ব্যানারগুলোতে লেখা এই দুটো টেক্সট একটু খেয়াল করুন – (১) “ছোট পোশাক পরে বিপরীত লিঙ্গকে সিডিউস করা বন্ধ করুন”, (২) “ছোট পোশাক নারীকে বিজ্ঞানী বানায় না পণ্য বানায়”…
প্রথমটিতে ধরে নেয়া হচ্ছে ছোট পোশাক পরার অর্থ হচ্ছে বিপরীত লিঙ্গকে সিডিউস করা বা যৌনাকৃষ্ট করা, আর দ্বিতীয়টিতে ধরে নেয়া হচ্ছে যে, ছোট পোশাক পরা মানে নিজেকে পণ্য বানানো। পণ্য বলতে এমন কিছু বোঝানো হয় যাকে ভোগ বা কনজিউম করা যায়। তার মানে মূল কথা হচ্ছে কোন নারীর ছোট পোশাক পরা মানে হলো সে বিপরীত লিঙ্গকে যৌনাকৃষ্ট করছে ও নিজেকে অন্যের ভোগ্যবস্তুতে পরিণত করছে। এখানে দেখার মত দুটো ইন্টারেস্টিং ইমপ্লিকেশন আছে –
(১) নারীর নিজের ইচ্ছা, সত্তা বা এজেন্সি, সাবজেক্টিভিটি বা ব্যক্তিবাচকতা বলতে কিছু নেই। তারা যাই করে তাই অন্যের জন্য। তারা ছোট পোশাক পরে অন্যকে যৌনাকৃষ্ট করতে ও নিজেকে ভোগ্যবস্তুতে পরিণত করতে। মানে একজন নারী যে ছোট পোশাক পরে তা কখনই নিজের জন্য না, বরং সবই ঘুরেফিরে অপরের জন্য। যেহেতু পুরুষ যৌনাকৃষ্ট হয় ও পুরুষের ভোগ্য বলেই মিন করা হচ্ছে, তাই এখানে প্রথম থেকেই ধরে নেয়া হচ্ছে যে নারী যা করছে তা পুরুষের জন্যই, এখানে আকৃষ্ট পুরুষ, ভোক্তাও পুরুষ (এটা সত্য হোক, মিথ্যা হোক, ভাবা হচ্ছে)। যদি এদেরকে ছোট পোশাকের বদলে বড় পোশাকের কার্যকারিতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হতো, তাহলে বলত বড় পোশাক পরে তারা পুরুষকে বিপথগামী হবার পথ থেকে বিরত রাখে, নিজেকে পণ্যায়িত না করে নারীর প্রকৃত মূল্য সম্পর্কে অনুধাবন করায় (তবুও ভোগ্যপণ্যে হবার ব্যাপারটা থেকে যাচ্ছে কিনা ভেবে দেখুন) ইত্যাদি। মানে এক্ষেত্রেও নারীর পোশাকের কার্যকারিতা সবই পুরুষ-কেন্দ্রিকই থাকত। নারীর বড় পোশাকের উদ্দেশ্যও তখন পুরুষই। দুটো ব্যাপারের সাদৃশ্যের দিকটা বিবেচনা করুন। এখানে প্রথম থেকেই ধরে নেয়া হচ্ছে যে, নারী যদি কোন পোশাক পরে, তা ছোট হোক বা বড় হোক, তা পুরুষের জন্য, তাতে নারীর নিজস্ব কোন সত্তা বা এজেন্সি, সাবজেক্টিভিটি বা ব্যক্তিবাচকতা থাকতে পারেনা, অর্থাৎ নারী নিজের জন্য পোশাক পরতে পারেনা, তার পোশাকের উদ্দেশ্য হলো পুরুষ, সে যা করে তা পুরুষের জন্য। যদি কোন সমাজে নারী ও পুরুষ নির্বিশেষে এরকম চিন্তা প্রতিষ্ঠিত থাকে তাহলে বুঝতে হবে সেই সমাজটির দৃষ্টিভঙ্গি পুরুষকেন্দ্রিক। সেখানে নারীর এজেন্সি বা সাবজেক্টিভিটির জায়গা নেই।
(২) নারীর ছোট পোশাক পরা মানে তার প্রভাবে পুরুষের যৌনাকৃষ্ট হওয়া আর নারীর পণ্যে পরিণত হওয়া – এই দুটো বিষয়ের আরেকটা ইন্টারেস্টিং দিক হচ্ছে – এই দুটোতেই ধরে নেয়া হচ্ছে যে, “নারীর ছোট পোশাক পরিধান” কাজটির প্রতিক্রিয়া ঘটছে পুরুষের সাথেই, আর প্রতিক্রিয়াটি স্বয়ংক্রীয়। মানে নারীর ছোট পোশাক মানেই পুরুষ যৌনাকৃষ্ট হওয়া, এর মানেই পুরুষের দ্বারা তার “ভুক্ত” হতে শুরু করা (যেহেতু নারী নিজেকে “পণ্য” বানাচ্ছে)। নারীর ছোট পোশাক হচ্ছে এখানে সংবেদ বা পারসেপশন, আর পুরুষের তার প্রতি যৌনাকৃষ্ট হওয়া আর ভোগ করতে শুরু করা হলো প্রতিক্রিয়া বা রেসপন্স। মানে নারীর ছোট পোশাক পরার সাথে সাথে পুরুষের মধ্যে রিয়েকশন হয়ে যাচ্ছে, এর মাঝামাঝি কোন প্রক্রিয়া নেই, সোজা কথায় এর দ্বারা বোঝানো হচ্ছে এই সংবেদের প্রতি পুরুষের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই, তারা স্বয়ংক্রীয়ভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়। একদিক