দেশের ২৩১টি চা বাগানের দেড় লাখ শ্রমিক মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে গত ১৩ আগস্ট থেকে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট শুরু করে। তারা এখন মজুরি হিসেবে পান ১২০ টাকা। তাদের দাবি ৩০০ টাকা করতে হবে। এই দেড় লাখ শ্রমিকের ওপর নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা প্রায় আট লাখ। (ডয়চে ভেলে, ১৮ আগস্ট)
এইটা একটা ভয়ঙ্কর পরিসংখ্যান। আধুনিক সভ্য শিক্ষিত ক্লাসের লোকেরা শ্রমিকদের আন্দোলন শুরু না হইলে এই পরিসংখ্যানের কথা জানতেই পারতেন না। কেন পারতেন না? এই আন্দোলন শুরু হওয়ার পর এই পরিসংখ্যান দেখে সমাজের তথাকথিত এলিট শ্রেণি যেন কেঁপে উঠছেন। তাদের হায় হায় অবস্থা। যেন তারা তার আগে এইসব কোনোদিন জানতে পারেননি। তাদের এতো না জানা নিয়ে এলিটগিরি বা শিক্ষিত সেজে থাকার চেহারা আপনারা কল্পনাও করতে পারবেন না। তারা দেশের এমন অনেক কিছুই জানেন না। অথবা জানলেও মুক ও বধির অবস্থা তাদের। যখন বিলাসবহুল জীবন যাপন করছেন একটা শ্রেণি। যখন একটা শ্রেণির মানুষের ‘ভাগ্য’, অর্থনৈতিক অবস্থা দিনকে দিন পাগলা ঘোড়ার বেগে ছুটছে। তখন সমাজের অধিকতর মানবেতর আরেকটা শ্রেণি জীবনের সত্যিকার লড়াইটা করছেন।
শ্রমিকদের রক্ত দেওয়ার ঘোষণা ও মুক্তিযুদ্ধের যোগসূত্র:
তাদের তেজ আছে। আন্দোলনকারী বক্তব্য শোনেন। বুঝতে পারবেন। শিলা ভূঁইয়া নামে এক নারী শ্রমিক বলেন, ‘আমাদের দাবি জানানোর আগেই বাগান মালিকদের উচিত, আমাদের খোঁজখবর নেওয়া। আমরা কাজ ফেলে কেন আন্দোলন করব! দুই বছর আগে যে জিনিস ১০০ টাকায় পাওয়া যেত, এখন সেটা ২০০ টাকা। আমাদের তো আলাদা কোনো রুজির ব্যবস্থা নেই। এটা তো বাগান মালিকেরা জানে। আমরা ছেলেমেয়েদের আশা পূরণ করতে পারি না। আমরা আন্দোলন করছি। দাবি আদায় না হলে রাস্তায় রক্ত দেব। যদি শ্রমিক ইউনিয়নও আন্দোলন বন্ধ করার কথা বলে, আমরা মানব না।’ (প্রথম আলো)
এখন তারা যদি সত্যি সত্যি রক্ত দেওয়া শুরু করেন বা স্টেট অথরিটি যদি তাদের রক্ত দিতে বাধ্য করেন তাহলে এই রক্তের স্রোতে কী কী ভেসে যেতে পারে চিন্তা করেছেন! দশ বছরে আপনার দুইটা বাজেটের সমান টাকা পয়সা বিদেশে পাচার করতে পারেন আর তাদের এই সামান্য দাবি মানতে পারবেন না? নিষ্পেশনের পরিণতিতে একটা দেশ তৈরি হয়েছিল। সাম্য ভ্রাতৃত্ব মানবিক মর্যাদা রক্ষার ইশতেহার দিয়ে জন্ম নেওয়া এই বাংলাদেশে আপনারা যদি ৫০ বছর পরেও পাকিস্তানের মতো আচরণ করেন। তাহলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আর থাকে কী?
শ্রমিকদের আস্থার জায়গা প্রধানমন্ত্রী, তিনি নিরাশ করলেন!
