আপিলের নথিতে জামিনের দরখাস্ত না থাকায় ঘুষ গ্রহণের মামলায় আট বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) বরখাস্ত হওয়া পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছিরের জামিন আদেশ একদিন পরেই প্রত্যাহার করে নিয়েছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে তার মামলাটি কার্যতালিকা থেকে বাদ দিয়েছেন আদালত।
বুধবার (২৪ আগস্ট) বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের একক হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। এর আগে মঙ্গলবার (২৩ আগস্ট) একই বেঞ্চ এনামুল বাছিরকে জামিন দেন।
আদালতে এনামুল বাছিরের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট ফারুক আলমগীর চৌধুরী, দুদকের পক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খুরশিদ আলম খান, রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আশেক মোমেন।
আদালত এনামুল বাছিরের আইনজীবী ফারুক আলমগীর চৌধুরীকে উদ্দেশ করে বলেন, আইনজীবীদের কথা আমরা বিশ্বাস করি। এ কারণে আপনাদের কথার ওপর বিশ্বাস করে অনেক আদেশ দিয়ে থাকি। আপনি এনামুল বাছিরের আপিলের নথিতে জামিনের দরখাস্ত সংযুক্ত না করেই জামিন শুনানি করেছেন। এটা একটা অপরাধ। দ্বিতীয়ত, আপনি আদালতকে না জানিয়ে পরে জামিনের দরখাস্ত বেঞ্চ অফিসারের কাছে দিয়েছেন। এটা আরেকটা অপরাধ। এই পেশাগত অসদাচারণের জন্য আমরা আপনাকে বার কাউন্সিলে পাঠাতে পারতাম। কিন্তু তা করছি না। তবে খন্দকার এনামুল বাছিরের জামিন আদেশ প্রত্যাহার করে নিচ্ছি এবং মামলাটি কার্যতালিকা থেকে বাদ দিচ্ছি।
জামিন আদেশ প্রত্যাহারের পর দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, গতকাল দুইপক্ষকে শুনে আদালত জামিন দিয়েছিলেন। আজকে অর্ডারটি রিকল করে মামলাটি আউট অব লিস্ট করে দিয়েছেন। একটা পানিশমেন্ট হিসেবে, কারণ খন্দকার এনামুল বাছিরের আইনজীবী জামিনের দরখাস্ত নথিতে না দিয়েই এটি শুনানি করেছেন। বিচারপতি ওনাকে বিশ্বাস করেই, ওনার কথা শুনে জামিন দিয়েছিলেন। কিন্তু পরে দেখা যাচ্ছে যে, জামিনের দরখাস্ত নথিতে নেই।
বিচারপতি স্পষ্ট করে বলেছেন, আপনি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আপনাদের বিশ্বাস করি, আপনাদের কথার ওপর আমরা আদেশ দেই। কিন্তু আপনি জামিন দরখাস্ত না দিয়ে শুনানিতে অংশ নিলেন, এটা ভুল হতে পারে। কিন্তু আমাকে বলা উচিত ছিল। কিন্তু তা আপনি করেননি। এটা প্রথম ভুল। তারপর দ্বিতীয় ভুল দরখাস্ত আমার অনুমতি না নিয়ে আমার বেঞ্চ অফিসারকে জামিনের দরখাস্তটি দিলেন। আমার বেঞ্চ অফিসারের ভুল হচ্ছে, তিনি আমার অনুমতি না নিয়ে দরখাস্ত নিয়েছে। এখানে যেকোনো দরখাস্ত দিতে গেলে আমার পারমিশন লাগবে। এখন দেখছি দুইজনেই সমান অপরাধী। আমি আপনাকে বার কাউন্সিলের পাঠাতাম, কিন্তু আপনাকে আমি চিনি, আপনার বিরুদ্ধে অতিতে খারাপ রেকর্ড নেই। এই শাস্তি হিসেবে জামিন প্রত্যাহার করে নিলাম।
গত ১৩ এপ্রিল খন্দকার এনামুল বাছিরের আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে ৮০ লাখ টাকা জরিমানা স্থগিত করেন উচ্চ আদালত।
তার আগে ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এর বিচারক শেখ নাজমুল আলম এ মামলায় রায় দেন। রায়ে দুদকের বরখাস্ত পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছিরকে আট বছর ও পুলিশের বরখাস্ত উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মিজানুর রহমানকে তিন বছর কারাদণ্ড দেন আদালত। এছাড়া বাছিরকে ৮০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
