‘অতিথি হিসেবে কোনো বাড়িতে দীর্ঘদিন থাকা যায় না। নিজ দেশে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়ে ক্ষতবিক্ষত শরীরে আমরা বাংলাদেশে আশ্রয় পেয়েছি। জাতিসংঘের সহযোগিতা ও বাংলাদেশের আন্তরিকতায় শরীরের ক্ষত শুকিয়েছে, কিন্তু পূর্ণ নাগরিকত্ব দিয়ে মিয়ানমার আমাদের ফিরিয়ে না নেওয়া পর্যন্ত মনের ক্ষত শুকাবে না। রোহিঙ্গা হিসেবে নাগরিকত্ব ও ভিটেবাড়ির নিশ্চয়তা পেলে আমরা যে কোনো সময় মিয়ানমার ফিরে যাবো। বাংলাদেশে আমরা ভালো আছি, তাই বলে এখানে থেকে যেতে চাই না।’
বৃহস্পতিবার (২৫ আগস্ট) সকালে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শান্তিপূর্ণ মানববন্ধন ও সমাবেশে একথা বলেন রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতারা।
২০১৭ সালের এই দিনে নির্মম নির্যাতনের স্বীকার হয়ে নিজ দেশ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন রোহিঙ্গারা। গণহত্যার বিচার ও সম্মানজনকভাবে দেশে ফেরার দাবিতে এ মানববন্ধন ও সমাবেশ করেন তারা। পরে তারা মিছিল করেন।
১৩ নম্বর ক্যাম্পের তাজনিমার খেলার মাঠে মানববন্ধন ও সমাবেশের আয়োজন করা হয়। সেখানে বি ব্লকের হেড মাঝি (নেতা) মো. ইব্রাহিম, হেড মাঝি মুহাম্মদ আলী ও রোহিঙ্গা নেতা মোজাম্মেল হকসহ অন্যরা বক্তব্য রাখেন।
সুলিমুল্লাহ কাটা এলাকায় ১৬ নম্বর ক্যাম্প, কুতুপালং লম্বাশিয়া, বালুখালী পানবাজার ক্যাম্পসহ ২০টি ক্যাম্পে শান্তিপূর্ণ মানববন্ধন ও সমাবেশ করেন রোহিঙ্গারা।
সকাল ১০টা থেকে পৃথকভাবে শুরু হওয়া মানববন্ধন ও সমাবেশ চলে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত। তীব্র গরম উপেক্ষা করে নানা দাবি নিয়ে বক্তব্য রাখেন ক্যাম্প ও ব্লকভিত্তিক কমিউনিটি রোহিঙ্গা নেতারা। এ সময় উপস্থিত রোহিঙ্গারা এক বাক্যে দাবি করেন ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’।
কথা ছিল সমাবেশ নয়, শ খানেক রোহিঙ্গারা মানববন্ধন করতে পারবেন। কিন্তু নিপীড়নের বিচার দাবিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানববন্ধনে জড়ো হয়ে যান হাজারও রোহিঙ্গা। এতে মানববন্ধনগুলো সমাবেশে রূপ নেয়। এখানে তারা ২০১৭ সালে তাদের ওপর ঘটে যাওয়া হত্যা, ধর্ষণসহ নিপীড়নের সুষ্ঠু বিচার দাবি করেন। পূর্ণ মর্যাদা নিয়ে প্রত্যাবাসন কামনা করেন তারা।
এ সময় তাদের নিরাপদ আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশ সরকার ও প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতারা নিজ গোত্রীয়দের উদ্দেশে বলেন, ‘আমাদের আশ্রয় দিয়েছে বলে এদেশের সরকার ও জনগণের মন খারাপ হয় এমন কোনো কাজ করা থেকে বিরত থাকুন। আমাদের অনেকে মাদকসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে পুরো আশ্রিত রোহিঙ্গা কওমকে লজ্জায় ফেলেছেন। প্রত্যাবাসন হতে কত দিন, কত বছর লাগে তার সঠিক হিসাব নেই। ততদিন যেন বাংলাদেশ সরকার ও স্থানীয় জনগণ আমাদের সুন্দর মনে আশ্রয় দেন, সেই পরিস্থিতি বজায় রাখুন।’
একজন বয়স্ক রোহিঙ্গা আমেনা খাতুন। তিনি বলেন, ‘আমরা মিয়ানমারের অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছি। তারা নারীদের ধর্ষণ ও শিশুদের হত্যা করে আগুনে নিক্ষেপ করেছে। গর্ভবতীর পেট কেটে মা-বাচ্চা দুজনকেই হত্যা করেছে। এত বর্বরতার শিকার যেন পৃথিবীর আর কেউ না হয়।’
তিনি বলেন, ‘এদেশে থাকতে পারবো না জানি। এরপরও মর্যাদা না পেলে বার্মায় (মিয়ানমার) ফিরতে মন চাই না। বিশ্বনেতাদের প্রতি অনুরোধ, আমাদের নাগরিকত্বসহ সম্মানজনক প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করুন।’
রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তায় দায়িত্বরত ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. কামরান হোসেন বলেন, রোহিঙ্গারা শান্তিপূর্ণভাবে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছেন। রোহিঙ্গা সংকটের পাঁচ বছর উপলক্ষে সব ক্যাম্পে প্রতিদিনের তুলনায় নিরাপত্তা জোরদার ছিল। এপিবিএনের পাশাপাশি শৃঙ্খলা বাহিনীর অন্য বিভাগও সতর্ক অবস্থায় দায়িত্ব পালন করেছেন।
এদিকে, রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসন দাবিতে মানববন্ধন করেছে রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি কক্সবাজার। বৃহস্পতিবার সকালে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি মাহবুবুর রহমানের সভাপতিত্বে ও প্রচার সম্পাদক নেজাম উদ্দিনের সঞ্চালনায় মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক বিষযক সম্পাদক অ্যাডভোকেট তাপস রক্ষিত, কক্সবাজার খেলাঘর আসরের সভাপতি আবুল কাসেম বাবু, কক্সবাজার সোসাইটি সভাপতি গিয়াস উদ্দিন প্রমুখ।
মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে। অথচ এখনো তাদের প্রত্যাবাসনের কোনো প্রক্রিয়া দৃশ্যমান নয়। কয়েকবার তাদের প্রত্যাবাসনের কথা এলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। রোহিঙ্গাদের কারণে মাদকের আগ্রাসন, চুরি-ডাকাতিসহ সমাজে অপরাধ বেড়েছে। তাদের কারণে স্থানীয় নাগরিকদের রোহিঙ্গা নয় মর্মে প্রত্যয়ন নিতে হয়। এটা আমাদের জন্য লজ্জাজনক। কক্সবাজারবাসী আজ অতিষ্ঠ। এ থেকে মুক্তির একমাত্র পথ প্রত্যাবাসনের মাধ্যমে কক্সবাজারকে রোহিঙ্গামুক্ত করা।