‘ঘোড়েল’ পর্ব – এগারো

মুসা আলি
মুসা আলি
20 মিনিটে পড়ুন

জয়ের অন্তর জুড়ে শুধু খুশির বন্যা। সকাল হতেই সেই মাত্রা আরও অনেকখানি বেড়ে গেছে। সুচরিতার কাছে খবরটুকু পৌঁছে না দেওয়া পর্যন্ত তার মনে যেন কোনো স্বস্তি নেই। শোনার পরে সুচরিতা কী প্রতিক্রিয়া দিতে পারে, তা একবার অনুমান করে নিল। বেশ আনন্দে ভাসছিল, মনে মনে আর তর সইছিল না। সুচরিতা যত ভেঙে পড়বে, ততই তার সুবিধে। নিজেকে সহৃদয় বন্ধু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ রয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সুচরিতার মনে নতুন আলো জ্বেলে দিতে পারবে বলেই জয়ের মনের বিশ্বাস ক্রমে সুদঢ় হয়ে উঠছে। ভিতরের শক্তিতে কেউ সর্বহারা হয়ে গেলে অন্যের আশ্রয় গ্রহণ করা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। জয় তেমনি আশ্রয়দানের বদান্যতার মধ্যে ঢুকে পড়ে ছটপট করছে।
একবার ভাবল, সুবিমলদাকে না জানিয়ে সুচরিতার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া ঠিক হবে না, আবার ভাবল, যাওয়ার পরের অভিজ্ঞতা সুখকর হলে এবং তা গুরুকে জানালে খুশি না হয়ে পারবেন না। ভাবল, সেই প্রথম সুচরিতার কাছে গিয়েছিল গুরুর দূত হয়ে, সেই স্মৃতি সুচরি নিশ্চয় ভুলতে পারে নি। সাইকেলে উঠে বসল জয়, মাত্র কুড়ি মিনিটের রাস্তা। পথে যেতে যেতে ভাবল, দেখা হলে সুচরিতা নিশ্চয় তার সঙ্গে মন খুলে কথা বলতে বাধ্য হবে। নিজস্ব মনের ভাবনায় পর্যায়ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ল জয়। মেয়েটা সত্যি ভালো, ভুল করে প্রদীপের পাল্লায় পড়ে এতদিন তার সঙ্গে ঠিকমতো ওঠাবসা করতে পারেনি। খেলার মাঠে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পিছনে সে যে অবদান রেখেছিল, তা সুচরিতা নিশ্চয় ভুলে যায়নি।
সাইকেলে হনহনিয়ে এগিয়ে চলল জয়, সুচরিতার বাড়ির সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো, জোরে বেল বাজাতে শুরু করল।
হতচকিত সুচরিতার মা বলল, কেউ কী তোর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে?
জয় আবার সজোরে বেল বাজিয়ে দিল। সুচরিতা বারান্দায় পার হয়ে আরেকটু সামনে এসে দেখল, জয় এসেছে তার সঙ্গে দেখা করতে। বলল, এত সকালে?
সুবিমলদা পাঠিয়েছেন।
বিশেষ খবর আছে নাকি? সুচরিতার মা তখন রান্নাঘরে কী করছিল, সুচরি বলল, ওমা, মাগো, জয়দা এসেছে, চা করে দাও।
জয় বারান্দার উপর জাঁকিয়ে বসল। শীতের সকাল, শিরশিরে উত্তুরে হাওয়া বইছে। গায়ে জড়ানো জ্যাকেটের চেনটা বুক পর্যন্ত টেনে দিয়ে বলল, এ খবর শুনলে মাসিমা সবচেয়ে বেশি অবাক হবেন।
সুচরিতা ভাবল, জয়দা তার চাকরির জন্যে নতুন কোনো খবর নিয়ে আসতে পারে কিন্তু জয় সেই প্রসঙ্গে না ঢুকে গম্ভীর মুখে অপেক্ষায় থাকল, চায়ের ট্রে হাতে সুচরির মা এসে বলল, আমার খুব মনে আছে বাবা, তুমিই প্রথম সুচরিকে ভালো খবর দিতে এসেছিল।
মাসিমা, সুচরিকে একটু সাবধান করে দিতে এসেছি আজ।
কী রকম? থমকে গেল সুচরিতার মা।
চায়ের গরম কাপে চুমুক দিয়ে জয় সময় গুণতে লাগল, সুচরিতার মা উন্মুখ হয়ে চেয়ে থাকল তার দিকে। মূল খবরটুকু সংক্ষিপ্ত আকারে জানিয়ে জয়ের মন্তব্য, মাসিমা, প্রদীপ ছেলেটা এরকম, আরও অনেক খারাপ রিপোর্ট আছে ওর নামে, এতদিন সুচরিতাকে সেসব বলতে পারিনি। আর চেপে রাখা ঠিক হবে না বলেই ছুটে এসেছি। ভবিষ্যতে সুযোগ বুঝে প্রদীপ সুচরিতাকে অনেক বড়ো ক্ষতি করে দিতে পারে।
সুচরির মা কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেল। বজ্রপাত এমনিই নির্মম যে সেই আঘাতে কেউ মারা গেলে শুধুমাত্র ভাগ্যকে দোষারোপ করে মানুষ নিজের সান্ত্বনা খুঁজে পেতে চায়। চাপা স্বরে সুচরিতার প্রথম প্রশ্ন, সালিশি সভায় সুবিমলদা কী নিজেই উপস্থিত ছিলেন?