দিয়ে দেখলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাও এজেন্সি বা সাবজেক্টিভিটিই, তাই সেক্ষেত্রে পুরুষের এই দুটিরও অভাব আছে বোঝানো হচ্ছে। এখানে বোঝানো হচ্ছে যে পুরুষেরা কেবলই ইন্দ্রীয়স্বর্বস্ব বুদ্ধিহীন প্রাণীর মত আচরণ করে, যেমনটা পশুর ক্ষেত্রে দেখা যায় বলে সাধারণভাবে মনে করা হয়। এখানে ধরে নেয়া হয় যে পুরুষ (আরও বৃহত্তর পরিসরে মানুষ মাত্রই) বৌদ্ধিক-নৈতিক বিকাশহীন একটি ইন্দ্রীয়সর্বস্ব জীব, যার কাজ সংবেদ গ্রহণ ও সে অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া প্রদান। এর বেশি কিছু মানুষ করেনা, আশা করাও উচিৎ না।
এই আলোচনায় পণ্যায়ন সম্পর্কে কিছু কথা না বললেই নয়। যদি ব্যক্তিকে পণ্য হিসেবে দেখি তবে আমরা সবাই পণ্য, টম যখন হ্যারির গান শুনে আনন্দিত হয় তখন হ্যারি পণ্য হচ্ছে। কিন্তু যেটা এড়িয়ে যাওয়া হয় তা হচ্ছে একই সাথে হ্যারি একজন উৎপাদকও হচ্ছেন। নারীর ক্ষেত্রে সেই উৎপাদকের ব্যাপারটা এড়িয়ে যাওয়া হয় কারণ সমাজে নারীকে এজেন্সি বা সত্তা হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি একটু কম, উৎপাদক হতে হলে সত্তা বা ব্যক্তিবাচকতার উপস্থিতি সম্পর্কিত কিছু ভাবনার দরকার হয়। আর কোন ব্যক্তির পণ্য বা উৎপাদক হওয়া মানেই খারাপ হয়না যদি সে নিজেও একজন ভোক্তা হন। মানুষ কেবল পণ্য বা উৎপাদক নন, মানুষ ভোক্তাও, কিন্তু এটাও এড়িয়ে যাওয়া হয়, কারণ ভোগ করতে হলেও সাবজেক্টিভিটি ও এজেন্সির উপস্থিতি সম্পর্কিত চিন্তার দরকার। একজন নারী ছোট পোশাক তার নিজের ভালো লাগার জন্য পরতে পারে, নিজের স্বকীয়তা সৃষ্টি, সৃজনশীলতা, স্ট্যাটাস বা মর্যাদা দেখানো, ফ্যাশনের সাথে আপডেট থাকা, এবং নির্দিষ্ট বা সাধারণ কাউকে আকৃষ্ট করার জন্য ছোট বড় যেকোন রকম পোশাক পরতে পারে। এখানে সেই নারী নিজেও ভোক্তা, পোশাক হলো তার ভোগ্যবস্তু বা পণ্য, সে ভোগ করছে কারণ তার এজেন্সি আছে, সাবজেক্টিভিটি আছে। শেষ হয়নি, কোন পণ্যের উপস্থিতি মানেই তা ভুক্ত হতে শুরু হয়ে যাওয়া নয়। বাজারে যখন আমরা কোন পণ্য পছন্দ করি তখন তা ভোগ করব কি করব না তা আমরা সিদ্ধান্ত নেই, এরপর ভোগ করতে শুরু করি। আমরা তা করি কারণ আমাদের কাছে চয়েস আছে, আরও সাধারণভাবে বললে সত্তা বা এজেন্সি আছে, ব্যক্তিবাচকতা বা সাবজেক্টিভিটি আছে। যদি এটা বোঝানো হয় যে, একটি পণ্যের উপস্থিতি আছে মানেই পুরুষ তা ভোগ করতে শুরু করে দেবে, এর মানেই এটাই যে পুরুষের মধ্যে তার ভেতরে আসা সংবেদ নিয়ে কোন নিয়ন্ত্রণ নেই, তারা ইন্দ্রীয়সর্বস্ব প্রাণী মাত্র। এক শ্রেণীর মানুষ এটাই চায়, তারা চায় নারী ও পুরুষ সবাই, অর্থাৎ মানুষ মাত্রই সংবেদী ও ইন্দ্রীয়সর্বস্ব হোক, তাদের বৌদ্ধিক-নৈতিক বিকাশের প্রয়োজন নেই। জীবনধারণের জন্য কেবলই তাদের এই নিজেদের ইন্দ্রীয়সর্বস্বতাকে নিয়ন্ত্রণ করলেই যথেষ্ট, আর সেটার জন্য তাদেরকে সেই সব সংবেদের থেকে বিরত থাকতে হবে। আর সেই সব সংবেদের মধ্যে একটি হলো নারী দেহ। এদিকে নারীর ক্ষেত্রে তারা চায় যে তারা সত্তা ও ব্যক্তিবাচকতাবিহীন হোক, তাদের এজেন্সি ও সাবজেক্টিভিটির জায়গাগুলো লোপ পায়। “ছোট পোশাক”-এর বিরুদ্ধে এইসব টেক্সগুলো এই ইচ্ছাগুলোরই বহিঃপ্রকাশ। চাইলে এই বিষয়ে অনেক কিছু বলা যেত, আমি কেবলই এই দুটো গুরুত্বপূর্ণ দিক দেখাতে চেয়েছিলাম। ব্যানারগুলোর অন্যান্য টেক্সটগুলো নিয়ে পরে লিখতে পারি…
লেখক: সুমিত রায়