প্রখ্যাত সাহিত্যিক, কবি, সমালোচক সজনীকান্ত দাসের জন্মদিন আজ (২৫শে আগস্ট)। গত শতাব্দীর প্রথম ভাগের বাংলা সাহিত্য আন্দোলনের প্রধান ব্যক্তিত্বই ছিলেন তিনি। সাহিত্যের সমস্ত শাখাতেই অবাধে বিচরণ করেছেন। ‘শনিবারের চিঠি’ নামের সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন তিনি।
জন্মস্থান মাতুলালয়ে। আর জন্ম তারিখ, ১৯০০ সালের ২৫শে অগাস্ট। বর্ধমান জেলার গলসী ব্লক থেকে ১৭ কিমি দূরে; গাঁয়ের নাম বেতালবন। পৈতৃক বাড়ির অবস্থান বীরভূম জেলায়। জন্ম সন ১৯০০, সালটির সঙ্গে অদ্ভুত সমাপতন আরেকটি বিষয়ের। শৈশবে যে প্রথমিক বিদ্যালয়ে ইংরাজি, অঙ্ক শিখেছেন কবি, তারও জন্ম ১৯০০ সালে। আত্মজীবনীতে পরে লিখেছেন সজনীকান্ত। বাবার বদলীর চাকরি, কাজেই বহু স্থানে কেটেছে তাঁর শৈশব, বাল্য, কৈশোর। দিনাজপুর জেলা স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ (১৯১৮)। বাঁকুড়া মিশনারি কলেজ থেকে আইএসসি (১৯২০)। স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বিএসসি (১৯২২)। ইলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যান বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে। পাঠ সমাপ্ত হয়নি। নিয়োজিত হন সাহিত্য কর্মে। ‘শনিবারের চিঠি’ ও অন্য বিবিধ পত্রিকা এবং প্রকাশনা সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। কবিতা, গল্প, সমালোচনা মিলিয়ে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ বহু, ষাটের অধিক। তাঁর রচিত ‘বাঙ্গালা গদ্যের প্রথম যুগ’ (সাল ১৯৪৬) বাংলা সাহিত্য ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি। সজনীকান্তের মৃত্যু ১৯৬২ সালে।
সমাপতনের কথা বলা হচ্ছিল। যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়েছেন তিনি, তারও প্রতিষ্ঠা সেই ১৯০০ সালে; বিদ্যালয়ের নাম, ‘দুর্গাদেবী দীনবন্ধু প্রথিমক বিদ্যালয়’, অবস্থান মহানন্দা নদী তীরের ছোট্ট শহর মালদা বা মালদহ, গোলাপট্টি পাড়া। বিদ্যালয়টির আরেকটি পরিচিতি ‘গোলাপট্টি পাঠশালা’ হিসাবে।
কেন এমন নাম, ‘গোলাপট্টি পাঠশালা?’ কবিতার মধ্য দিয়ে উত্তর লিখেছেন শিশু সজনীকান্ত। তাঁর বহু সৃজনের মধ্যে শৈশবে রচিত এটির কথা অনেকের নজরে আসেনি (আত্মস্মৃতিতে’ আছে পুরো কবিতা)।
“কুলুকুলু মহানন্দা, দুই তীরে শান্ত জনপদ;
এপারে দাঁড়ায়ে এক খুদ্র শিশু গণে জল-ঢেউ–
এক, দুই, তিন, চারি। কাঠের গোলার আশেপাশে …