জয় সে কথার কোনো উত্তর দিল না। সুচরিতা রাগে দুঃখে কাতর হতে হতে বিড় বিড় করে শুধু বলল, তাহলে ভিতরে ভিতরে এমনিই?
জয় তাল ঠুকল, তুমিই শুধু জানতে পারো নি।
সুচরিতা নিরুত্তর।
বাজারে পটলার দোকানে সুবিমলদা এতক্ষণ এসে গেছেন, দেখা করতে যাবে?
তাই চলো, আমারও কিছু বলার আছে।
দুজনে পাশাপাশি হাঁটছে। জয়ের ভিতরের থার্মোমিটারের তাপ বেড়েই চলেছে। প্রদীপকে নিয়ে সুচরিতা যত বেশি বিরূপ হবে তার প্রতি তত বেশি ঢলে পড়তে বাধ্য হবে। সুচরির সামনে অটোমেটিক চয়েস হয়ে উঠতে পারবে সে। সুবিমলদা সুচরিকে মহিলা সংগঠনের মাথায় বসিয়ে দিলে সেই সুযোগও সে নিতে পারবে। নিজেকে সাকার করে তোলার জন্য সুচরিতাকে অস্ত্র হিসেবেও ব্যবহার করতে পারবে। অস্ফুটে বলল, তোমাকে একটা প্রসঙ্গ বলব?
কেন বলবে না?
অন্য কিছু মনে করবে না তো?
মানে? সুচরি মুখ তুলে তাকালো জয়ের দিকে।
বলছি কী, আমার চাকরি পাওয়ার প্রসঙ্গটা সুবিমলদাকে একবার মনে করিয়ে দেবে?
আমার কথা শুনবেন?
তুমি যেটা বলবে, গুরু সেটাই করবে।
আমাকে নিয়ে এভাবে ভাবছ?
তোমাকে নিয়ে গুরু এখন অনেক বড়ো স্বপ্ন দেখছেন।
কী রকম?
তুমি খুব তাড়াতাড়ি নেত্রী হয়ে যাবে।
জয়দা, এ প্রত্যাশা আমার মধ্যে নেই।
কিছু দিন পরে মিলিয়ে নিও।
জয় দুহাতের তালু যোগ করে আরও বলল, জানো সুচরিতা, অনেকদিন গুরুর পিছনে পড়ে আছি। লোকটা ইচ্ছা করলেই যে কোনো সময় একটা কিছু করে দিতে পারেন। সদরে গুরুর যথেষ্ট মর্যাদা রয়েছে, অবশ্য আমি পাশে না থাকলে একটু ফাঁকা ফাঁকা লাগবেই। সময়ের এ বিড়ম্বনা গুরু কেন যে বুঝতে চান্ না।
সুচরিতা একটা নতুন সূত্র লাভ করল সেই প্রসঙ্গে। সঙ্গীহারা হওয়ার ভয়ে কী সুবিমলদা জয়কে এভাবে থামিয়ে রেখেছেন? রাজনীতির জটিল অঙ্ক। সুচরিতা মাথায় আর কিছু নিতে পারল না।
পটলার চা দোকানের সামনে এসে দেখল, সুবিমলবাবু ভিতরে বসে আছেন, পাশে বসে অপরিচিত কয়েকজন ফিসফিস শব্দে কী সব বলছেন।
সুচরিতার মধ্যে নতুন উদ্দীপনা, জয়কে বলল, বামদিকে যে ভদ্রলোক বসে আছেন, উনি কে?
