Discourse was deemed man’s noblest attribute,
And written words the glory of his hand,
Then followed printing with enlarged command
For thought–dominion vast and absolute
For spreading truth and making love expand.
William Wordsworth
মানব সভ্যতার ইতিহাসের ক্রমবিবর্তনে কৃষি, শিল্প, সাহিত্য সংস্কৃতির সঙ্গে মুদ্রণ শিল্পের একান্ত সম্পর্ক। আগে সেসব চিন্তাভাবনা, কৃৎকৌশল ছিল ভঙ্গুর, জরাজীর্ণ পুঁথির পাতায় বা আচার্য ও ধর্মীয় নেতাদের চিন্তাভাবনার আদান প্রদানের মৌখিক স্তরে। ফলে তাদের প্রচার ও প্রসার ছিল সীমায়িত। কখনো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দুষ্প্রাপ্য, কেননা অনেকেই সেসব ব্যক্তিগত সম্পত্তি হস্তান্তর করতে চাইতো না। শ্রদ্ধেয় দীনেশ চন্দ্র সেন তাঁর কালজয়ী গ্রন্থ ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ রচনার ক্ষেত্রেও এরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলেন। বিভিন্ন তথ্য আহরণের জন্য পুঁথির অন্বেষণে ত্রিপুরা, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গ্রীষ্মের খররৌদ্রে ঘুরে বেড়িয়েছেন কখনো পদব্রজে, কখনো হস্তীপৃষ্ঠে। অনেকেই প্রয়োজনীয় পুঁথিপত্তর দিতে চান নি। অনেকে আবার রাজরোষের ভয়ে তাঁকে নিরাশ করেছেন। কাজেই প্রয়োজনের তাগিদে এবং সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রয়োজন হয়ে পড়ল মুদ্রিত পুস্তকের। ‘For spreading truth making love expand’ এবং সেটা হতে হতে হবে ‘with enlarged command.’
মুদ্রণের জন্য আবশ্যিক প্রয়োজন কাগজের। এবং তা আবিষ্কৃত হয় খিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় দশকে চীন দেশে। এরপর মুদ্রণ। যাত্রা শুরু হয় কাঠ খোদাই করে। একটি কাষ্ঠখণ্ডের ওপর লেখা ছবি বা লেখা কুঁদে তাতে কালি মাখিয়ে ‘রোলার’ দিয়ে ঘষে ঘষে কাগজের ওপর ছাপা হত। এইভাবে বিশ্বের প্রথম পুস্তকটি মুদ্রিত হয় ৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে তাং রাজাদের আমলে। এ যেন ‘অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো।’ ক্রমে এই পদ্ধতি ছড়িয়ে পড়ে- চীন থেকে জাপান হয়ে কোরিয়ায়। সেখান থেকে তিব্বত ও নেপালে। ইতোমধ্যে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে… মাটির হরফ থেকে ধাতুজ হরফ তৈরির প্রচেষ্টা। আরেক পথ ধরে এই অধিগত বিদ্যা প্রসারিত হয় গ্রিসে, স্পেনে এবং ইওরোপের অন্যান্য দেশে। নিঃশব্দ বিপ্লব। পেশায় স্বর্ণকার এক জার্মান তনয় গুটেনবার্গ তাঁর আবিষ্কৃত মুদ্রণ যন্ত্রে ১৪৫৪-৫৫ সালে বাবেল বাইবেল ছাপান। মুদ্রণ শিল্পের ইতিহাসে এক বিস্ময়কর মাইল ফলক। বিচল হরফের ফলে ছাপার কাজ অনেক সহজ হয়ে গেল। মুদ্রিত পুস্তকের দামও গেল কমে। হরফ বিবর্তিত হতে হতে অন্যান্য পশ্চিমী দেশে ছাপাখানার প্রসার হল।
