আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগে কেউ মুসলমান ছিল না। আজ থেকে সাড়ে তিন হাজার বছর আগে কেউ হিন্দু ছিল না। কিন্তু তার আগেও বহুকাল ধরে মানুষ ছিল। মানুষের সাথে মানুষের বিবাদ বা বিভেদ যেটুকু ছিল তা ছিল খাদ্য ও বাসস্থানের। এর পর এল কিছু সুবিধাবাদী চালাক মানুষ। তারাই ধর্ম সৃষ্টি করল। পুঁতে দিল বিভেদের বীজ। এরপর মানুষ মানুষের থেকে এভাবে আলাদা হয়ে গেল যে আজ এতযুগ পেরিয়ে এসেও, এই স্মার্ট ফোনের যুগেও মানুষ এক হতে পারেনি। বরং ধর্মের বিষগাছটি শাখা প্রশাখা বিস্তার করে মানুষের রক্ত মজ্জায় ঢুকে গেছে। মানুষ হয়ে পড়েছে ধর্মান্ধ।শিক্ষা মানুষের জ্ঞান চক্ষুর উন্মোচন ঘটায় কিন্তু ধর্মের অন্ধত্ব থেকে মুক্তি দিতে পারে না। মানুষের জীবন, রাজনীতি, চিন্তাভাবনা সব কিছুর মধ্যেই ঢুকে পড়ে মানুষকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে সেই অতীতকালে কিছু চালাক মানুষের তৈরি ধর্ম।
মাত্র ১০০০০ বছর আগে কোনো ধর্মই ছিল না। ছিলনা ধর্ম-ধর্ম করে মানুষের সাথে মানুষের বিভেদ। ধর্ম কোনো কাজেই আসে না, শুধু যুদ্ধ বাধায়, রক্ত ঝরায়,মানুষকে মানুষের থেকে আলাদা করে দেয়। প্রতিটি ধর্মই সমান খারাপ। মানুষের সর্বনাশ করেছে, করছে এবং করবে এই ধর্ম। আজ এই করোনা সঙ্কটে কোন ধর্ম কোন কাজে লাগছে? শুধুমাত্র সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে বিষয়টাকে আরও জটিল করে তুলছে। হ্যাঁ, পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষই ধার্মিক। বেশিরভাগ মানুষই বিশ্বাস করেন তাদের নিজের নিজের ধর্ম শ্রেষ্ঠ এবং অন্যান্য সব ধর্ম অতি নিকৃষ্ট। কিন্তু তাতেও কিছুই এসে যায় না। বিশিষ্ট আমেরিকান শিক্ষাবিদ Booker T. Washington এর কথায় “A lie doesn’t become truth, wrong doesn’t become right, and evil doesn’t become good, just because it’s accepted by a majority.” মেজরিটি সবসময় সঠিক কথা বলে না। বেশিরভাগ মানুষ অশিক্ষিত হলে তারা অশিক্ষিত মানুষকেই তাদের নেতা হিসাবে পছন্দ করবেন। যেটা আমরা ভারতীয় উপমহাদেশের সবকটি দেশেই রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দেখতে পাচ্ছি।
পদবি/জাত/ পৈতে থাকলে জাতের নামে বজ্জাতিও থাকবে। সংরক্ষণ উঠিয়ে দেব, আর আমি ব্রাহ্মণ, আমি শ্রেষ্ঠ, আমি উচ্চ, এইসব মিথ্যে ধারণা নিয়ে অন্যকে ছোট করব, তা হয় না। ঠিক এই কারণেই আজও সংরক্ষণ চলছে, চলবেও। পৈতে একগাছা সুতো মাত্র, ইচ্ছে হলে একজন অব্রাহ্মণও পৈতে পরবে, ইচ্ছে হলে একজন ব্রাহ্মণ সন্তান ফালতু সুতো মনে করে পৈতে পরবে না, এই ধারণাতে যতদিন সমস্ত ব্রাহ্মণ বিশ্বাস না করবে, ততদিন সংরক্ষণ তুলে দেবার কথা তাদের মুখে মানায় না। পদবি থাকলে ওই পদবি ধরেই আবার কাউকে উঁচু কাউকে নিচু ভাবা হবে। আপনি সাহা, আপনাকে ব্যানার্জি ভুরু কুঁচকাবে, আপনিও মীনা/ সরেন/ মুন্ডাকে নীচু ভাবার সুযোগ পাবেন। এই রিলিজিয়াস শোভিনিজম থেকে মুক্তি পেতে পদবি হতে হবে ব্যক্তির ইচ্ছেমতো। যার যা খুশি, সে তাই পদবি নিক। অন্ধ ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।