সময়টা ছিল চৈত্র মাসের মাঝামাঝি। সূর্যের প্রখর তাপদাহে যেন ওষ্ঠাগত জনজীবন। বিগত ফাল্গুন মাস থেকেই চলছে এই তাপপ্রবাহ। বাড়ির বাইরে বেরোনো মাত্র যেন আগুনের লেলিহান শিখা দাউদাউ করে জ্বলে পুড়ে ছারখার করে দিচ্ছে মানব শরীর। ভয়ে কেউ সকালের পর বাড়ির বাইরে বেরোচ্ছে না। গাছের পাতা অবধি প্রশ্বাস ছাড়ছে না। মাঝে মাঝে দুপুরের দিকে লু বইছে ভয়ানক ভাবে। দূর থেকে কোন এক পাখির একফোঁটা জলের জন্য করুন আর্তনাদ ভেসে আসছে,ফটিক জল – ফটিক জল – ফটিক জল
একসময় ক্লান্ত পাখি নিঃশ্চুপ হয়ে যায়। বৃষ্টি দূরের কথা আকাশে কোথাও মেঘের চিন্হ মাত্র দেখা নেই। বিগত দুমাস ধরে চলছে এই ভয়াবহ অবস্থা। ঘরে ঘরে কৃষকদের মাথায় হাত। জলের অভাবে ক্ষেতের জমি শুকিয়ে মাটি ফেঁটে চৌচির হয়ে গেছে। বিঘের পর বিঘে জমির তরমুজ, করলা, লঙ্কার ক্ষেত সহ আরো বিভিন্ন প্রকারের ক্ষেত শুকিয়ে জমিতেই মরে যাচ্ছে। চতুর্দিকে হাহাকার আর্তনাদ লোকের বৃষ্টির জন্য। বৃষ্টির দেখা নেই। এই অসহ্য গরম ও তাপপ্রবাহে একের পর এক লোক অসুস্থ হয়ে পড়ছে ঘরে ঘরে। বিশেষ করে বয়স্ক ও বাচ্চারা।
আজ এই গ্রামে তো কাল ওই গ্রামে ব্যাঙের বিয়ে দিয়েও বৃষ্টির দেখা নেই। মনে কারো শান্তি নেই। সকলেই বৃষ্টির জন্য ত্রাহি ত্রাহি করছে।
এরকমই এক দুপুরে আমি খেয়েদেয়ে আমাদের বাড়ির বাইরে আম গাছের তলায় একা একা চুপচাপ বসে ছিলাম একটি চেয়ারে আরাম মত হেলান দিয়ে। যদিও হওয়া বইছেনা, কিন্তু ঘন আমগাছের পাতার দরুন জায়গাটা একটু হলেও আরামদায়ক ছিল অন্তত এই দুপুরে ঘরের ভেতর থেকে।
আমি বসে আছি নিঃশ্চুপ। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম আমার পরিচিত বয়স ত্রিশের নিতাই দাদা লুঙ্গি পরিহিত অবস্থায় গলায় গামছা ঝুলিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছে আমার দিকেই!
আমি নিতাই দাদাকে দেখা মাত্রই ঠিকঠাক হয়ে বসলাম চেয়ারে। আমার ধারণাই ঠিক হলো। নিতাই দাদা আমার কাছে এসেই বলে উঠলো” দীপক চল তাড়াতাড়ি, শ্মশানে যেতে হবে।”
শ্মশান কথাটি শুনতেই আমি লাফিয়ে উঠলাম একপ্রকার চেয়ার ছেড়ে!
“শ্মশানে? কেন? কার কি হলো?”