পশ্চিম থেকে এবারপুবে। গুটেনবার্গের বাইবেল প্রকাশের প্রায় একশো বছর পরে ১৫৫৬ থেকে ১৬৭৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মোট ৩৪টি পুস্তক মুদ্রিত হয় গোয়ায়। গোয়ার পরে বোম্বাই (এখন মুম্বাই) সেটা ১৬৭৪ সালের কথা। ১৭১৬ সালে মাদ্রাজে (এখন চেন্নাই) কাগজের কল এবং হরফ ঢালাইয়ের কারখানা স্থাপিত হলেও মাত্র একটি প্রার্থনা সঙ্গীত এবং তামিল ইংরেজি অভিধান প্রকাশিত হয়। এবার কুইলন। ১৫৭৮এ কুইলনের ছাপাখানা থেকে প্রথম কোন ভারতীয় ভাষায় মালয়ালাম হরফে ‘utrina christa’র অনুবাদ প্রকাশিত হল। কুইলন থেকে বঙ্গপ্রদেশে মুদ্রণশিল্পের পরিভ্রমণে লেগে যায় দুশো বছর। পরবর্তী আলোচনায় যাওয়ার আগে বরং ভারতে কোম্পানি শাসনের অবস্থানটা একটু পর্যালোচনা করা যাক। তাতে করে এদেশে ধর্মপ্রচারক পাদ্রিদের অবস্থান তথা সামাজিক ও প্রশাসনিক গ্রহণযোগ্যতা সম্যক উপলব্ধির সহায়ক হবে। ইতিহাসের সরণি বেয়ে সেজন্য একটু পিছন ফিরে তাকানো যাক।
১৭৫৭ সালে পলাশি বিজয়ের পর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বণিকের মানদন্ড ছেড়ে ক্রমশ রাজ্যবিস্তারে মনোনিবেশ করে, কিন্তু রাজ্য শাসনের ঝামেলায় যেতে চায় নি। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানি ভারত সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করে। রাজস্ব আদায়ের অপ্রিয় কাজটি অর্পিত হল লাটাইয়ের সুতোয় বাঁধা নবাবের হাতে। অদ্ভুত এক দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা। নবাবের রাজস্ব আদায়কারীরা ছিল অযোগ্য ও অর্থলোলুপ এবং চরম নৈরাজ্যময়। এর ফলে শাসন ব্যবস্থায়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নানা বিপর্যয় ঘনীভূত হয়ে ওঠে। এই ব্যবস্থা অবসানের জন্য কোম্পানি ১৭৭২ সালে ওয়ারেন হেস্টিংসকে পাঠাল গভর্নর হিসেবে। পরে ১৭৭৩ সালে ‘Regulation Act’ অনুযায়ী হেস্টিংসকে ‘গভর্নর জেনারেল’ পদে নিয়োগ করা হয়।প্রথম প্রয়োজন ছিল শাসকের প্রতি শাসিতদের আস্থা অর্জন। সেজন্য দরকার ছিল এদেশীয় অধিবাসীদের সামাজিক রীতি- নীতি,ভাষা, ধর্ম, ইতিহাস বিষয়ে সম্যক উপলব্ধির। হেস্টিংস এসব বিষয়ে কিছু সদর্থক পদক্ষেপ নিতে সচেষ্ট হন। সেসব প্রসঙ্গ পাশ কাটিয়ে আমরা পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের পথে এগিয়ে যেতে পারি।
তখন বিলেত থেকে যারা ভারতে আসতো তাদেরকে মোটামুটি তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। একদল এল সেনাবাহিনী বা অন্য প্রশাসনিক কাজে অন্নচিন্তায়।দ্বিতীয় শ্রেণির আগমন ব্যবসাবাণিজ্য প্রসারের ফলে কম সময়ে প্রচুর অর্থ উপার্জনের লালসায়। তৃতীয় শ্রেণিভূক্ত দলটির আগমন এদেশে প্রভু যিশুর বাণীপ্রচার এবং খ্রিস্টধর্মে অবিশ্বাসী মানুষদের খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত করার জন্য। এছাড়াও স্বল্প সংখ্যক ব্যক্তি আসতেন প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য সংস্কৃতিতে আকৃষ্ট হয়ে ভারত ও প্রাচ্য বিদ্যাচর্চায় মনোনিবেশ করতে। তৃতীয় দলের কাছে প্রয়োজন হয়ে পড়ল প্রভু যিশুর বাণী ও পবিত্র বাইবেলের বাংলা অনুবাদ। খ্রিস্টান হলেও শাসকগোষ্ঠী কিন্তু এঁদের খুব একটা সুনজরে দেখতো না। কারণটা অবশ্যই প্রশাসনিক। শাসকরা চাইতেন তাঁদের স্বার্থে স্থানীয় মানুষের সহযোগিতা। সেজন্য তাদের রীতিনীতি, সামাজিক অবস্থিতি এবং প্রচল আইনকে মান্যতা দিতে সচেষ্ট ছিলেন।
