতেই মদত দেব।
এরপর রঘুকে প্রশ্রয় দিলে আপনি নিজেই বিপদে পড়ে যাবেন। তা করতে যাবেন কেন? নিজের রাজনীতি নষ্ট করে কষ্টে গড়ে তোলা ইমেজকে তলানিতে ঠেকিয়ে দিতে যাবেন না।
আপনার সিদ্ধান্ত ফাইনাল, কেউ লাগাম ছাড়া হয়ে গেলে প্রকৃতির নিয়ম মেনে তাকে শাস্তি পেতেই হবে।
আমার সঙ্গে একটু থানায় যাবেন কী?
আপনি চাইলেই যাব।
তাহলে আমার চেম্বারে এসে এ্যাকশন প্লানটা ফাইনাল করে নিতে পারতুম।
তাই চলুন, সাদর সম্মতি দিলেন সুবিমল।
ওসি যারপরনাই খুশি না হয়ে পারলেন না। মনের পুলকে ভাসলেন, সামনে প্রমোশনের হাতছানি রয়েছে। রায়বাবুর সাহায্য নিয়ে উতরে যেতে পারলেই কেউ তার পদোন্নতি ঠেকাতে পারবে না। নতুন আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন ওসির দুচোখে চিকচিক করে উঠল।
সুবিমল দ্রুত জামা প্যান্ট পাল্টে পুলিশ ভ্যানের ভিতরে গিয়ে বসলেন। মাত্র কয়েক মিনিট লাগল মথুরাপুর থানায় পৌঁছাতে। ওসি তখন সত্যি বেপরোয়া,সুবিমলকে বললেন, আসতে আসতে সব কথা হয়েছে, ততক্ষণ আমার চেম্বারে অপেক্ষা করুন, রাতের রেইড সেরে আসতে দিন। আপনার দেওয়া সব তথ্য ঠিক আছে তো?
আমার হিসেব ভুল হতে পারে না।
রাত দুটো, দেওয়াল ঘড়ির ঢং শব্দ তা জানিয়ে দিল। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার, সুবিমলের মাথার ভিতরে ঘুরছে নানা ধরনে ছক। ধরা পড়ার পরে রঘু বেঁচে থাকলে প্লটটা কেমন হতে পারে, সংঘর্ষে মারা গেলে পরিবর্তিত পরিস্থিতি কেমন হতে পারে, দৃশ্যগুলো পর পর গ্রাফ হয়ে ভেসে উঠছে তাঁর মনের ইজেলে। ওসি দশ সদস্যের স্কোয়াড নিয়ে দ্রুত বের হয়ে গেলেন, চেম্বারে বসে সুবিমল অপেক্ষায় থাকলেন, রাত এগিয়ে চলল প্রকৃতির নিয়ম মেনে। সুবিমল বসে বসে রঘুর মৃত্যু কামনায় ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। রাজনীতির অঙ্ক বলছে, পালিয়ে গেলে তাঁর সামনে নতুন বিপদ চলে আসতে পারে। ওসি যেভাবে দলবল নিয়ে বের হয়ে গেলেন, তাতেই রঘু-পুলিশের গুলি বিনিময়ের মধ্যে মৃত্যুদৃশ্য দেখতে পাচ্ছেন সুবিমল। রঘুর হাতে জয়ন্ত দেবনাথের মৃত্যু দৃশ্য অনেকেই দেখে ফেলেছে, এখনিই হাত ধুয়ে ফেলতে না পারলে তাঁর রাজনৈতিক জীবনে প্রতিকূলতার ছায়া প্রলম্বিত হতে পারে, সেই সুযোগ দেওয়া কিছুতেই ঠিক হবে না।
মিনিট কুড়ি পরে পুলিশ ভ্যান গোঁ গোঁ শব্দে থানায় ফিরে এল। সুবিমলের বুকের গভীরে ঢেঁকি পড়ার শব্দ। নেমেই ওসিসাব গর্জে উঠলেন, ঠিক প্লটের সন্ধান পেয়েও শালাকে মারতে পারলুম না, কী করে যে পালিয়ে গেল।
সুবিমল ব্যস্ত হয়ে চেম্বারের বাইরে এসে দেখলেন, রঘুর দুই নতুন সাকরেদ নন্টে আর ননি গুলিবিদ্ধ হয়ে পুলিশ ভ্যানের ভিতরে নিথর দেহে পড়ে আছে। রঘু কেল্টে আর ভোল্টেকে সঙ্গে নিয়ে সরে পড়তে সমর্থ হয়েছে। সুবিমলের বুকের গভীরে কালবৈশাখী ঝড়ের তান্ডব, এতদিনের রাজনৈতিক জীবনে কখনো এভাবে টার্গেট ফেল করতে হয় নি তাঁকে।
ওসি সরে এসে সুবিমলের সামনে দাঁড়িয়ে আক্ষেপের সুরে বললেন, নির্দিষ্ট প্লান মাথায় নিয়ে নিজের হাতেই গুলি করেছি শুয়োরের বাচ্চাকে, লেগেছেও কিন্তু কী করে যে কী হয়ে গেল। শালা কই মাছের প্রাণ নিয়ে জন্মেছে, পরবর্তী প্লান কী হতে পারে বলুন?