জেলা থেকে এসেছেন, বড়ো মাপের নেতা, গুরুর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক।
নামটা কী বলবে?
সেখ নাসিরুদ্দিন।
জেলা সংগঠনের মূল দায়িত্বে রয়েছেন?
তা বলতে পারো, চাকরি বাকরির সুযোগ করে দেওয়ার জন্য সুবিমলদা ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন, ফল পেতে দেখেছি বার বার। নাসিরুদ্দিনদা মানুষ হিসাবে খুব অমায়িক, অদ্ভুত মিশুকে, ভিতরে কোনো দাম্ভিকতা নেই।
পরিচয় করা যায় না?
ওই ব্যাপারে এতটুকু এগোতে পারবে না সুচরি, মূল বাধা সুবিমলদা নিজেই, কেউ প্রত্যক্ষভাবে যোগাযোগ করুক, তা চান না।
কারণ কী?
এটুকু ধরে রাখতে না পারলে নিজের নেতৃত্ব যে আঁটোসাঁটো অবস্থায় থাকে না, সুবিমলদা তা ভালোমতোই বোঝেন।
তাহলে কী কিছুতেই পরিচয় করা সম্ভব নয়?
সেই চেষ্টা করতে গিয়েই ভুগতে হয়েছে আমাকে। সুবিমলদা চান না, তাঁকে টপকে কেউ নাসিরুদ্দিনদার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করুক। দুজনের ভিতরের গটআপ শুনবে? কেউ স্বাধীনভাবে যোগ রাখতে চাইলে নাসিরুদ্দিনদা মন খুলে কথা বলবেন, পিঠে হাত চাপড়ে দেবেন, মনে হবে, সুযোগের মূল সূত্রে ঢুকে পড়েছি কিন্তু ওই পর্যন্ত, চাকরির মূল প্রশ্ন শুনে চুপ করে থাকার দার্শনিকতায় অবাক না হয়ে পারবে না।
সুচরিতা কেমন যেন আনমনা হয়ে গেল। সুবিমল একবার আড়চেখে জয়ের পাশে সুচরিতাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আলোচনার গতি বাড়িয়ে দিলেন। জয়কে উদ্দেশ্য করে বললেন, মিনিট পাঁচেকের মধ্যে এ পর্ব শেষ করছি, তারপর স্বভাবসুলভ সেই পুরানো হাসি যা মায়ার ছলনায় রন্ধ্রে রন্ধ্রে পূর্ণ। জয় থমকে দাঁড়িয়ে থাকল, এ হাসির মায়া তার কম জানা নেই, তাই খুব বেশি পুলকিত হতে পারল না কিন্তু সুচরিতা খুশিতে ভাসল। এত কর্মব্যস্ততার মধ্যে তার মতো একজন নতুনের প্রতি সমান নজর দেওয়ার ক্ষেত্রে সুবিমল সুচরির চোখে মডেল হয়ে উঠলেন।
নাসিরুদ্দিন উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আর সময় নষ্ট করা যাবে না সুবিমল, কাকদ্বীপ ঘুরে কলকাতায় ফিরতে হবে। এলাকায় এসেছি যখন, দেখা করে না গেলে বৈষম্যের প্রশ্ন উঠবে। এমনিতেই ওরা জানে, আমি তোমার প্রতি একটু বেশি দুর্বল।
সুবিমল হেসে বললেন, পরের রবিবার আবার দেখা হচ্ছে, সুচরিতাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, এই মেয়েটি এবছর কলেজ স্পোর্টস্এ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, এলাকায় খবু জনপ্রিয়, ওর কথা আগেও আপনাকে অবগত করেছি। মহিলা সংগঠনে যোগ দেওয়ার ফলে আমরা নতুন স্বস্তি অনুভব করতে পারছি। খুব needy family থেকে এসেছে, একটা চাকরি বাকরি দরকার, বিষয়টা নিয়ে একটু ভাবতে বলছি।