শেখ হাসিনা, বঙ্গবন্ধুর কন্যা। শেখ মুজিবের জন্য আপামর মানুষের যে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা- সেই জায়গাটা ধীরে ধীরে কমে আসছে। এখনো প্রচুর মানুষ বঙ্গবন্ধুরে ভালোবাসেন ফলে তার মেয়েরে কঠিন ভাষায় কিছু বলেন না। বা কঠিন ভাষায় শেখ হাসিনাকে কিছু বললে তিনি শুনে না। ফলে সফট করে বলেন। যেকোনো জন-মুভমেন্টে কিন্তু আন্দোলনকারীরা শেখ হাসিনার প্রতি আস্থা রাখেন। যদিও বারবার আশাহত হতে হয়েছে।
সেই আস্থাটা শ্রমিকদের আন্দোলনেও দেখা গেল। একজন শ্রমিকের বক্তব্য শোনেন বিষয়টা বুঝতে পারবেন। চা-শ্রমিক দুলাল হাজরা বলেন, ‘আমাদের আন্দোলন চলছে। প্রতিদিন পত্রিকা ও টেলিভিশনে সংবাদ হচ্ছে। আমাদের দুঃখগুলো দেখানো হচ্ছে। আমাদের দাবির বিষয়ে বলা হচ্ছে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। এ ছাড়া আমাদের অধিকার আদায় হবে না।’ (প্রথম আলো)
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী করলেন কী? বুঝতে পারলেন না; ভালোবাসার জায়গাটা যখন ঘৃণায় ভরপুর হয়ে ওঠে তার পরিণতি কী, প্রত্যেক প্রেমিকই সেইটা বোঝেন। দেশের মানুষের গড় আয় যখন ৩ হাজার ডলারের কাছাকাছি তখন প্রধানমন্ত্রী তাদের সামান্য ৩০০ টাকা মজুরির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারলেন না? তিনি নাকি ১৪৫ টাকায় মত দিছেন। ২০ আগস্ট শ্রম অধিপ্তর ও সরকারের সঙ্গে বৈঠকের পর মৌলভীবাজার-৪ আসনের সংসদ সদস্য মো. আব্দুস শহীদ বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী চা শ্রমিকদের প্রতি খুবই আন্তরিক। তারই নির্দেশে আমি আজ এখানে এসেছি। মালিকপক্ষ ২০ টাকা মজুরি বাড়াতে চেয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী নিজে আরও ৫ টাকা বাড়ানোর নির্দেশনা দিয়েছেন।’ (নিউজবাংলা)
মালিকপক্ষ ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের কথা বলার ঢঙ একই:
গত ১৩ আগস্ট বাংলাদেশীয় চা-সংসদের সিলেট বিভাগের চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ শিবলী বলেন, ‘মালিকপক্ষের সঙ্গে শ্রমিকদের আলোচনাকালে এভাবে কাজ বন্ধ করে আন্দোলন করা বেআইনি। আমরা আশা করছি, তারা আন্দোলন বন্ধ করে কাজে যোগ দেবে। এখন চা-বাগানে ভরা মৌসুম। কাজ বন্ধ রাখলে সবার ক্ষতি। তারাও এই মৌসুমে কাজ করে বাড়তি টাকা পায়।’ (প্রথম আলো)
গত ১৬ আগস্ট এক বিবৃতিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, গত বেশ কিছুদিন ধরে শ্রমিকরা নির্দিষ্ট সময় শান্তিপূর্ণ কর্মবিরতি পালনের মাধ্যমে বাগান কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা সত্ত্বেও শ্রম বিভাগের মহাপরিচালক সম্প্রতি একটি চিঠির মাধ্যমে চলমান আন্দোলনকে “শ্রম আইনের পরিপন্থি” বলে হুঁশিয়ারি দেন। যা মূলত চা-শিল্প মালিকদের ঔপনিবেশিক মানসিকতার প্রতি একাত্মতার বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছু নয়। (ঢাকা ট্রিবিউন)
কেন একটা ন্যায্য আন্দোলনে সরকারের একটা প্রতিষ্ঠান হুমকি দিচ্ছে? তারা কাদের স্বার্থে কাজ করেন? জনস্বার্থই যদি রক্ষা করতে না পারেন তারা তাহলে এইসব প্রতিষ্ঠানের জন্য কেন জনগণের ট্যাক্সের টাকা খরচ করা হবে?