এখন ইতিহাসের অন্বেষণে সাহেবদের দেশ থেকে ঘুরে এলে কেমন হয়। যে উইলিয়াম কেরি শ্রীরামপুর মিশন ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা এবং অন্যবিধ জনহিতকর কর্মকান্ডের সঙ্গে শ্বাস প্রশ্বাসের মতো জড়িত ছিলেন তিনি কে? তাঁর পশ্চাৎপটই বা কি? ইংল্যান্ডের নর্দাম্পটনশায়ার। সেখানে আছে টাউসেন্টার কাউন্টি। মাইল তিনেক দূরে এক অখ্যাত গ্রামে কেরির জন্ম ১৭৬১ সালের ১৭ আগস্ট। দরিদ্র পিতার সন্তান। অল্পবয়সেই পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে প্রথমে চাষবাস এবং পরে জুতো সেলাইয়ের কাজ শিখতে হয়। ১৭৮৩র ৫ অক্টোবর ব্যাপটিস্ট মন্ত্রে তাঁর দীক্ষালাভ। ১৭৮৯ সালে কেরির আত্মপ্রকাশ ধর্মযাজক রূপে লেস্টারে। পাশাপাশি জুতো সেলাই ও শিক্ষকতা। ‘An Enquiry’ নামক এক পুস্তিকায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে খ্রিস্টধর্ম প্রচারে সংঘ গড়ে তোলার আবেদন করেন তিনি।
অনেক আলোচনা তর্কবিতর্কের পর বিদেশে ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে ১৭৯২ সালের ২ অক্টোবর প্রতিষ্ঠিত হল ‘ব্যাপ্টিস্ট মিশনারি সোসাইটি।’ বিভিন্ন বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে বিশিষ্ট চিকিৎসক ও প্রচারক রেভারেন্ড জন টমাসকে নিয়ে এক দিনেমার জাহাজে ১৭৯৩ সালের ১৩ জুন বাংলার উদ্দেশে পাড়ি জমান কেরি। ১১ নভেম্বর কলকাতায় পদার্পণ। জাহাজেই টমাসের সহযোগিতায় বাংলা ভাষার চর্চায় মনোনিবেশ করেন। জাহাজঘাটায় পরিচয় ঘটে রামরাম বসুর সঙ্গে। তাঁকে মুন্সি হিসেবে নিযুক্ত করেন কেরি এবং তাঁর কাছেও বাংলা ভাষার নিবিড় অনুশীলন শুরু করেন।
কলকাতায় এবং দক্ষিণ বঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় বাসা বদল করেও কোথাও থিতু হতে পারেন নি কেরি। অবশেষে মালদা জেলায় মদনাবাটিতে এক নীলকুঠিতে তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত হন। দুর্ভাগ্য বশত ১৭৯৮ সালে মালিক উডনি নীলকুঠিটি বন্ধ করে দেন। আবার অনিশ্চয়তা। সঙ্গী শুধু উডনি প্রদত্ত একটি মুদ্রণ যন্ত্র আর অধীত বিদ্যা এবং বাংলায় অনু্বাদিত বাইবেলের পাণ্ডলিপি। ইতোমধ্যে বিলেত থেকে জসুয়া মার্শম্যান, উইলিয়াম ওয়ার্ড, ব্রান্সডন, উইলিয়াম গ্রান্ট-এই চার জন ব্যাপ্টিস্ট মিশনারি শ্রীরামপুরে পদার্পণ করেন। কেরিও খিদিরপুরের সাময়িক নিবাস গুটিয়ে শ্রীরামপুরে গমন করেন। সময়টা ১৮০০ সালের ১০ জানুয়ারি। শুরু হয় তাঁর বৃহত্তর এবং অর্থবহ কর্মজীবন। ১১ জানুয়ারি এক ভাড়াবাড়িতে মিশনের যাত্রা শুরু।