“বিনয় দাদার ছোট মেয়েটি মারা গেছে রে। গত দু সপ্তাহ ধরে জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে পড়ে ছিল বিছানায়। আজ দুপুরের আগেই মারা গিয়েছে।”
“কি বলছো তুমি? বিনয় দাদার ছোট মেয়ে মানে,মাধবী মারা গিয়েছে?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি।
“হ্যা, তাড়াতাড়ি চল। তুই তো জানিস বিনয় দাদার আর্থিক পরিস্থিতি। গরীব বলে এখনও অবধি গ্রামের লোক কেউ আসেনি দেখতে। শ্মশানে নিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা।”
মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেল মুহূর্তে আমার। এইতো দিন বিশেক আগে আমি গিয়েছিলাম বিনয় দাদার বাড়িতে। মুহূর্তে সেই দিনের স্মৃতি জ্বলজ্বল করে উঠলো আমার দুচোখে।
বিনয় দাদা ছিল আমাদের যাত্রা দলের সহ ম্যানেজার তথা দল পরিচালক। দীর্ঘ তিন বছর ধরে উনি আমাদের যাত্রা দলের সাথে কাজ করে আসছেন। যথেষ্ট ভালো ভদ্র অমায়িক লোক উনি। হতে পারেন গরীব কিন্তু অতিথি আপ্যায়নে আদর যত্ন উনার তথা উনার পরিবারের বাকী সদ্যদের যে কতটা উচ্চমানের তা যিনি একবার গিয়েছেন উনার বাড়িতে তিনিই জানেন। কয়েকদিন আগে যে আমি গিয়েছিলাম, উনাদের আপ্যায়ন দেখে আমি স্তম্ভিত বিস্মিত হয়ে পড়েছিলাম। যদিও খুব একটা যাইনি আমি উনার বাড়িতে। যেহেতু নিয়ম মাফিক সপ্তাহে তিনদিন আমাদের রিহার্সাল হত বিনয় দাদারের গ্রামেই একটা প্রাথমিক স্কুলে। সেই স্কুলেই সকলের সাথে সকলের দেখা হত কথাবার্তা হত বলে বিশেষ একটা প্রয়োজন পড়ত না কারো বাড়িতে যাওয়ার। তাছাড়া সকাল বিকেলে তো দেখা হয় অহরহ হাঁটে বাজারে সকলের সাথে সকলের। যদিও সেই দিনের পর থেকে আর দেখা হয়নি আমার বিনয় দাদার। ফলে উনার মেয়ে যে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন সেই খবরটাও আমি পাইনি। দেখা না হওয়ার কারণ ছিল একটাই, সেটা হলো প্রচণ্ড তাপদাহে এই কয়দিন আমি বাড়ির বাইরে সেরকম ভাবে বেরোয়নি।
সেদিন আমি গিয়েছিলাম একটা নতুন জায়গায় যাত্রার বায়নার কথা নিয়ে কিছু আলোচনা করতে।
আমাকে দেখা মাত্রই মাধবী দৌড়ে এসেছিল আমার কাছে একটি আসন হাতে নিয়ে। ওদিকে তার দিদি শিউলি সেও ছুটে এসেছে হাতে একটি আসন নিয়ে।
“কাকু তুমি আমার আসনে বসবে।”
“না কাকু তুমি আমার আসনে বসবে।”
আর এক বোন পারুল চেয়ার নিয়ে এসে হাজির, “না কাকু তুমি চেয়ারে বসবে।”
দুই বোন দুই হাত ধরে টানাটানি, ওপর জন চেয়ার নিয়ে সামনে দাড়িয়ে আছে।