ও সব প্রশাসনের ব্যাপার, সাহায্য চেয়েছিলেন, তা মন খুলে দিতে পেরেছি,বাকি ভাবনা আপনার। কী করবেন, কী করবেন না, তা আপনাকেই ভাবতে হবে।
তাহলে তো অত বড়ো একটা ক্রিমিনাল অধরাই থেকে যাবে।
একটা প্রসঙ্গ মনে রাখবেন, আবেগের প্রাবাল্য নিয়ে প্রশাসন চালানো যায় না।
ওসি অবাক দৃষ্টি মেলে চেয়ে থাকলেন সুবিমলের দিকে।
এ ঘটনা আমার রাজনৈতিক জীবনে কত বেশি রিস্কের হয়ে উঠল, তা নিয়ে নিরিবিলি ভাববেন।
ওসি থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকলেন, সুবিমল খুব ভোরে বাড়িতে ফিরেই লোক পাঠিয়ে জয়কে ডেকে নিলেন। অভিনব রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা মাথার উপরে, কঠোর হাতে মোকাবিলা করা ছাড়া উপায় নেই। নিজের পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি ধরে রাখতে তাঁকে বজ্রকঠিন হতেই হবে। নতুন পরিস্থিতি নতুন বার্তা দিচ্ছে তাঁকে। বললেন, এখন আর রঘুর কথা ভেবে লাভ নেই জয় বরং নিজেদের কথা অনেক বেশি করে ভাবতে হবে। একটা মতলব মাথায় ঘুরছে।
বলুন শুনি।
কাল বিকেলে হাজার পাঁচেক লোক নিয়ে থানায় ডেপুটেশন দেওয়া যায় না?
তাতে লাভ কী?
নিজেদের পরিচ্ছন্নতা ধরে রাখার নতুন দায়বদ্ধতা, এর বাইরে কোনো পথ আছে কী? এখনিই হ্যান্ডবিলের খসড়া করে দিচ্ছি, বাজারে গিয়ে সামিমের কম্পিউটার সেন্টার থেকে ডি.টি.পি’র কপি বের করে হাজার চারেক হ্যান্ডবিল ছাপিয়ে বাজারে ছেড়ে দে।
রঘু কী আর আমাদের পক্ষে থাকবে?
থাকলেই বিপদের, বরং যাতে না থাকে তার জন্যেই এমনি ডেপুটেশনের আয়োজন করছি, সংগঠন টিকে থাকলে ওরকম অনেক রঘু এসে পাশে দাঁড়াবে।
ছেলেটা একধরনের সুপারি কিলার।
সেজন্যে ওসি রয়েছেন, যা ব্যবস্থা করার উনিই করবেন, দু-একদিনের মধ্যে ধরা পড়বেই।
তাহলে হ্যান্ডবিলের খসড়া করে দিন।
সুবিমল লিখতে শুরু করলেন….