নাসিরুদ্দিন একটু হাসলেন, এক পলক সুচরিকে দেখে নিলেন, বুঝলেন,বেশ তন্বী মেয়ে। মুখের সংকেতে জয়ের হাতছানি রয়েছে কিন্তু চাকরির প্রসঙ্গ নিয়ে কোনও কথা বললেন না। ভালো করেই জানেন, প্রসঙ্গ বাড়ালে সুবিমলের কথা থামবে না, অনুরোধের আড়ালে দাবির পাহাড় তৈরির হিম্মত রয়েছে লোকটার মধ্যে। সুযোগ আদায় করে নেওয়ার অভিনব যাদুকর। শুধু বললেন, পরে দেখা হলে এ নিয়ে কথা হবে।
সুবিমলের মুখে মিষ্টি হাসি, জয়কে বললেন, দাদাকে অটোতে বসিয়ে দিয়ে আয়। সুচরিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, মন শক্ত করে সংগঠনের লেগে থাকতে পারলে সুযোগ পাওয়া নিয়ে ভাবতে হবে না। নিশ্চয় জয়ের কাছে জেনে ফেলেছ, নাসিরুদ্দিনদার রাজনৈতিক অবস্থান কত উপরে। জেলা সংগঠনের এক নম্বর মানুষ। নজরে থাকতে পারলেই হল।
সুচরিতার মুখে একচিলতে হাসি, মুহূর্তে পড়ে ফেলতে পারল সুবিমলের সাধু ইচ্ছার অক্ষরগুলো। অসীম বোধশক্তি আছে বলেই সব রকম অবস্থান মানিয়ে নিয়ে একাই একশো হয়ে উঠতে পেরেছেন।
সুবিমল আবার বলতে শুরু করলেন, অতীতের খারাপ স্মৃতিগুলো ভুলে যাও সুচরিতা। জীবনকে সচল করে রাখতে গেলে প্রদীপের মতো নষ্ট ছেলেকে মনে রাখলে চলবে না। আলোচনায় বসে খুব চেষ্টা নিয়েছিলাম ওর সম্মানটুকু ধরে রাখতে কিন্তু হাতেনাতে ধরা পড়ার ফলে এত কিছু ঘটে গেল। আমার কিছুই করার ছিল না। এখন থেকে তোমাকে আরও সাবধান হয়ে চলতে হবে। চোরের ভয়ে দুবেলা কলাপাতায় ভাত খাবে, এটা কোনো বিধি হতে পারে না, বরং চেষ্টা নিতে হবে, চোর যাতে বাড়িতে ঢুকতে না পারে, সেই ব্যবস্থা করার। সংগঠন সঙ্গে থাকলে একা একা এ নিয়ে ভাবতেই হবে না। সকলের অনুভব যুক্ত হয়ে তোমার পাশে থাকবে। আমার উপর একটু ভরসা রাখো, দেখবে কোনো অশুভ শক্তি তোমাকে ছুঁতেই পারবে না। পরের সপ্তাহে লক্ষ্মীকান্তপুরে মহিলা সংগঠনের বর্ধিত সভা, যেতে পারবে কী?
সুচরিতা মাথা নেড়ে সদর্থক সম্মতি দিল।
তাহলে দিনক্ষণ জয়ের মাধ্যমে জানিয়ে দেব। মথুরাপুর স্টেশন পর্যন্ত এলে একসঙ্গে ট্রেনে যাব। তোমার কাছে আরেকটা প্রসঙ্গ জেনে নিই, সংগঠনে কাজ করা নিয়ে তোমার মায়ের সম্মতি নিয়েছ কী?
মায়ের সম্মতি আছে বলেই তো…।
বেশ বেশ, আর বলতে হবে না, সুবিমল সাইকেলে উঠে বসলেন। বাড়িতে ফিরে গিয়ে দেখলেন, রঘু বারান্দার একধারে মন খারাপ করে বসে রয়েছে। নতুন কোনো খারাপ খবরে ভয় পেল নাতো? টেনে টেনে বললেন, এত মন খরাপ করে বসে আছিস যে? তোর দাদাকে চিনতে পারলি নে?