ইতঃপূর্বে ১৭৭৮ সালে প্রকাশিত হয়েছে হলহেডের ‘এ গ্রামার অব দ্য বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ’ হুগলি থেকে। পথপ্রদর্শক ও নিবিড় সহযোগী এক ইংরেজ রাজপুরুষ এবং প্রাচ্যবিদ চার্লস উইলকিনস। সঙ্গে ছিলেন আরো একজন। পঞ্চানন কর্মকার। তিনি হরফ শিল্পী। হলহেডের পুস্তক প্রকাশে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু হলহেড বা উইলকিনস কেউই তাঁর নামোল্লেখ করেন নি। বোধহয় ‘নেটিভ’ বলে রাজপুরুষেরা তাঁর প্রতি সৌজন্য প্রদর্শনের প্রয়োজন অনুভব করেন নি, যদিও প্রকৃ্ত অর্থে তিনি ছিলেন বাংলা হরফের জনক। মিশন কর্তৃপক্ষ রত্ন চিনতে ভুল করেন নি। কেরি ও তাঁর সহযোগীরা ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন, কিন্তু সমস্যায় পড়েছিলেন বাংলা হরফ নিয়ে। ইংল্যাণ্ড থেকে বাংলা হরফ নিয়ে আসা বা বই ছাপিয়ে আনার ব্যবস্থা করা সে এক বিষম ব্যয় ও সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। ১৭৯৯ সালে এপ্রিলে কেরি লিখছেন, ‘We have succeeded in procuring a sum of money sufficient to get types cast.I have found out a man who can cast them, the person who casts for company’s Press, and I have engaged a printer at Calcutta to superintend the casting. কেরি অনেক কষ্টে কোম্পানির চাকরি ছাড়িয়ে পঞ্চাননকে শ্রীরামপুরে আনিয়েছিলেন।
মার্শম্যানের পঞ্চানন সম্বন্ধে সশ্রদ্ধ উচ্চারণ: ‘He had so fully communicated his art to a number of others that they carry forward the work of type casting.and even of cutting the matrices with a degree of accuracy which would not disgrace European আরতিস্তস।’
পঞ্চাননের জামাতাও ছিলেন সমান সৌন্দর্য বিলাসী ও দক্ষ কারিগর। মার্শম্যান লিখছেন, ‘Bengal is indebted for the various founts of the Bengalee,Nagree,Persian,Arabic and other characters which have been gradually introduced in the different printing establishments.’
সরকারি ঢালাইখানার কর্মী শ্রীরামপুর মিশন ছাপাখানায় যোগ দিয়ে (১৮০৩ সাল নাগাদ) প্রথমে দেবনাগরী এবং পরে বাংলা অক্ষরের সাট তৈরি করেন। মিশনারিদের কাগজ ‘সত্য প্রদীপ’ এ তার সপ্রশংস উল্লেখ আছে। পঞ্চানন ছিলেন এদেশের হরফ শিল্পীদের আদি আচার্য। তাঁর পৈত্রিক নিবাস ছিল জিরাট বলাগড়ে… পরে কর্মসূত্রে ত্রিবেণীর অধিবাসী। পূর্বপুরুষেরা ছিলেন লিপিকর। সেই সুবাদে পরবর্তীকালে পরিচিত হলেন কর্মকার রূপে। পঞ্চাননের এই বৃত্তি তাঁকে এনে দিয়েছিল মুদ্রণশিল্পে পথিকৃতের সম্মাননা। কেরি-পঞ্চাননের যৌথ উদ্যোগে মিশন প্রেসে সঞ্চালিত হল নতুন নতুন চিন্তাধারা এবং নবপ্রযুক্তির জোয়ার। মিশন থেকে বাংলায় প্রকাশিত মৌলিক গ্রন্থ এবং অনুবাদ গ্রন্থগুলি এ সময়েই প্রকাশিত হয়। অপুত্রক পঞ্চাননের দেহাবসানে (১৮০৪) জামাতা মনোহর তাঁর আরব্ধ কর্মযজ্ঞ সুপরিকল্পিত ভাবে এগিয়ে নিয়ে যান। ১৮০০ খ্রিঃ থেকে ১৮৩৭ খ্রিঃ পর্যন্ত যে বিপুল কর্মপ্লাবন চলছিল তাতে ভগীরথের ভূমিকা পালন করেছিলেন পঞ্চানন ও তদীয় জামাতা। বাংলা গদ্যসাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধির ইতিহাসে এঁদের অবদানকে যথাযথ মর্যাদা দানে আমরা যেন কুন্ঠিত না হই।