“তোরা কি মানুষটাকে একটু শান্তিতে বসতে দিবি না। “রান্নাঘর থেকে মায়ের চিৎকার। এদিকে বাবা মানে বিনয় দাদা মেয়েদের কীর্তি দেখে মুচকি মুচকি হাসছেন।
“তোরা যদি সকলেই এমন করিস, তাহলে কিন্তু আমি আর আসবো না বলে রাখলাম। একটা লোক কয়টা জায়গায় বসবো আমি তোরাই বল?” হাসতে হাসতে আমি বলে উঠি।
তবুও তাদের জেদ না তুমি আমার দেওয়া আসনেই বসবে। সত্যি যেন কতটা আপন আমি এদের। একটুও দ্বিধাবোধ বা সংকোচ কিছুই নেই মনে। কত সরল সাধাসিধে এরা। শিউলি বড় মেয়ে, বয়স আনুমানিক সতেরো বছর হবে। পারুল মেজো মেয়ে, ওর বয়স আনুমানিক পনেরো হবে। আর মাধবী ছোট মেয়ে, বছর বারো বয়স হবে। একটি ছেলে আছে খুবই ছোট। আনুমানিক বছর ছয়েকের হবে। শেষমেষ আমি ওদের জেদের কাছে পরাস্ত হয়ে বলে উঠি, আচ্ছা যে আমাকে সুন্দর করে এক কাপ চা বানিয়ে খাওয়াবে তার দেওয়া আসনে বসবো আমি।”
যেমনি বলা তেমনি তিনবোন ছুটে যায় রান্নাঘরের দিকে চা বানানোর জন্য। মা রেগে তিনজনকেই তাড়িয়ে দেন রান্নাঘর থেকে। কিন্তু ছোট মেয়ের কাছে অর্থাৎ মাধবীর কাছে হার মানতে বাধ্য হন মা স্বয়ং। শেষে মাধবী চা বানিয়ে নিয়ে আসে আমার জন্য। বাকী রইলো পারুল আর শিউলি। ওরা কেউ এনে দেবে জল,কেউ বা এনে দেবে বিস্কুট। সেদিন রাত্রিতে প্রয়োজনীয় আলোচনা শেষে আমি বাড়ি ফেরার জন্য সবেমাত্র উঠে দাড়িয়েছি। অমনি তিনদিক থেকে তিনজনে এসে ঘিরে ধরলো আমায়।
“কাকু ভাত খাওয়া দাওয়া করে যাবে তুমি।” কে শোনে কার কথা! না খেয়ে কিছুতেই আসতে দেবে না আমায় কেউ। একদিকে তিন মেয়ের জেদ, অন্যদিকে বিনয় দাদা ও বৌদির অনুনয় বিনয় যেন না খেয়ে আমি না যাই। বাধ্য হয়ে সেদিন রাত্রির খাওয়া দাওয়া সেরে ফিরতে হয়েছিল আমাকে বাড়িতে। একটা কথা এই মুহূর্তে ভীষণভাবে আমাকে তোলপাড় করছে। আমি পারলাম না মাধবীর কথা রাখতে। মাধবী ক্ষমা করিস তুই আমাকে। আমার দুচোখে জল চিকচিক করতে দেখে নিতাই দাদা বলে উঠলো, “কিরে যাবি তো নাকি? চল তাড়াতাড়ি?”
“হ্যা হ্যা তুমি একটু দাড়াও, আমি শুধু গামছাটা নিয়ে আসি ঘর থেকে।” বলেই আমি দৌড়ে বাড়িতে গিয়ে প্রবেশ করলাম। আমাকে এভাবে বাড়িতে দৌড়ে আসতে দেখে মা বাবা উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কি হলো? কি হয়েছে? এমন দৌড়াদৌড়ি কেন করছো তুমি?”
আমি কোন কথা না বলে গামছাটা নিয়ে ছুটে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এলাম। মা দরজা অবধি ছুটে এসে চিৎকার করে বলে উঠলেন “কি হয়েছে? সেটা তো জানাবে?”