রঘু মুখ তুলে তাকালো।
সুবিমল হুকুমের স্বরে বললেন, ওই চেয়ারটা টেনে নিয়ে আমার পাশে এসে বস। একটা প্রসঙ্গ সব সময় মনে রাখবি, ওরকম অনেক ওসিকে আমি ট্যাকে গুঁজে রাখতে পারি।
রঘু কোনও উত্তর দিল না।
জয়ন্ত দেবনাথকে দেখে ভয় পাচ্ছিস?
রঘু সদর্থক মাড়া নাড়ল।
কোথায় চাকরি করে জানিস?
শুনেছি কোলকাতায়।
ট্রেনে যাতায়াত?
সেটাই স্বাভাবিক।
সকালে কোন্ ট্রেনে যান?
আটটার দিকে বাড়ি থেকে বের হন।
মানে আটটা পঁয়তাল্লিশের ট্রেন ধরেন।
ফেরেন কী সন্ধের পরে?
অনেক দিন নটার দিকে বাড়িতে ফিরতে দেখেছি। রবিবারও তো কলকাতায় যান।
সে কী রে? প্রত্যেক রবিবার?
আমার তাই জানা আছে। একটু বেশি রাতে ফেরেন।
নটার পরে?
রঘু সদর্থক মাথা নাড়ল। সুবিমলের দুঠোঁটের ফাঁকে এক চিলতে হাসি, সিগারে সুখটান দিতে শুরু করলেন, রঘু চেয়ে থাকল তাঁর মুখের দিকে, বুঝতে পারল না, কী কারণে হঠাৎ এমন চনমনে হয়ে উঠলেন। সিগারে ধোঁয়া টানা শেষ করে সুবিমল গম্ভীর হয়ে বললেন, কেল্টে ভোল্টে তোর সঙ্গে আছে তো?
ওরা আর যাবে কোথায়? ঘোষাল পাড়ার মেয়েকে বউ করতে পেরেছি বলেই সকলে খুব খুশি।
এ অবস্থান বজায় থাকলে তোর বুক থেকে ভয়ের পাষাণ খুব তাড়াতাড়ি নামিয়ে দেব।
রঘু কেমন যেন হতচকিত হয়ে চেয়ে থাকল সুবিমলের দিকে। তাৎপর্যের ধোঁয়াশা বার বার ছ্যাঁকা দিতে থাকল, সুবিমল ঠিক কী বলতে চাচ্ছেন, তা মাথায় এল না যদিও সুবিমল মনের অভিনব আতিশয্যে ভেসে যেতে থাকলেন, একটা সূক্ষ্ম অঙ্কের ফলাফল তাঁর মাথার ভিতরে। রঘুকে সামনে রেখে এগোতে পারলে খটিরবাজার এলাকায় নিজের প্রভাব প্রতিপত্তি যে ইচ্ছেমতো বাড়িয়ে নেওয়া সম্ভব, তা নিয়ে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হলেন। রঘুকে গা-ঘেঁষে বসতে বলে চাপা স্বরে নতুন কথা শুরু করলেন। সুবিমল তখন অন্য মানুষ, ভয়ানক সিরিয়াস। রঘুও পাল্লা দিয়ে গিলছে সুবিমলের গোপন মন্ত্র কিন্তু কিছুতেই তার আত্মিক চেতনার গভীর থেকে একটা অচেনা ভয় দূর হতে চাচ্ছে না।
সুবিমল রঘুর বাম বাহুতে নাড়া দিয়ে বললেন, তোর ভয় দূর করার স্থায়ী ব্যবস্থা করে ফেলেছি রে। মনে রাখিস, ওস্তাদের মার শেষ রাতে। তুই এখন আমার প্রিয় সঙ্গী, দাদা বলে ডাকিস; তোর নিরাপত্তা নিয়ে, সুখ স্বাচ্ছন্দ নিয়ে, পারিবারিক জীবন নিয়ে আমাকে ভাবতেই হবে। এ সূত্র কিছুতেই অস্বীকার করা চলে না। ওরে নেতৃত্ব এমনিই দায়বদ্ধতায় ভরপুর।
রঘু মুখ তুলে তাকালো সুবিমলের দিকে। রঘুর কাঁধে হাত রেখে আবার সুবিমলের কথার ঝাঁকুনি, ভাবার মতো নতুন কোনো অবস্থান তৈরি হয় নি রে।