ধরা যাক আপনার পদবি ‘সাহা’। এক্ষেত্রে আপনার নামটা ‘সাহা’ দিয়েই শেষ হবে, আপনার ছেলের নামের শেষে ওই সাহাই থাকবে, এই ধারণা থেকে বের হয়ে না আসতে পারলে সংরক্ষণ তুলে দেবার মত বড় কথা আপনার ভাবা মানায় কী? বরং পদবি থাকবে কিন্তু সংরক্ষণ থাকবে না, এটাই ১০০% আঁতেলের মত কথা।
পদবি রাখলেই তার হাত ধরে সংরক্ষণও থাকবে। পদবিটা বংশধারা অনুযায়ী হলেই সমস্যা। পদবি নামের পরে একটা শব্দ মাত্র। নাম হতেই পারে দুই বা তিন শব্দের বা সংখ্যারও। যেমন ”রাতুল রাহুল” নাম নিতে পারেন কেউ, যেখানে তার বাবার নাম হয়তো ছিল রাজীব মীনা। যাতে করে আর পদবি ধরে মানুষের জাত চেনা না যায়। এমনটা একটা দুটো প্রজন্ম করতে পারলেই কেল্লাফতে। কে উঁচু জাত ছিল, কে ছিল নীচু জাত, তা চেনাই যাবে না আর। পদবি ছাড়াই দু অক্ষরে খুব সুন্দর সুন্দর নাম দেওয়া যেতে পারে, আর সেখানে নামকরণের স্বাধীনতা অনেক বেড়ে যায়। যেমন, কারো নাম হতে পারে ‘সুদীপ্ত সুন্দর’ বা ‘সুদীপ্ত আলোকবর্ষ’ অথবা ‘নক্ষত্রজাতক সুদীপ্ত’। সুদীপ্ত বিশ্বাস/সুদীপ্ত দাস/সুদীপ্ত ব্যানার্জি /সুদীপ্ত ঘোষের চেয়ে এগুলো অনেক অর্থবহ এবং সুন্দরও। পদবি বিহীন, জাতপাত মুক্ত, ধর্ম মুক্ত পৃথিবী আমরা ইচ্ছে করলেই তৈরি করতে পারি। Frederick Douglass সঠিকভাবেই বলেছেন “If there is no struggle, there is no progress. “আমরা কেউ কি স্ট্রাগল করেছি? সবাই তো হাত পা গুটিয়ে থেকে শুধু পাকা ফলটি খাবার জন্য বসে আছি। ভুলে গেছি, ‘মা ফলেষু কদাচন’ প্রবাদটিকে।
মহাপুরুষ/ প্রফেট যাদের বলা হচ্ছে তারা কেউ-ই মহান নন। বেশিরভাগ অন্ধকার এরাই ছড়িয়েছেন। এদের মুখোশ খুলে দেওয়া দরকার। এরা আসলে ভণ্ড, অন্ধবিশ্বাসী। প্রফেটরা কুসংস্কারই ছড়িয়েছেন। বিভিন্নভাবে স্ববিরোধী বক্তৃতা করে মানুষকে বিভ্রান্ত করেছেন। তাদের আসল উদ্দেশ্য ধর্ম প্রচার, দলবাজি আর অন্ধ পুজো-আচ্চার প্রচার। ওদিকে মুখে আবার বড় বড় যুক্তিবাদী ডায়লগ। আসলে যুক্তির য-ও নেই তাদের জীবনে। এরা ভণ্ড। মহাপুরুষ কখনোই নন। বিজ্ঞানীরাই আসল মহাপুরুষ। বিজ্ঞানীদের জন্যই আমরা এত সুন্দর ভাবে বেঁচে আছি।