এলাকার সাধারণ মানুষকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে জানাচ্ছি যে জয়ন্ত দেবনাথের সঙ্গে আমাদের আদর্শগত গরমিল থাকলেও দেশগঠনে পারস্পরিক শ্রদ্ধার ক্ষেত্রে এতটুকু ঘাটতি ছিল না। এলাকার বহু উন্নয়নমুলক কাজে আমরা তাঁর প্রত্যক্ষ সমর্থন পেয়েছি। সেকথা আজ সবচেয়ে বেশি করে মনে পড়ছে। তাঁর মতো একজন উচ্চমানের মানুষকে শেষ পর্যন্ত প্রাণ দিতে হল সমাজবিরোধীদের হাতে। এই যন্ত্রণা কিছুতেই ভোলার নয়। এ ঘটনার তীব্র নিন্দা করছি আমরা। আমরা চাই প্রকৃত অপরাধীকে ধরে প্রশাসনের পক্ষে থেকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হোক। সেজন্যে আগামিকাল ৪ঠা বৈশাখ রবিবার বিকেল তিনটের সময় থানার সামনে গণবিক্ষোভের আয়োজন করেছি। আপনাদের কাছে বিনীত আবেদন, দলে দলে যোগ দিয়ে স্বচ্ছ সুস্থ সামাজিক অবস্থান বজায় রাখতে আমাদের পাশে থাকুন।
বিনীত—
তারিখ – ৩ বৈশাখ, ১৩১৪ সুবিমল রায়
সুবিমলের রাজনৈতিক দরকারগুলো কত বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা প্রেস মালিক সামিম ভালোমতোই জানত বলেই বলল, ঠিক আছে, কোনো অসুবিধা হবে না, দুপুরের মধ্যে ছাপা শেষ করব, কত হাজার হবে?
সুবিমলদা চার হাজারের কথা বলেছেন।
দুপুরের মধ্যে হ্যান্ডবিলগুলো রায়বাবুর বাড়িতে পাঠিয়ে দেব কী?
তাই দেবেন। জয় ফিরে গেল সুবিমলের বাড়িতে।
খবর কী রে?
দুপুরের মধ্যে ছাপা কমপ্লিট হবে।
তাহলে তো আর দেরি করা চলে না। সুবিমল কয়েকজনের কাছে সংক্ষিপ্ত পত্র লিখতে শুরু করলেন। জয়কে বললেন, প্রত্যেকটা খামের মধ্যে একটা করে হ্যান্ডবিল ঢুকিয়ে দিতে হবে।
বেশ তো, ওগুলো আমিই করে দিচ্ছি।
সুবিমল লিখতে শুরু করলেন—
রতন,
শনিবার বিকেলে থানার সামনে দুশো লোক নিয়ে আসতে হবে। হ্যান্ডবিলে সময় উল্লেখ করে দেওয়া হয়েছে।
স্নেহের পলাশ,
ঘটনা শুনেই তুই বলেছিলি, থানায় ডেপুটেশন দেওয়া খুব প্রয়োজন। সেই আয়োজন করেছি শনিবার। হ্যান্ডবিল পড়লে সব বুঝতে পারবি।
আব্দুল,
তোর সমস্যা নিয়ে ওসির সঙ্গে কথা হয়েছে, তোকেই সমর্থন করেছেন ওসি। শনিবার ডেপুটেশনে আসতেই হবে। সঙ্গে যতটা সম্ভব লোকজন নিয়ে আসবি।
প্রিয় ভুবন,
কাল শনিবার থানায় ডেপুটেশন দেব বলে ঠিক করেছি। অবশ্যই আসতে হবে। ক্লাবে বললে তো বেশ কয়েকজনকে পেয়ে যাবি।
সাগিরদা,
নিশ্চয় সব জেনে ফেলেছেন। সংগঠনকে উপরে তুলে ধরার দায় আমাদের সকলের। তা নিশ্চয় আপনাকে বুঝিয়ে বলতে হবে না। সভায় লোকসংখ্যা বাড়ানোর দিকে নজর রাখবেন।
নিধু,
অন্তত দুশো লোক নিয়ে আসবি। হ্যান্ডবিল পড়লে গুরুত্ব বুঝতে পারবি। আর কাউকে পত্র দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলেন না সুবিমল। কুল্পি, জয়নগর, ঢোলা, রায়দিঘীর মতো বেশ কিছু জায়গায় ইতিমধ্যে খবর পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। জয়কে বললেন, যত অসুবিধা হোক, পত্রগুলো দিয়ে আসতে হবে। বাকি হ্যান্ডবিলগুলো সন্ধের সময় বাজার আর স্টেশন প্লাটফর্মে বিলি করে দিতে পারলে ডেপুটেশনে লোক পেতে কোনো অসুবিধা হবে না।
বিকেলে জয় আবার এল হ্যান্ডবিলগুলো এসেছে কিনা তা আনতে।