“মাসিমা বিনয় দাদার ছোট মেয়েটা আজ মারা গেছে। তাই শ্মশানে যাচ্ছি আমরা।” নিতাই দাদা মায়ের উদ্দেশ্য বলে উঠলো।
আর কোন কথা নয়, আমি নিতাই দাদাকে তাড়া দিলাম তাড়াতাড়ি যাবার জন্য। দুজনেই একপ্রকার ছুটতে লাগলাম বিনিয় দাদার বাড়ির উদ্দেশ্য। কোথায় তাপদাহ? আর কোথায় সূর্যের প্রখর উত্তাপ? এই মুহূর্তে যেন কোন কিছুই উপলদ্ধি করতে পারছিনা আমি। আমার কানে তখনও কেউ ফিসফিস করে বলেই চলেছে,” কাকু আমাকে একটা রং পেন্সিলের প্যাকেট এনে দিওনা।”
বিনয় দাদার বাড়িতে পৌঁছে দেখলাম মাধবীর নিথর দেহটা তুলসী তলায় একটা সাদা কাপড় মুড়িয়ে রেখে দেওয়া হয়েছে। মাধবীর মা জ্ঞান শুন্য হয়ে পড়ে রয়েছেন বারান্দার এক কোণে। কিছু প্রতিবেশী মহিলা উনাকে নিয়ে ব্যস্ত। মাধবীর দুই দিদি পারুল ও শিউলি কেঁদে কেঁদে নিশ্চুপ হয়ে গেছে। তাদের মুখ দিয়ে আর কোন আওয়াজ বেরিয়ে আসছে না। শুধু দু চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুধারা। বিনয় দাদা মৃত মেয়ের শরীর স্পর্শ করে পাথরের মত চুপচাপ বসে রয়েছেন। এই দৃশ্য দেখামাত্র আমি নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না। অজান্তেই হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলাম আমি। মাধবীর মুখের কাপড়টা সরিয়ে এক পলক দেখেই আবার ঢেঁকে দিলাম আমি। পুরো মুখমন্ডল হলুদ ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণ করে রয়েছে। মাধবীর চোখ দুটো মেলেই রয়েছে। যেন আমাকেই দেখছে সে দুচোখ ভরে।
অবাক হলাম সেখানকার গ্রামের লোকের বিবেক বোধ বুদ্ধি মনুষ্যত্ব দেখে। মুষ্টিমেয় মাত্র দু চারজন এসেছে বিনয় দাদার বাড়িতে। বাকী গ্রামের লোকের কোন খোঁজ খবর নেই। যেন কোন কিছুই গ্রামে ঘটেনি। সমস্তকিছু স্বাভাবিক অবস্থায় রয়েছে। এই বিংশশতাব্দীতে এসেও যে মানুষ শুধুমাত্র গরীব বলে মানুষকে মানুষ মনে করেনা সেটাই ছিল সেদিনের এক জলন্ত উদাহরণ। ধীরে ধীরে আমাদের যাত্রাদলের আরো জনা ছয়েক লোক উপস্থিত হলো। সর্বমোট আমরা এখন প্রায় বারো থেকে চোদ্দ জন লোক হলাম। আর দেরী নয়। যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি করে বাঁশ ঝাড় থেকে বাঁশ কেটে এনে দোলনা বানিয়ে লাশ নিয়ে রওনা দিলাম শ্মশানের উদ্দেশ্য। মাধবীর শেষ বিদায় লগ্নে মাধবীর দুই বোন কাদতে কাদতে জ্ঞান হারালো। মা তো সেই আগে থেকেই জ্ঞান শুন্য হয়ে পড়ে রয়েছেন।