রঘু চুপ করে থাকল, বিপদের ভাবনা তার সারা মাথা জুড়ে। ভালো করেই জানে, এসব কাজে কিছুতেই মিস করতে নেই। রিস্ক বাড়িয়ে না চলতে পারলে তাদের জীবন যে কোনো সময় থমকে যেতে পারে। সাহস থাকলে সামনাসামনি লড়ে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করো নতুবা আত্মসমর্পন করে পরাজয়ের খাদে হারিয়ে যেতে হবে সময়ের বিড়ম্বনা মাথায় নিয়ে। একটা ঘটনা শেষ হতে না হতেই আরেকটা নতুন ঘটনা এসে রঘুদের জীবনকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে, ফলত শুধুমাত্র দেহের মানুষ হয়ে রঘুদেরকে সমাজ কলেবরে বেঁচে থাকতে হয়। নেতৃত্বের কূটনীতি নির্ভর তাদের জীবন। সুখ শান্তি অগ্রগতি, সবেতেই সেই কূটনীতির নির্ভরতা, ফলে নিজস্ব নেতৃত্বলাভ তাদের জীবনে স্বপ্ন ছাড়া কিছুই নয়। নেতৃত্ব যে নিটোল মানসিক প্রয়াস, রঘুরা সেটাই বোঝে না, যখন বুঝতে পারে তখন আর সামনে চলার পথ থাকে না। রঘু সেটাই বুঝতে পেরেছিল, নাহলে তাকে দেবনাথের পরে সুবিমলের কাছে এভাবে আত্মসমর্পন করতে হত না।
সুবিমল বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে অতীত স্মৃতিচারণে ডুবে থাকলেন। রঘুর মতো ছেলেকে সংগঠনে ধরে রাখতে গেলে এ্যাকশানে ফেলে রেখে একটার পর একটা ইস্যু মেলে ধরতে হবে। গত বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে এই রঘু তাঁর বিরুদ্ধে কী ভীষণ ভূমিকা নিয়েছিল, সেই ছবি ভেসে উঠছে দুচোখের সামনে। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক জীবনে সেদিন প্রথম সুবিমল মৃত্যুভয়ের মুখোমুখি হতে বাধ্য হয়েছিলেন, রঘুর হাতে সম্পর্ণূ নিয়ন্ত্রণ চলে গিয়েছিল। দেহজ রঘুদের জীবনব্রত এমনিই, পক্ষে থাকলে জীবন দেওয়ার জন্যে প্রস্তুত হয়ে থাকে, বিপক্ষে থাকলে জীবন নেওয়ার জন্যেই। সূক্ষ্ম কৌশলে রঘুদের কাজে লাগিয়ে সব নেতৃত্ব সুন্দরবনে চেষ্টা করেন নিজস্ব প্রভাব প্রতিপত্তি ধরে রাখতে।
সুবিমল আড়াচোখে চেয়ে থাকলেন আকাশের দিকে। আবার অতীত স্মৃতি গুমোট হয়ে দুচোখের সামনে এসে ভিড় করল। জষ্ঠি মাসের দুপুর থেকে সেদিন সারা আকাশ মেঘে ঢেকে ছিল, আগাম অনুমানে অনেকেই ভেবেছিল, সন্ধের সময় কালবৈশাখী দেখা দিতে পারে। ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে শুরু করলেন সুবিমল, ভেবে নিলেন, সন্ধের পরে আরেকবার শেষ চেষ্টা নিয়ে দেখবেন। রাজনীতি সম্ভাবনার শিল্প যাতে যে কোনো সময় যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ যুক্ত হয়ে যেতে পারে। খটিরবাজারের চারপাশে জয়ন্ত দেবনাথের পকেটে ঢুকে থাকা ভোটগুলো তখনও তিনি নিজের অনুকূলে টেনে আনতে পারেননি। প্রচণ্ড রিস্কের হলেও রঘুকে জানতে না দিয়ে সন্ধের পরে তার পাড়াতে ঢোকার জন্যে মনস্থির করে ফেললেন। অটো থেকে খটিরবাজার মোড়ে নামবার পরে দেখলেন, রঘু পাশের