সুবিমল ঘরের ভিতর থেকে হ্যান্ডবিলের বান্ডিলগুলো বারান্দায় আনতে আনতে বললেন, দেখছি, সামিম আমাদের কাজে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে শিখেছে।
আপনার কথা বিশেষ করে বলেছিলাম।
ওকে ধন্যবাদ দিতেই হবে।
জয় হ্যান্ডবিলগুলো প্যাকেটে ঢুকিয়ে সাইকেলে বের হয়ে পড়ল। সভায় লোক জমাতে পারবে কিনা, তা এক ঝলক ভেবে নিল কিন্তু সাইকেলের গতির তালে সেই ভাবনা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। তিরের ফলার মতো এ গ্রাম থেকে সে গ্রাম পৌঁছে যেতে লাগল জয়, একটাই কথা, বড়ো সাংঘাতিক ঘটনা, সুবিমলদা বলে পাঠিয়েছেন, সকলকে যেতেই হবে। কঠোর ব্যবস্থা না নিলে নয়। জয়ের ওই এক দোষ, দ্রুত উচ্চারণের সময় ব্যবস্থা শব্দটাকে সে ব্যেবস্থা বলে উচ্চারণ করবেই। ভেবে নিল, সন্ধেয় বাজার জমলে হ্যান্ডবিলগুলো হাতে হাতে তুলে দিতে হবে। স্টেশনে একজনকে পাঠানোর কথাও ভেবে নিল।
পরের দিন শনিবার, সকালে বাজারে গিয়েই সুবিমল টের পেলেন, জয় জরুরি সভাকে জমিয়ে তুলতে কী অক্লান্ত পরিশ্রম করছে। বাজারের সর্বত্র শুধু হ্যান্ডবিলগুলো বিলি করে নি, পথচলতি মানুষের অবগতির জন্য মাইকিং এরও ব্যবস্থা করেছে। সভায় যে মানুষের যথেষ্ট সমাগম ঘটবে, তা নিয়ে অনেকখানি নিশ্চিত হতে পারলেন। স্ট্রিট ক্যানভাসিংএ মূল বক্তা জয় নিজেই। সুবিমলের বক্তব্য রাখার ধরণ অনুসরণ করে বাজার গরম করে দিতে পেরেছে। তাৎক্ষনিক সমস্যার মধ্যে এই লাভটুকু জয় নিজের ঝুলিতে ভরে নিতে পারল।
বিকেল চারটে, সুবিমলের মধ্যে চমক বাড়ছে এই অর্থে যে তিনি ঠিক সময়ে ডেপুটেশনের ব্যবস্থা করতে পেরেছেন। নিজের ইমেজকে বাড়িয়ে তোলার মস্ত বড়ো সুযোগ এসেছে তাঁর সামনে। তা কাজে লাগানোর জন্যে বারান্দার উপর বুঁদ হয়ে বসে থাকলেন। আরেকটু পরে সভায় যেতে হবে তাঁকে। সাইকেলের বেল বাজিয়ে জয় ঢুকল সামনের চত্বরে।
খবর কী রে? সুবিমলের চকিত প্রশ্ন।
পরে বলব সুবিমলদা, এখনিই পিক আওয়ার্স শুরু হবে, দেরি করার সময় নেই।
সুবিমল না হেসে পারলেন না। পিক আওয়ার্স মানে তিনি ভালো করেই বোঝেন। জয়কে চারদিক থেকে আসা সব মিছিলের সামনে দাঁড়িয়ে দফায় দফায় নেতৃত্ব দিতে হবে, সেই সূত্রে বুঝিয়ে দিতে চাইবে, সুবিমলের পরে সেকেন্ড ইন কম্যান্ড বলতে তাকেই মান্যতা দেওয়া উচিত।
পাঁচটায় জনসভা শুরু। আর দেরি করতে পারলেন না সুবিমল, ইস্তিরি করা পাঞ্জাবি ধুতি পরে মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তব্যের উষ্ণতায় মানবিকতার ছায়া বিস্তার করে দিনটাকে স্মরণীয় করে রাখতে চাইছেন। জনা পনেরো সাকরেদ বাইরে অপেক্ষায় ছিল। গেট পার হয়ে সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তাহলে আজ আমরা একটা বিশেষ সভার মুখোমুখি হতে চলেছি। ভারিক্কির তকমা গায়ে মেখে হেলতে দুলতে এগিয়ে চললেন। সাধারণ দিনে প্যান্ট সার্ট পরেন, রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে নতুন রূপের সুবিমলকে সকলে নজরভরে দেখছে। তাদের মানসিক কৌতূহলে এতটুকু ভ্রূক্ষেপ নেই সুবিমলের। গম্ভীর মুখে হাঁটতে হাঁটতে প্রিয় সাকরেদদের নানা প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন।
গুরু, লোক কেমন হতে পারে?
প্রচার জমিয়ে দিয়েছি, একটু পরে তার প্রমাণ পাবি।
হাজার দশেক হবে কী?