১৮০০ সালের মার্চ মাসে পঞ্চাননের তত্ত্বাবধানে প্রতিষ্ঠিত হয় তৎকালীন এশিয়ার শ্রেষ্ঠ টাইপ ফাউণ্ড্রি। এ ব্যাপারে জামাতা মনোহর, দৌহিত্র কৃষ্ণচন্দ্র এবং অন্যান্য দেশজ কারিগরদের নিষ্ঠা ও দান অপরিসীম। হরফ নির্মাণ বিশেষজ্ঞ ট্যানবট বেইনস অকপটে স্বীকার করেছেন, ”the Baptist Mission of Serampore under the leadership of William Carey was very active in the early part of the nineteenth century. All these types were the work of the missionaries, with little or no technical help from England, the total represents a remarkable achievement in the history of type cutting.” (Johnson: History of the old English letter.) পঞ্চানন ও মনোহর এদেশীয় শিল্পীদের নীরবে হরফ নির্মাণ, মুদ্রণ, বাঁধাই ও বিন্যাসে দীক্ষিত করে এই বিরল কৃতিত্বের অংশীদার হয়েছিলেন।
ছাপাখানা যে শক্তি ও জ্ঞানের পরিবাহী, জনরুচির উৎকর্ষ বিধায়ক সেই বোধের উদ্দীপক ছিল শ্রীরামপুর মিশন প্রেস। বাইবেলের অনুবাদ দিয়ে শুরু হলেও মিশন প্রেস থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত ‘রামায়ণ’ ও ‘মহাভারত’ জনমানসে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল। কেরি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পর মিশন প্রেস সম্বন্ধে শাসকদের বিরূপতা হ্রাস পায় এবং কলেজের পাঠক্রম অনুসারী বেশ কিছু পুস্তক প্রকাশিত হয় মিশন প্রেস থেকে। অধ্যাপক ড। শিশির কুমার দাশের নিরীক্ষা অনুযায়ী প্রকাশিত গ্রন্থগুলিকে মূলত দু’টি ধারায় বিন্যস্ত করা যায়। একটি হল খ্রিষ্টধর্ম বিষয়ক এবং অন্যটি পুরোনো রচনার প্রকাশ ও নতুন পুস্তক প্রকাশ।
১৮০০ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর নাগাদ ফোর্ট উইলিয়ামের কাজ শুরু হয়। মূলত ইংরেজ রাজপুরুষদের বাংলা ও স্থানীয় ভাষা শিক্ষা, আইন ও স্থানীয় রীতিনীতির ব্যাপারে শিক্ষাদান করে দক্ষ প্রশাসক হিসেবে গড়ে তোলাই ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য। কেরি এই কলেজে যোগদান করেন ১৮০১ সালের ৪ মে বাংলার শিক্ষক হিসেবে। পরে মারাঠী ও সংস্কৃত ভাষার বিভাগীয় প্রধানও হয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে আরো আটজন পণ্ডিত যেমন মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকার, রামনাথ বাচস্পতি, কাশীনাথ তর্কালংকার, রামরাম বসু প্রমুখ যোগদান করেন।
শীরামপুর মিশন যে পুস্তকটি দিয়ে জয়যাত্রা শুরু করে তা হল কেরিকৃত নিউ টেস্টামেন্টের বাংলা অনুবাদ- ১৮ মার্চ ১৮০০ সাল। এটি মিশন ছাপাখানার পক্ষে গৌরবময় সূচনা হলেও বাঙালি মানসে তা খুব একটা রেখাপাত করতে পারে নি। এই শূন্যস্থানটি অচিরাৎ পূর্ণ হল যখন উক্ত ছাপাখান থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হল কৃত্তিবাসের রামায়ণ ১৮০৩ সালে (মতান্তরে ১৮০২ সালে)। একই বছরে প্রকাশ পায় কাশীরাম দাসকৃত মহাভারতের চার পর্ব। ঐ বছরই আগস্ট মাসে প্রকাশিত হয় ‘মঙ্গল সমাচার’ (মতীয়ের রচিত)। এটি বাংলা গদ্যসাহিত্যের প্রথম প্রকাশিত পুস্তক হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