বাড়ি থেকে মার্কেট অবধি আমি কাঁধ লাগিয়েছিলাম মাধবীর লাশের দোলায়। মার্কেটের কাছে এলে অন্য জনকে কাঁধ লাগাতে বলে আমি দৌঁড়ে গেলাম একটি পুস্তকের দোকানে। দোকানদারকে তাড়াতাড়ি দুটি রং পেন্সিলের বক্স দিতে বললাম। রং পেন্সিলের বক্স দুটো হাতে নিয়ে দোকানদারকে টাকা দিয়ে যেই আমি মোড় ঘুরেছি অমনি আমার থেকে কিছুটা দূরে একপলক লক্ষ্য করলাম যেন মাধবী দাড়িয়ে আছে, আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। মুহুর্তের ব্যবধান, ভুল দেখলাম নাতো আমি! আমি পুনরায় আবারও সেদিকটায় চাইলাম। নাহ্ কোথায় মাধবী! কেউ তো নেই সেখানে! তাহলে কি আমি ভুল দেখলাম! তাড়াতাড়ি আমি সেখান থেকে বেরিয়ে আবারও শ্মশান যাত্রীদের সাথ নিলাম।
একসময় আমরা উপস্থিত হলাম শুকনো নদীর তটে। যদিও এই সময় নদীতে জল থাকে প্রতিবছরই। কিন্তু এবার কোথাও জলের বিন্দুমাত্র চিহ্ন নেই। পুরো নদী শুকিয়ে গেছে। নদীর বালু প্রখর রোদে তপ্ত লোহার মত গরম হয়ে রয়েছে। নদীর নীচের অংশে আমরা নামলাম লাশ নিয়ে। আমরা তো চলে এসছি লাশ নিয়ে। কিন্তু ততক্ষণে লাশকে দাহ করার জন্য যে কাঠ খড়ি আসার কথা তা তখনও এসে পৌঁছায়নি। নদীর কিনারা ছিল বেশ উঁচু। ফলে একদম নদীর কিনারায় না এলে নদীর নীচের অংশ দেখা যেত না। ঠিক তেমনই নদীর নীচ থেকে উপরের কোন কিছুই দেখা যেত না।
কেউ একজন নদীর কিনারার উপরে এসে সকলে ডাকতে লাগলো যে কাঠ খড়ির ভ্যান চলে এসেছে।কিন্তু সমস্যা হলো ভ্যান নদীর কিনারা অবধি আসবেনা। সেইজন্য যতদূর ভ্যান এসেছে ততদূর থেকে হাতে হাতে করে সকলে মিলে খড়ি ঢোলাই করে আনতে হবে। আমি সকলকে তাড়া দিলাম যে এই প্রখর রোদে দেরী না করে তাড়াতাড়ি সকলে মিলে খড়ি নিয়ে এসে যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি দাহ করে দেওয়া হোক। এদিকে নদীর কূলে শুষ্ক গরম বালুর উপর দাড়িয়ে থাকাটা জীবন মরণের সংশয় করে তুলেছে। আমার কথা শুনে সকলেই তড়িঘড়ি নদীর কিনারার উপরে উঠতে লাগলো খড়ি আনার জন্য। সকলেই এক প্রকার উপরে উঠে গেল। নীচে রইলাম আমি, নিতাই দাদা আর দুজন । আমি নিতাই দাদাকে বললাম আমার সাথে যেতে খড়ি আনতে। নিতাই দাদা বললো যে সে গেলে মৃতদেহ কে স্পর্শ করে রইবে। আমি অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম! মৃতদেহ তো বিনয় দাদার স্পর্শ করে থাকার কথা। তাহলে বিনয় দাদা কোথায়? নিতাই জানালো বিনয় দাদা দশকর্মার দোকানে গিয়েছে টুকিটাকি বাজার করার জন্য। কারণ লাশকে তো স্নান করাতে হবে। অবাক হলাম আমি! সত্যিই কি বিনয় দাদার মেয়ে মারা গিয়েছে! বিনয় দাদা নাকি দশকরমার দোকানে গিয়েছে বাজার করতে! কেউ শুনেছেন কখনো যে লোকটির মেয়ে মারা গিয়েছে সেই লোকটি স্বয়ং নিজে গিয়েছে বাজার করতে। কতটা দুর্ভাগ্য