এত অল্প করে ভাবছিস? জয় বলল, কুড়ির কমে নয়।
এত লোক?
দূর থেকে অনেকেই আসবে আমার বক্তব্য শুনতে।
কোন্ অঞ্চল থেকে বেশি লোক আসতে পারে?
নিশ্চয় শঙ্করপুর থেকে, ওখানে আমার বিশেষ প্রভাব প্রতিপত্তি রয়েছে, আজ সেই ফলশ্রুতি দেখতে পাবি।
যেতে যেতে কাটাকাটা উত্তর দিতে দিতে সুবিমল বুঝিয়ে দিলেন, তিনি শুধু মেঠো রাজনীতিক নন, জীবনের নানা পর্যায় পার হতে হতে জনচেতনা সমন্বিত এক ধুরন্দর নেতা হয়ে উঠেছেন। মঞ্চের উপরে উঠতেই চারদিকের হাততালিতে বুঝে গেলেন, হ্যান্ডবিলে প্রকাশিত তাঁর বার্তা আপামর মানুষকে ভীষণ আকর্ষণ করেছে। আশ্চর্য হলেন বাম দিকে চোখ রেখে, জয়ন্ত দেবনাথের বহু কাছের মানুষ সভায় এসেছেন তাঁর মূল্যায়ন শুনতে। বুকের ধুকপুকুনির মধ্যে সুবিমলের নতুন স্বস্তি, রঘুকে টার্গেট করার ফলে কেউ তাঁকে ষড়যন্ত্রী হিসাবে ভাবতে পারছেন না বরং সকলের ধারণা, মানসিক উদারতা ছিল বলেই প্রতিপক্ষ নেতৃত্বের প্রতি এভাবে শ্রদ্ধা জানিয়ে এত বড়ো ডেপুটেশনের ব্যবস্থা করতে পেরেছি। মনে মনে ঠিক করলেন, জীবনরসের এ সভায় জয় ছাড়া অন্য কাউকে বক্তব্য রাখতে দেবেন না, জয়কে কয়েক মিনিট বলার সুযোগ দিয়ে বাকি সময় নিজেই কভার করবেন এটাই প্রমাণ করতে যে রাজনীতি করলেও মানবিকতাকে কখনও কূটনীতির পর্যায়ে নামিয়ে আনেন নি বরং উদার আকাশে ডানা মেলা পাখির মতো সর্বক্ষণ জীবনের মানবিক দিককে বড়ো করে তুলতে চেয়েছেন। আগে কেউ দেখে নি বিরোধী কোনো নেতৃত্বের অকাল মৃত্যুতে এত বড়ো গণবিক্ষোভের আয়োজন করতে। সেই কারণে অনেকেই সুবিমলের প্রতি গদগদ না হয়ে পারল না।
রাত আটটা, প্রতিবাদ সভার ঝড় শেষ হল। জড়ো হওয়া মানুষজন এত মুগ্ধ হল যে সভার মধ্যে পিন পড়লে শোনা যেত। সুবিমল জয়ন্ত দেবনাথের লড়াকু জীবনের বিস্তৃত বিবরণ দিয়ে বোঝাতে চাইলেন, সংগঠন করতে গেলে যে মানসিক ও মানবিক মূল্যবোধ লাগে, তা শ্রী দেবনাথের মধ্যে পণূর্মাত্রায় ছিল। উদারতায় পাহাড়ের মতো উঁচু ছিলেন বলেই দেবনাথবাবু কখনো সার্বিক উন্নয়নমলূক কাজে এতটুকু বিরোধিতা করেন নি বরং সঙ্গে থেকে সহযোগিতা করে বুঝিয়ে দিতে পেরেছিলেন, মানুষের উন্নয়ন কর্মযজ্ঞে তিনি কখনো দ্বিচারিতার পথ গ্রহণ করেন নি। সভার সুরকে অন্যমাত্রা দিতে সুবিমল রাসভস্বরে দাবি করলেন, মূল অপরাধীকে এখনই এ্যারেস্ট করতে হবে। চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে তা সম্ভব না হলে মন্ত্রীমহল পর্যন্ত যেতে বাধ্য হবেন তিনি। সব মিলিয়ে সুবিমল ভালোমতোই বুঝিয়ে দিলেন,পরিস্থিতির সূক্ষ্ম মূল্যায়ন করে একমাত্র তিনিই পারেন নতুন সময়ে নিজেকে নতুন সূত্রে মিলিয়ে দিতে।
চলবে…