বাংলা ভাষায় উপযুক্ত পাঠ্যপুস্তকের অভাব দূরীকরণে ১৮০১ সালে প্রকাশিত হয় ‘কেরির বাংলা ব্যাকরণ’ ও ‘কথোপকথন’। এবং ১৮১২ সালে ‘ইতিহাসমালা’ (সংকলন)। লোকায়ত জীবন সম্পর্কে কেরির গভীর সহানুভূতি ও জীবন বোধের পরিচায়ক সংলাপভিত্তিক ‘কথোপকথন’ গ্রন্থটি। এছাড়া প্রকাশিত হয় রামরাম বসুর ‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র'(১৮০১), মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকারের ‘বত্রিশ সিংহাসন’ (১৮০১),মহেন্দ্রনাথ দত্তের ‘গুরুদক্ষিণা’ প্রমুখ পুস্তক। ১৮০০ থেকে ১৮৩২ সময় সীমার মধ্যে মিশন ছাপাখানা থেকে চল্লিশটি ভাষায় ২,১২০০০টি পুস্তক মুদ্রিত হয়। এছাড়া ছিল দু’টি সংবাদপত্র প্রকাশের ব্যবস্থাপনা ১৮১৮ সালে ৩০ এপ্রিল আলোর মুখ দেখলো বাংলা ভাষার প্রথম সংবাদপত্র ‘দিগদর্শন’, রাজরোষের ভয়ে শেষ পৃষ্ঠায় ক্রোড়পত্রে কিছু নির্বিরোধী সংবাদ মুদ্রিত হত। বিভিন্ন পাতা জুড়ে থাকতো ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান ইত্যাদি জ্ঞানচর্চার বিষয়। এছাড়াও থাকতো বিদ্যালয় ছাত্রদের উপযোগী তথ্যাবলি। ভাষা সাবলীল। পাঠ্যপুস্তকের অভাব পূরণের জন্য স্কুলবুক সোসাইটি ১৮২১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ৬১২৫০ কপি দিগদর্শন কেনে বিদ্যালয় ছাত্রদের জন্য পুরস্কার বা উপহার হিসাবে ছাত্রদের মধ্যে বিতরণের জন্য। ইউনেস্কো বাংলাকে বিশ্বের মধুরতম ভাষা হিসেবে ঘোষণা করার অনেক আগেই কেরি মনে করতেন, ‘বাংলা ভাষা মাধুর্য ও প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর’।
দিগদর্শনের পর প্রকাশিত হয় ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকা। নির্ভীক সাংবাদিকতার জন্য পত্রিকাটি বেশ সমাদৃত হয়েছিল। বিশেষ করে গ্রাম বাংলায় পত্রিকাটি দারুণভাবে আদরণীয় হয়ে উঠেছিল। একটি গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা প্রকাশিত হত মিশন ছাপাখানা থেকে। সেটি ছিল ‘ফ্রেণ্ড অব ইণ্ডিয়া’ যেটি বর্তমান ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকার পূর্বসুরী। বিজ্ঞানচর্চা, সাহিত্যানুরাগ, সমাজচেতনার প্রসারে পত্রিকাগুলি তখনকার সমাজ ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল।
কেরি এসেছিলেন এদেশীয় অধিবাসীদের মধ্যে প্রভু যিশুর মাহাত্ম্য প্রচার করতে।কিন্তু বাংলা ভাষায় দীক্ষিত হয়ে এই ভাষার প্রভূত উন্নতি করে গেলেন তাঁর ব্যাপ্টিস্ট মিশন ও মিশন ছাপাখানার মাধ্যমে।পরবর্তীকালে বাংলায় নব জাগরণের শিখা তিনিই প্রজ্জ্বলিত করে গেছেন তাঁর সহযোগীদের সঙ্গে। ১৮৩৪ সালের ৯ জুন প্রভাত সূর্যের আগমন লগ্নে মহাপ্রস্থানের পথে যাত্রা করেন এই অনির্বাণ আলোকশিখা।