হলে এমনটা হয় একটা মানুষের সাথে। এতক্ষণ এই বিষয়টি একদম খেয়াল করিনি আমি। যদি আমি আগে খেয়াল করতাম আমি কখনোই বিনয় দাদাকে সেই কাজে পাঠাতাম না। একটা মেয়ে হারানোর কষ্টটা যে কতটা কষ্টের কিছুটা হলেও সেই উপলদ্ধিটা আমিও। করতে পারছি। কেননা আমিও একজন মানুষ। যাইহোক আমার মুখে আর কোন ভাষা রইল না কিছু বলার। মেয়ের বিয়ে তাই আনন্দে বাবা গিয়েছেন বাজার করতে। সত্যি একেই বলে নিষ্ঠুর নিয়তির খেলা। আমি নিতাই সহ বাকি দুজনকে তাড়াতাড়ি যেতে বললাম খড়ির ভ্যানের কাছে। আমি নিজে একা দাড়িয়ে রইলাম মাধবীর মৃতদেহ স্পর্শ করে।
নিতাই দাদাদের যাওয়ার দশ মিনিট অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। এখনও অবধি কেউ ফিরে আসেনি। এমনকি যারা আগে গিয়েছিল তারাও কেউ ফিরে আসেনি। আমি একা নদীর নীচে সেই প্রখর রোদের মাঝে গরম বালুর উপরে মাধবীর মৃতদেহ একটি পাটকাঠির দ্বারা স্পর্শ করে দাড়িয়ে রয়েছি। নদীর কিনারা এতটাই উঁচু যে দেখারও উপায় নেই, কে কতটা দূরে বা কাছে আছে। নদীর দুই পাড় যথেষ্ট উঁচু। ফলে কোন পাড়েই মানুষজন দেখা সম্ভব নয়। নদীর নীচের অংশে উত্তরে দক্ষিণে চাইলাম তো শুধু ধূ ধূ শুকনো বালু রোদের কিরণে চিকচিক করছে। এভাবেই কেটে গেল প্রায় পনেরো থেকে বিশ মিনিট। হিন্দু শাস্ত্রমতে মৃতদেহকে যতক্ষণ চিতায় না তোলা হচ্ছে ততক্ষণ কাউকে না কাউকে স্পর্শ করে থাকতেই হবে। স্পর্শ না করলে কি হবে সেটা আমার জানা নেই। এবার একটু একটু করে কেন জানিনা আমার ভয় ভীষণভাবে মনে দানা বাঁধতে শুরু করলো! ইচ্ছেকৃত বা অনিচ্ছাকৃত জানিনা আমি একবার জোরে চিৎকার করে উঠলাম” তোমরা কি আজ খড়ি নিয়ে আসবে কিনা? নিতাই দা, ও নিতাই দা তুমি কোথায়?”
কারো কোন উত্তর পেলামনা আমি! দ্বিতীয়বার যে ডাকতে যাবো সেই সাহসটুকুও পেলামনা আমি আর! এইবার আমি বিস্ময়ের দৃষ্টিতে মাধবীর মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। যদিও মুখটা সম্পূর্ণ ঢেকে রাখা আছে সাদা কাপড়ে। কিন্তু আমি লক্ষ্য করলাম ধীরে ধীরে মাধবীর মুখের উপর থেকে একটু একটু করে সাদা কাপড়টা সরে যাচ্ছে! হ্যাঁ, এটা কোন গল্প নয়, একদম বাস্তব সত্য আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি কাপড়টা খুব ধীরে ধীরে একটু একটু করে সরে যাচ্ছে। আমি অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছি অবাক হয়ে। আমার বুকে কে যেন হাতুড়ি পেটাতে শুরু করলো! পারছিনা ভয়ে চিৎকার করতে, না পারছি ভয়ে ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে যেতে! এমন পরিস্থিতি আমার!