আবার বলি, লিখেছেন কবি সজনীকান্ত দাস। পড়তেন গোলাপট্টি পাঠশালায়, থাকতেন বিদ্যালয় সংলগ্ন কালীতলা পাড়ায়। পাঠশালার আশেপাশে কাঠের গোলা ছিল সে সময়। ‘কাঠের গোলা’ থেকেই পাড়াটার নাম গোলাপট্টি। তর্কের অবকাশ নেই। প্রমাণ লিখে গেছেন স্বয়ং কবি সজনীকান্ত। যখন তাঁর খুব নামডাক, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বহু কর্মে লিপ্ত, তখনও এসেছেন এই স্কুলের বিশেষ অনুষ্ঠানে। বলছি সেকথা পরে। অন্য কথা সেরে নিই।
বাংলার যশস্বী সাহিত্যিক সজনীকান্ত দাস শৈশবে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেছেন ‘দুর্গাদেবী দীনবন্ধু প্রথিমক বিদ্যালয়’ এ- আর থাকতেন কালীতলা পাড়ায়। কোন বাড়ি? স্বর্গীয় কমলাপতি অধিকারী যে বাড়িতে থাকতেন (প্রতিবেদক ডাকতেন ‘কমলাকাকা’ সম্বোধনে)। কমলাকাকা গোলাপট্টি স্কুলের ছাত্র, দুর্দান্ত ফুটবলার ছিলেন। পুর্নিয়া থেকে P.C. Lal শিল্ড জিতে মালদা ফিরেছিলেন। গোলাপট্টি পাঠশালা আর মালদার ফুটবল টিম নিয়ে বড় একটা প্রবন্ধ হয়ে যায়। স্বর্গীয় কমলা কাকা, প্রাণ গোপাল চৌধুরী, অমিয় গোপাল চৌধুরী, আকবর, গোবর্ধন বিহানি, সিরাজ মিয়া…’ কত সব খেলোয়াড়। কলকাতার মাঠেও খেলেছেন অনেকে। সেই ইতিহাস অন্য কেউ দায়িত্ব নিয়ে লিখুন।
সাহিত্যিক সজনীকান্ত দাস সম্পর্কে স্বর্গীয় কমলাপতি অধিকারী লিখেছেন, “আমরা ওনাকে (সজনীকান্ত দাস) সজুদা বলেই ডাকতাম। সজুদারা ছিলেন চার ভাই। …একজনের নাম ছিল অজু, আর একজনের নাম গজু। সজুদাকে একবার মালদায় নিয়ে আসা হয়েছিল। মতিই এনেছিল. আমরা সেই সময় ‘শনিবারের চিঠি’ (সজনী কান্ত দাসের পত্রিকা) খুব পড়তাম। …আমি যে বাড়িতে আছি, সজুদারা এই বাড়িতেই থাকতেন।”
আর আত্মজীবনীতে সজনীকান্ত যে বাড়ির বিবরণ লিখেছেন, তাতেও বর্ণনা রয়েছে কমলা কাকার বাড়ির। ‘মতি’ অর্থাৎ মতি বিহানি। কৃতি ইঞ্জিনিয়ার, কবিতাও লিখতেন। আমার বন্ধু কমলেশ বিহানির দাদু।
লিখলাম কেন এত! মালদার ইতিহাস চর্চা করছেন অনেকে। এই ব্যাপার গুলো অনালোচিত থেকে যাচ্ছে।
এবার সজনীকান্তের প্রথমিক বিদ্যালয় প্রসঙ্গে। ‘দুর্গাদেবী প্রথিমক বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করলেন কে? প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান শিক্ষক, স্বর্গীয় দীনবন্ধু চৌধুরী (১৮৭১-১৯৪৮)। তাঁরও জন্মস্থান বর্ধমান, কাটোয়া। গ্রাম সুড্ডা। মালদা শহরের আদি শিক্ষাগুরু দীনবন্ধু চৌধুরী। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। বহু গুনের অধিকারী ছিলেন মানুষটি। রাগ সঙ্গীতে পারদর্শী, এস্রাজ বাজাতেন। অসংখ্য ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, বিজ্ঞানী, অধ্যাপক, সাহিত্যিক তৈরি হয়েছিল তাঁর শিক্ষায়। ‘দীনবন্ধু বাবুর পরনে থাকত ধুতি গায়ে পাঞ্জাবি, পায়ে চটি। শীতকালে বালাপোষ গায়ে দিতেন। মাঝে মাঝে লং কোট পড়তেন। সুড্ডা গ্রামে একটি কালী বিগ্রহের পূজা প্রবর্তন করে পূজার জন্য তাঁর সম্পত্তি দান করে যান। খুব রাশভারী আর ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন শিক্ষক ছিলেন। ছাত্ররা তাঁকে ‘বড় মাষ্টার’ বলে ডাকত (ডক্টর রাধাগোবিন্দ ঘোষ, ইতিহাসকার)।’
প্রখ্যাত গম্ভীরা রচয়িতা মরহুম সূফী মাষ্টার একটা গানে তাঁর শিক্ষক দীনবন্ধু চৌধুরী সম্পর্কে বলছেন, “মালদহে জন্মিয়াছেন এক সুবৃক্ষ চন্দন/পরিচয় করি তার নাম যদুনন্দন।/তার গন্ধে মাতিয়াছে যত ডাক্তার কবিরাজ,/দীনু মাষ্টার যোগ দেন হয়ে গন্ধরাজ।”
দীনবন্ধু চৌধুরী সম্পর্কে অনেক কথা লিখেছেন সজনীকান্ত। দীনবন্ধুর জন্ম ১৮৮৭ সালে, তাঁর সত্তর বর্ষ পূর্তিতে (১৯৪২) গোলাপট্টি পাঠশালায় হয়েছিল মহতী উৎসব। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন বহু ছাত্র। উল্লেখযোগ্য ছাত্রদের মধ্যে সজনীকান্ত দাস। তিনিই ছিলেন অনুষ্ঠানের সভাপতি। (উদ্যোক্তারা লিখছেন, ‘ডায়াবেটিসের জন্য সজনীকান্ত নিজে মিষ্টি খান না, আম নিশ্চয় খাবেন)।
আর সজনীকান্ত তাঁর শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে রচনা করেছেন কবিতা, ‘তবু ভালবাসি।’ লিখেছেন বহু প্রসঙ্গ। “প্রসিদ্ধ দীনু পণ্ডিতের পাঠশালার শিক্ষা আমার জীবনে অক্ষয় হইয়া আছে। সার্থক গুরু মহাশয় হিসাবে তাহাঁর তুলনা এ যুগে তো মিলেই না, সে যুগেও মিলিত না। মালদহের বর্তমান প্রবীণ উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিদের অধিকাংশের শিক্ষার পত্তন এই দীনু পণ্ডিতের পাঠশালায়। দীনু পণ্ডিতের কাছে কী শিখিয়াছিলাম— সরাসরি এই প্রশ্নের জবাব দেওয়া কঠিন। আজ আমার সমগ্র জীবনের আলোকে হিসাব খতাইয়া এটুকু মাত্র বলিতে পারি, তিনি আমাকে বিশেষ যত্নের সহিত অঙ্ক বা গণিত শাস্ত্র শিখাইয়াছিলেন – পরবর্তী জীবনে যাহা নিয়মানুবর্তিতা ও বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদে রূপান্তরিত হইয়াছে। পাঠশালা এবং স্কুল জীবনে লেখাপড়ায় আমার কৃতিত্ব ছিল অসাধারণ। এই পাঠশালা হইতে সমগ্র জেলায় প্রথম স্থান অধিকার করিয়াছিলাম। অতঃপর স্থানীয় জিলা স্কুলে ক্লাশ ফোর ও ফাইভের হাফ-ইয়ার্লি পরীক্ষা পর্যন্ত পড়িয়া, পিতা পাবনায় ১৯১২ সনে বদলি হওয়ায়, ন’মামার কর্মস্থল বাঁকুড়ায় নিত হই (আত্মস্মৃতি, সজনীকান্ত দাস)।”
একই সঙ্গে শ্রদ্ধা জানালাম বিখ্যাত সাহিত্যিক ও তাঁর শিক্ষা গুরুর প্রতি।