সন ১৯৪৭, বাংলা আর পাঞ্জাব প্রদেশ দ্বিখণ্ডিত হয়ে স্বাধীন হলো ভারত। পরাধীন আমল থেকেই বাংলা অনেক দুর্ভিক্ষের মধ্যে দিয়ে গেছে, দেখেছে মহামারি। যথেচ্ছ লুট চালিয়ে ইংরেজ বানিয়ারা নিঃস্ব করে দিয়েছিল এ রাজ্যের অর্থনীতি। গোদের ওপরে বিষফোঁড়ার মতো এলো এরপর দেশভাগ। রাতারাতি পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেলো, যার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা নয়া শাসক কুল। দেখা দেয় চরম খাদ্যাভাব। রাজনৈতিক ভাবে এর ফায়দা তুলতে মাঠে নামে বিরোধী দলগুলো।
৩১শে আগস্ট ১৯৫৯, খাদ্যের দাবিতে আজকের দিনে মনুমেন্টের নীচে জমায়েত আহ্বান করলো তারা। সভার পর ছিল আইন অমান্য কর্মসূচি। গ্রামগঞ্জ থেকে প্রায় তিরিশ হাজার নরনারী দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ কমিটির ব্যানারে জমায়েত হলো কলকাতায়। ধর্মতলায় পুলিশ মিছিল আটকালে মানুষ রাস্তায় বসে পড়লেন। নিরন্তর ক্ষুধার্ত কয়েক হাজার মানুষকে নিয়ে সেই সন্ধ্যায় রাইটার্সের কাছে গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের সামনে আইন অমান্য করতে গেলে যে সরু রাস্তায় ভিড়ের চাপে জমায়েতের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকবে না, নেতারা কেন আগে ভেবে দেখেননি তা আজ বলা মুশকিল। বলা আরো মুশকিল ওই সময় সেদিন কারা পাথর ছুঁড়েছিল, কারা সেদিন টিল মেরে রাস্তার আলো নিভিয়ে দিয়েছিলো? এসবের উত্তর কোনও দিনই আর পাওয়া যাবে না। অভুক্ত মানুষেরা কলকাতায় এসেছিলেন দাবি জানাতে, আত্মহত্যা করতে তো নয়!
স্বভাবতই ভিড়ের চাপে কর্ডন ভেঙে গেল। বিকেল শেষ হয়ে সবে সন্ধে নেমেছে তখনই শুরু হল বেপরোয়া লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাস আর গুলি। সন্ধে গড়িয়ে নেমে এলো রাত, মার থামলো না। ভারতের ইতিহাসে এমন নৃশংস পুলিশি হামলা খুব কমই ঘটেছে। সরকারি মতে মারা গেলেন আশি জন, বেসরকারি মতে সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি। এর পরের চার-পাঁচ দিন কলকাতার দখল নিলেন সাধারণ মানুষ। অসংখ্যবার গুলি চলল, লোক মরল, কিন্তু রাজপথ ছাড়ল না ক্ষিপ্ত জনতা৷ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইট মেরে পুলিশকে তাড়িয়ে দিল ছাত্রছাত্রীরা।
পরদিন তিরিশ জায়গায় গুলি চললো৷ পুলিশের বেপরোয়া গুলিতে ভাতের থালা সামনে নিয়ে মানুষ মারা গেলো। ৭৫ বছরের চুনীলাল দত্ত, ১৪ বছরের সরোজ দাঁ মরল গুলিতে। শিবপুরের ১৮ বছরের ছেলে হারাধন পাল তেল মেখে পুকুরে নামার সময় গুলি খেয়ে মরলো। তার মা ছুটে এসে জাপটে ধরলেন লাশ। পুলিশ লাশশুদ্ধু মাকে টেনে নিয়ে গেল থানায়। রাতে শ্মশানে একসঙ্গে পুড়ল আরও সতেরোটা লাশ। কংগ্রেস সরকার কেঁপে উঠল খাদ্য আন্দোলনের অভিঘাতে।
যে খাদ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেনের টেলিগ্রামের জবাব দেয়নি দিল্লি, সেই কেন্দ্রীয় সরকার নিজে থেকেই ঘোষণা করল, তারা ৫০ হাজার টন চাল, ৭০ হাজার টন গম পাঠাচ্ছে। রাজ্য নিজেও মধ্যপ্রদেশ থেকে ৩০ হাজার টন ধান আনার ব্যবস্থা করল। জোগান বেড়ে যাওয়ায় চালের দামও কমল। শান্ত হলো একসময় পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি। এখন অবশ্য ৫০ টাকা কিলো চালের দরেও আমরা বিন্দাস!
তবে সেদিন বিক্ষোভ কারীদের মৃত্যুর পর বিধান রায় বলেছিলেন ‘ওরা জোর করে রাইটার্স দখল করতে এসেছিল।’ ঠিক চৌত্রিশ বছর পরে ১৯৯৩ সালের ২১শে জুলাইয়ে সম্পূর্ণ আলাদা একটি ইস্যুতে মমতার জমায়েতে ১৩ জন যুবকের পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হলে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু সেই একই কথা বলেছিলেন। একেই কি বলে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি…? কে জানে!
তথ্যসূত্র: স্টেটসম্যান ও হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড
লেখক: স্বপন সেন