মিষ্টি দোকানের ভিতরে বসে আছে। বুকটা একবার কেঁপে উঠল। তবুও ভাবলেন, রঘু নিশ্চয় তাঁকে দেখতে পায়নি। সেই সুযোগে পাড়ায় ঢুকে লোকজনদের সঙ্গে মন খুলে কথা বলার জন্য মুখিয়ে থাকলেন। ঘুটঘুটে অন্ধকার ঠেলে হনহনিয়ে এগিয়ে চলেছেন। হাতে দু-ব্যাটারী-টর্চ। একটানা সুইচ অন করে দ্রুত পায়ে সামনের পাড়াতে গিয়ে ঢুকলেন, কাহার আর ঢালিদের বসবাস, কিছু রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষও রয়েছে।
মিষ্টির দোকানে বসে রঘুর মনে সন্দেহের দোলাচল সূঁচ হয়ে বিঁধল, সন্ধের পরে সুবিমলবাবু এখানে কেন? কদিন পরে নির্বাচন, ভোটারদের মন সেট হয়ে গেছে। তারপরেও কান ভাঙানোর মতলবে এলেন না তো? আম-মানুষকে কাছে টানার যাদু রয়েছে লোকটার মধ্যে, যে কোনো সময় তা সম্ভব করে তুলতে পারেন। এমন অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে তাঁর রাজনৈতিক জীবনে। কেল্টেকে পাঠিয়ে দিল জয়ন্ত দেবনাথকে ডেকে আনতে। মনের কোণে কালো সন্দেহ দীঘর্তর হয়ে উঠছে। দেবনাথের নির্দেশ পেলেই কাজে লেগে পড়তে পারবে, মাসলম্যানদের জীবনে আশীর্বাদের সমতুল্য জয়ন্ত দেবনাথ সব শুনে এক পলক সময় নষ্ট না করে মিষ্টি দোকানের সামনে এসে উপস্থিত হলেন, রঘুর মুখে দীর্ঘ প্রশ্ন চিহ্ন, চাপা হুঙ্কারে বললেন, এসব ব্যাপারে আমার পরামর্শ লাগে নাকি? কোনো সংকোচ না করে প্রয়োজন হলে চালিয়ে দিবি, তারপর যা করার আমিই করব। কদিন পরে নির্বাচন, সেট হয়ে যাওয়া মনের উপর ভাগ বসাতে এসেছেন, ব্যাটা শকুনের চেয়েও অধম, ভোটের বাজারে আস্ত সর্বভুক শেয়াল।
রঘু আর অপেক্ষা করল না। এটুকু শোনার জন্যেই অপেক্ষায় ছিল। পাড়াতে ঢুকে দেখল, তার পাশের বাড়িতে খুড়তুতো কাকার সঙ্গে সুবিমল চাপাস্বরে কী সব বলছেন। কান খাড়া করে শুধু শুনতে পেল, জয়ন্তের উপর নির্ভর করে থাকলে মস্ত বড়ো ভুল করবে, কোনো উপকারে আসার ক্ষমতা নেই ওর, শুধু কথার ঢেঁকি, কাজে অষ্টরম্ভা। রঘু কেন যে ওকে মদত দেয়, তা বুঝি নে বাপু। কাকার ক্ষতির দিকটা আগেই ভাইপোকে বুঝতে হবে। সেই আক্কেলটুকুও ওর নেই কেন?
আড়ালে দাঁড়িয়ে রঘু কাঁপতে শুরু করল। তার ডেরাতে দাঁড়িয়ে তার বাহুবলকে এভাবে অস্বীকার করতে চাচ্ছে? এত বড়ো স্পর্ধা? রঘুর শরীর আর সহে নিতে পারছে না, সোজা সুবিমলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো, দুচোখ লাল টকটকে, মুখে রাগত তড়পানি, এখানে এসেছেন কেন?
প্রচারে আসার অধিকার সবার রয়েছে, তুমিও চাইলে আমার এলাকায় যেতে পারো। এটাই এ দেশের গণতন্ত্র, তুমি বলবে তোমার কথা, আমি বলব আমার কথা।
খেঁকিয়ে উঠল রঘু, আমার এলাকায় এসে কাউকে কোনো কথা বলতে দেব না।
তাহলে দেশের গণতন্ত্র মানো না?