এর মধ্যে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগে মিজানকে দণ্ডবিধির ১৬১ ধারায় ও বাছিরকে দণ্ডবিধির ১৬৫(এ) ধারায় তিন বছর করে বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। অপরদিকে মানিলন্ডারিং আইনের ৪ ধারায় বাছিরকে পাঁচ বছর কারাদণ্ড ও ৮০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। বাছিরের দুটি দণ্ড একসঙ্গে চলবে বলে তাকে পাঁচ বছর দণ্ড ভোগ করতে হবে।
তবে দুর্নীতি দমন প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় উভয়ে দোষী সাব্যস্ত হলেও একই ধরনের অভিযোগে দণ্ডিত হওয়ায় এ ধারায় কাউকেই সাজা দেওয়া হয়নি।
২০২১ সালের ২৩ ডিসেম্বর মামলাটিতে সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। পরে ৩ ফেব্রুয়ারি মিজানুর রহমানের পক্ষে তার আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী শুনানি করেন। অপরদিকে গত ১০ ফেব্রুয়ারি বাছিরের পক্ষে আইনজীবী সৈয়দ রেজাউর রহমানের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে আদালত রায়ের জন্য ২৩ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করেন।
৪০ লাখ টাকার ঘুষ কেলেঙ্কারির অভিযোগে ২০১৯ সালের ১৬ জুলাই দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এ দুদকের পরিচালক শেখ মো. ফানাফিল্লাহ বাদী হয়ে মামলাটি করেছিলেন। ২০২০ সালের ১৯ জানুয়ারি তাদের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন দুদকের একই কর্মকর্তা।
গত বছর ৯ ফেব্রুয়ারি তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট গ্রহণ করেন ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ কেএম ইমরুল কায়েশ। এরপর তিনি মামলাটি বিশেষ জজ আদালত-৪ এ বদলির আদেশ দেন। ২০২১ সালের ১৮ মার্চ আসামিদের অব্যাহতির আবেদন নাকচ করে চার্জ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত।
২০১৯ সালের ৯ জুন একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে প্রচারিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে পরিচালিত দুর্নীতির অনুসন্ধান থেকে দায়মুক্তি পেতে দুদক পরিচালক বাছিরকে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়েছিলেন ডিআইজি মিজান। ঘুষ লেনদেন সংক্রান্ত কথোপকথন রেকর্ড করে ওই চ্যানেলকে দিয়েছিলেন মিজান। ডিআইজি মিজানও এ বিষয়ে নিজেই গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেন। অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলা থেকে বাঁচতে ওই অর্থ ঘুষ দেন বলে ডিআইজি মিজান দাবি করেন।
এ প্রতিবেদন প্রচারিত হওয়ার পর দুদক সংস্থার সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখতকে প্রধান করে তিন সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটি ২০১৯ সালের ১০ জুন প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে পরিচালক বাছিরকে দুদকের তথ্য অবৈধভাবে পাচার, চাকরির শৃঙ্খলাভঙ্গ ও সর্বোপরি অসদাচরণের অভিযোগে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে কমিশন।
এরপর ২০১৯ সালের ১৬ জুলাই দুদক পরিচালক ও অনুসন্ধান টিমের দলনেতা শেখ মো. ফানাফিল্লাহ মানিলন্ডারিং আইনে সংস্থার ঢাকা-১ সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে মামলাটি দায়ের করেন। একই বছর ২২ জুলাই এনামুল বাছিরকে গ্রেপ্তার করে দুদকের একটি দল। সেই থেকে তিনি কারাগারে।
অপরদিকে দুর্নীতির মামলায় গ্রেপ্তার ডিআইজি মিজানকে এ মামলায়ও গ্রেপ্তার করা হয়।