একসময় মাধবীর মুখমন্ডল থেকে সম্পূর্ণ কাপড়টা সরে গেল। মাধবীর খোলা দৃষ্টি ছিল অন্যদিকে। পলক না পড়তেই মাধবীর দৃষ্টি এখন আমার দিকে। আমি স্তব্ধ, আমি নিথর! আমি বাকরুদ্ধ! ধীরে ধীরে মাধবী মুচকি হেসে বলে উঠলো, “কাকু তুমি আমার আসনে বসবে। কাকু আমি তোমাকে সুন্দর করে চা বানিয়ে খাওয়াবো। বলো তুমি আমার আসনে বসবে? কাকু তুমি আমার জন্য রঙ পেন্সিল নিয়ে আসবে, আমি তোমায় কথা দিয়েছিলাম যে ধনী গরীবের ছবি এঁকে দেব তোমায়। কাকু ও কাকু বলোনা এনে দেবে রঙ পেন্সিল। বলোনা এনে দেবে রঙ পেন্সিল। কাকু ও কাকু… কাকু… ও কাকু…
আমি তখনও বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছি মাধবীর মুখপানে! মাধবী ডেকেই চলেছে, কাকু… কাকু… কাকু…
হয়ত মাধবী আরো কিছু বলতে চেয়েছিল আমায়। কিন্তু সে আর বলার সুযোগ পেল না। ততক্ষনে তিন চারজন খড়ি হাতে নিয়ে এসে উপস্থিত হয়েছে মাধবীর লাশের কাছে। এক এক করে সকলেই এসে উপস্থিত হলো হাতে হাতে খড়ি নিয়ে। নিতাই দাদা এলো। এলো বিনয় দাদা। সাথে একজন পণ্ডিত মশাই। সকলেই লক্ষ্য করলো মাধবীর মুখমন্ডল খোলা! আমাকে নিতাই দাদা জিজ্ঞেস করলো কে মাধবীর মুখের কাপড় সরালো। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত বলে উঠলাম, “মাধবী নিজেই সরিয়েছে।”
আমার কথা শুনে সকলেই অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রইলো!
এবার আমি প্যান্টের পকেট থেকে দুটো রঙ পেন্সিলের বাক্স বের করে মাধবীর মাথার উপরে রেখে দিতে দিতে বলে উঠলাম, “মাধবী এই নাও তোমার রঙ পেন্সিল। পারলে তুমি ওপারে গিয়ে ধনী গরীব ভেদাভেদ না রেখে সকলকে এই একই রঙে রাঙিয়ে তোলো তোমার রঙ পেন্সিলের রঙের স্পর্শে ভালোবাসায়। মনে রেখ মাধবী রঙ পেন্সিলের রঙ আলাদা আলাদা হলেও তাদের কর্ম কিন্তু একই।”
রাত্রি আটটার দিকে শ্মশান থেকে দাহ কাজ সম্পূর্ণ করে সেদিন বাড়ি ফিরেছিলাম আমি।
দীপক সরকারের ভৌতিক গল্প: মাধবী
এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
দীপক সরকার। পিতার নাম শচীন সরকার। মায়ের নাম বাসন্তী সরকার। দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার তপন থানার অন্তর্গত করদহের জামালপুর গ্রামে বাড়ি। পড়াশোনার পাট চুকিয়ে বর্তমানে দিল্লীর একটি প্রাইভেট সংস্থায় কর্মরত। বিগত দুবছর ধরে ভৌতিক গল্প উপন্যাস লেখালেখি। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় ম্যাগাজিনে তথা বইয়ে বিভিন্ন গল্প প্রকাশিত হয়েছে। ২০২২ কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় প্রকাশিত একক ভৌতিক উপন্যাস শ্মশানে প্রেয়সী। অন্যতম গল্পগুলি হলো , ভুতুড়ে ট্যাক্সি, নৌকা আতঙ্ক, শবনম, মহারাষ্ট্রের পথের দিশারী সেই মহিলা, ফেসবুক অতৃপ্ত আত্মা, নন্দিনী, আতঙ্ক।
একটি মন্তব্য করুন
একটি মন্তব্য করুন