শ্রমিকদের চাওয়া:
গত ১৯ আগস্ট ত্রিপক্ষীয় বৈঠক শেষে (শ্রমিক-মালিক-সরকার) শ্রমিক নেতা পরেশ কালিন্দি বলেন, চা শ্রমিক ইউনিয়ন, বাংলাদেশীয় চা সংসদ ও শ্রম অধিদপ্তরের ত্রি-পক্ষীয় বৈঠকেও কোনো সিন্ধান্ত আসেনি। ফলে কর্মবিরতি অব্যাহত থাকছে। তবে এ এ বিষয়ে পঞ্চায়েত প্রধানদের সঙ্গে আলোচনাক্রমে তারা কর্মবিরতি অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। শ্রম দপ্তরের বৈঠকে ১২০ টাকা থেকে ২০ টাকা বাড়িয়ে ১৪০ টাকা মজুরি দিতে রাজি হন মালিকপক্ষ। এটি চা শ্রমিকদের জীবনমানের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।” (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)।
এই অসামঞ্জস্যপূর্ণ জীবনমান রেখে দেশের কোন কোন ভিশন সফল হবে আমি জানি না বা আমরা জানি না। কেন দেশের একটা শ্রেণিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পিছিয়ে রাখার বন্দোবস্ত করা হচ্ছে? তাদের সন্তানেরা পড়ালেখা করতে পারেন না। তারা একবেলা পেটপুরে খেতে পারেন না। একবেলা ভালো তরকারি দিয়ে খাবার খান না। তাদের কষ্ট হয়তো আমরা সেলিব্রেট করছি। চা শ্রমিক মায়ের এক সন্তান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রের ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া লেখাটা আমরা পড়েছি। কোনো কারণ ছাড়াই হাহাকার বইয়ে গেছে। কিন্তু সমাধানের জন্য একটা ধমক আমরা দিই নাই। আমরা আসলে এতো ভালো অর্থনীতি শাস্ত্রের বিশেষজ্ঞ হয়ে গেছি যে তাদের ‘অসামঞ্জস্যপূর্ণ জীবনমানকে’ নির্ণয় করতে পারছি না।
সমাধান আসছে না কেন?
বাংলাদেশ বিশ্বের তিন শতাংশ চা উৎপাদন করে। ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশি চায়ের বাজারের মূল্য প্রায় ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। জিডিপিতে এই শিল্পের অবদান প্রায় ১ শতাংশ।
লাভজনক একটা খাতের শ্রমিকেরা এমন মানবেতর জীবনযাপন করেন। তারা মানসম্পন্ন একটা জীবনও চাচ্ছেন না। ক্ষুধার যন্ত্রণাটা একটু প্রশমিত করতে চাচ্ছেন। তারা দিনে ২০ কেজি চা পাতা তুলতে না পারলে প্রতি কেজিতে ৬ টাকা করে কম পান। আবার বেশি চা পাতা উঠালে তার জন্য ২ টাকা বেশি পান। আবার সকালের রুটি খাওয়ার জন্য যে রেশন পান সেটিও কেউ কেউ পান না। চায়ের জমিতে যারা লাউগাছ বা শাকসবজি বুনেন খাওয়ার জন্য তাদের দেওয়া হয় না। এমন প্রহসন তাদের সঙ্গে কতদিন চলতে দেওয়া যায়? মনে হয় যায় না।
কিন্তু প্রহসন থামছে না কেন? সমাধান না পাওয়ার একটা ইঙ্গিত আছে গত ২০ আগস্ট প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে। নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক কেন্দ্রীয় কমিটির এক নেতা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের বৈঠকে ডেকে নিয়ে একধরনের চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে। আমাদের শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলেই আন্দোলন প্রত্যাহার করার ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়েছিলাম।’
নেতারা বাধ্য-বাধকতা মানলেও শ্রমিকেরা কিন্তু মানবে না। সেইটা তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া দিয়ে বুঝতে পারছেন নিশ্চয়। গ্রামের একটা প্রবাদ আছে, সেটি বলে রাখি কাজে দিতে পারে ‘দেরি করলে কিন্তু ডেট (পতন) হয়ে যাবেনি’।
লিখেছেন: অর্বাক আদিত্য