একদম কথা বাড়াবেন না…. রাগে কাঁপতে কাঁপতে রঘু ছুটে গিয়ে ঢুকল নিজের বাড়িতে, খুব বেশি দেরিও করল না। ফিরে এল প্রমাণ সাইজ রামদা হাতে নিয়ে। লাফাতে লাগল সুবিমলকে আক্রমণ করার জন্যে। —কাকা, কোথায় গেলে তুমি?
রঘুর কাকা সিধু তখন সুবিমলের হাত ধরে বাড়ির পিছনে অন্ধকার গলিপথ ধরে এগিয়ে চলেছে। লোকটাকে যে কোনো মূল্যে প্রাণে বাঁচতে হবে। গত বছর ছেলের অসুস্থতার কথা শুনে সুবিমলবাবু নিজেই দেখতে এসেছিলেন, নীলরতন হাসপাতালে ভর্তি করানোর সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। সেই ঋণ মনে আছে সিধুর। পঞ্চায়েত সমিতি থেকে ছেলের জন্য দশ হাজার টাকা অনুদানও করে দিয়েছিলেন। ভাইপো রঘুকে সে ভালো করেই চেনে, তখনও রঘুর ভারী কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে কানে— ওকে আজ দুটুকরো না করে ছাড়ব না কাকা।
সিধু গ্রামের শেষপ্রান্তে এসে সুবিমলকে বলল, এক্ষুণি অন্ধকার মাঠে নেমে পড়ুন, তাহলে রঘু আর আপনাকে খুঁজে পাবে না।
এভাবেই সেদিন প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন সুবিমল রায়। সেই রঘু এখন তাঁর হাতের মুঠোয়, হুকুমের চাকরে পরিণত হয়েছে। উঠতে বললেই উঠে দাঁড়ায়, বসতে বললেই বসে পড়ে। সময়ের টানে সম্ভাবনার শিল্প তাঁর হাতেই চলে এসেছে। তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করে সমগ্র খটিরবাজার এলাকাকে গিলে ফেলতে হবে। যে জনগোষ্ঠীগত সমস্যা নিয়ে রঘু তার বিরুদ্ধে গলা ফাটাতো, সেই রঘুকে কাজে লাগিয়ে আগের সব দেওয়াল ভেঙে গুড়িয়ে দিতে হবে। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার কারুকার্যে সুবিমল এতদিনে প্রকৃত মাষ্টার মাইন্ড হয়ে উঠতে পেরেছেন। ভাটার মন্দ স্রোত পার হয়ে এখন তাকে দুর্বার জোয়ারের টানে সামনে চলতেই হবে। একটু হাসলেন আনমনে, ভাবলেন, এ গতি রোধ করার ক্ষমতা কারুর নেই। কদিন পরে রঘুর পাড়াতে লোকজনদের নিয়ে একটা গোপন বৈঠক করতে হবে, রঘুকে দিয়ে বলিয়ে নিতে হবে, তাঁর প্রতি আগের খারাপ ব্যবহারের জন্যে সে ভীষণ অনুতপ্ত। তাতেই চোদ্দ আনা কাজ হয়ে যাবে। এভাবেই এক ঢিলে দুই পাখি মারার জন্যে সুবিমল মনে মনে শিকারী গাংচিল হয়ে উঠলেন।

চলবে…

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

বিষয়:
এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
লেখক: মুসা আলি
শিক্ষক জীবনের ৫৫ বছরে এসে সাহিত্যচর্চা শুরু। ইতিমধ্যে পঞ্চাশের বেশি উপন্যাসের মনসবদার। গল্প উপন্যাস লেখার ক্ষেত্রে দীর্ঘ জীবন পরিক্রমায় কঠোর বিশ্বাসী। এখন বিদগ্ধ পাঠক শুধুমাত্র কাহিনি বা চরিত্র খোঁজেন না বরং তার ভিতরে লেখক এর নিজস্ব গভীর মনন আবিষ্কার করতে চান। ঔপন্যাসিক মুসা আলি দীর্ঘ জীবন পরিক্রমার জাদুতে তার নিজস্ব মনন দিয়ে বাঙালি পাঠককে ঋদ্ধ ও সমৃদ্ধ করে তুলতে বদ্ধপরিকর।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!