Voltaire বলেছেন,”Prejudice is an opinion without judgment. “কিন্তু মানুষ আসলে অন্ধকারের পূজারী। আলোর চেয়ে অন্ধকার তার চিরকালের প্রিয়। তাই চিরকাল বিজ্ঞানীর চেয়ে প্রফেট, পুরোহিত বা পাদ্রির মূল্য অনেক বেশি তার কাছে। মহাকাশ বিজ্ঞানের বইয়ের চেয়ে ধর্মগ্রন্থের মূল্য অনেক বেশি মানুষের কাছে। বিজ্ঞানের বই পায়ে ঠেলে ধর্মগ্রন্থ মাথায় করে রাখে সমস্ত মানবসমাজ। অনেকে আবার ধর্মগ্রন্থের মধ্যে বিজ্ঞান খুঁজে পান! বিজ্ঞানের কাজ হল আলো ছড়ানো আর ধর্মগ্রন্থের কাজ হল অন্ধ মানুষকে আরও অন্ধকারে নিমজ্জিত রাখা। তাই ধর্মগ্রন্থ ও বিজ্ঞান একে অন্যের পরিপূরক নয়। আলোর সাথে অন্ধকারের যা সম্পর্ক এদের সাথেও সেই একই সম্পর্ক। বিজ্ঞান নতুনের পূজারি। নতুন উন্নত চিন্তাভাবনা এলেই পুরানো ধারণাকে বাতিল করে দেয় সে।ওদিকে ধর্মগ্রন্থের ব্যাপারটা পুরো উল্টো। যত পুরানো হয়, ততই তার মান্যতা বাড়ে। পুরানো বস্তাপচা ধর্মগ্রন্থের সাথে যদি বিজ্ঞানের কোনো ধারণার খুব সামান্য মিল পাওয়া যায়, তাহলে আর কথাই নেই, সব মানুষ ধর্মগ্রন্থ মাথায় নিয়ে ধেই ধেই করে নাচতে শুরু করে দেয়। আলোর চেয়ে অন্ধকার মানুষের বড় প্রিয়। রবীন্দ্রনাথের ছিঁটেফোঁটা সম্মানও পাননা নোবেলজয়ী সি ভি রমন বা চন্দ্রশেখরেরা।অথচ তাদের আবিষ্কার অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, মেধার পরিচায়ক ও শ্রমসাধ্য।
আগুনে বিশ্বাস করে হাত দিলে হাত পোড়ে। আগুনকে অবিশ্বাস করে হাত দিলেও হাত পোড়ে। বিশ্বাস অবিশ্বাসের সাথে আগুনের চরিত্র বদলায় না। সাঁতার না জেনে জলকে বিশ্বাস করে অথৈজলে নামলে ডুবে মরতে হয়। জলকে অবিশ্বাস করে অথৈজলে নামলেও ডুবে মরতে হয়। বিশ্বাস অবিশ্বাসের সাথে জলের চরিত্র বদলায় না। ঈশ্বরকে বিশ্বাস করলে তিনি খুবই খুশি হন। ঈশ্বরকে অবিশ্বাস করলেই তিনি ক্ষেপে যান। বিশ্বাস অবিশ্বাসের সাথে ঈশ্বরের চরিত্র বদলায়। যার চরিত্র সামান্য বিশ্বাস অবিশ্বাসের সাথে বদলায়, তাকে কতটা বিশ্বাস করা যায়?
ঈশ্বর নামক জুজুর ভয় থেকে মুক্ত হয়ে বিপদের সময় আত্মবিশ্বাসী হতে শেখার নাম প্রকৃত শিক্ষা। ধর্মগ্রন্থের চেয়ে বিজ্ঞানের বইগুলো অনেক বেশি মূল্যবান, এটা বুঝতে পারার নাম প্রকৃত শিক্ষা। সাদাকে সাদা কালোকে কালো বলার সাহস অর্জন করার নাম প্রকৃত শিক্ষা। মিথ্যে বললে আখের গুছিয়ে নেওয়া যাবে জেনেও, সত্যকে আঁকড়ে থাকার নাম প্রকৃত শিক্ষা। প্রচলিত কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাসগুলোকে লাথি মেরে গুঁড়িয়ে ফেলে যুক্তিবাদী এবং আত্মবিশ্বাসী হতে শেখার নাম প্রকৃত শিক্ষা। অসময়ে কাজে আসেনি কোনও মন্দির-মসজিদ -গীর্জা। এগুলোকে ভেঙে হাসপাতাল করা যায় না?
শুধু ডেভলপমেন্ট নয়, সাসটেনেবল ডেভলপমেন্ট আমাদের দরকার। শুধু মানুষকে নয়, গাছপালা, পশুপাখি সবাইকে ভালোবেসে বাঁচো এবং বাঁচতে দাও…
বিশিষ্ট ভিক্টোরিয়ান কবি Matthew Arnold সঠিকভাবেই বলেছেন,”The free thinking of one age is the common sense of the next. “আমাদের আজকের এই মুক্ত চিন্তার কথাগুলো আগামী প্রজন্মের কাছে অতি সাধারণ বলেই একদিন মনে হবে। কুসংস্কার ও অন্ধকারের গভীর থেকে তারা একদিন ঠিক আলোর দিশা খুঁজে পাবে।