বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত দিয়ে এক লোক প্রতিদিন ভারত থেকে সাইকেলে করে এক বস্তা বালু নিয়ে বিজিবি’র সামনে দিয়ে চলে আসেন। প্রথম দিকে দু-একবার বিজিবি চেক করে দেখেছেন যে বস্তা বালু ভর্তি। তারপর থেকে বিজিবি আর লোকটাকে কিছু বলে না। লোকটা নিয়ম করেই প্রতিদিন এক বস্তা বালু ইন্ডিয়া থেকে নিয়ে আসেন সাইকেলে করে। এখন বিজিবি’র লোকেরা লোকটাকে দেখে একটু মুচকি হাসি দেন। লোকটাও একটা বোকা বোকা হাসি দিয়ে বালুর বস্তা বোঝাই সাইকেল নিয়ে চলে আসেন। একদিন বিজিবি’র এক লোক খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে লোকটার কাছে জানতে চাইলেন, আচ্ছা, তুমি প্রতিদিন এই বালু দিয়ে কি কর? আর ইন্ডিয়া থেকেই কেন বালু আনো? লোকটা সেই আগেই মতই, বোকা বোকা হাসি হেসে বলেন, আমি তো প্রতিদিন বালুর বস্তা চাপিয়ে ইন্ডিয়া থেকে সাইকেল নিয়ে আসি!
ঠিক একইভাবে আমাদের রাষ্ট্রপ্রধানকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, আচ্ছা আপনার মন্ত্রীসভার সদস্যরা, আপনার দলের সাংসদেরা এত যে বেফাস কথা বলেন, আপনি তাঁদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন না কেন? তিনি হয়ত প্রত্যুত্তরে বলবেন, সে তো আমিও বলি। আপনি সাহস করে মন্ত্রী আর সাংসদদের কথা বললেন, আমার কথাটা বলতে পারলেন না। তবে আপনার প্রশ্নটা যৌক্তিক। সেই জন্যই আমি উত্তরটাও ঠিকঠাকই দিতে চাই। আসলে আমি চাই ওরা এগুলি বলুক। তাতে করে যেটা হয়, সেটা হল দেশের মানুষ কিছুদিনের জন্য হলেও ওই বেফাঁস মন্তব্য নিয়েই মেতে থাকে। দেশের আসল সংকট নিয়ে কথা বলা কমে যায়, বন্ধ হয়ে যায়! এই অংশটুকু কাল্পনিক। কিন্তু সত্যিই কি এদেশের নাগরিক হিসাবে আপনাদের জানতে ইচ্ছে করে না যে, আমাদের করের টাকায় যাবতীয় সুযোগ সুবিধা ভোগ করে, দেশের সংকটকালীন, মানুষের জীবন-মরণ সংকটের সময়, এমনকি নাগরিকের জীবনহানির পরও নানা মন্তব্য করে এই দেশের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা কিভাবে স্বপদে বহাল থাকেন?
আমরা মুক্তিযুদ্ধের পরের প্রজন্ম। আমাদের সময়কালে আমরা একটা উদহারণও মনে করতে পারি না যে দেশের, দেশের মানুষের সংকট নিয়ে, জীবন-মরণ সমস্যা নিয়ে, দেশ এবং জাতির মর্যাদা নিয়ে এমনকি হত্যাকাণ্ড নিয়েও বেফাঁস মন্তব্য করা একজন মানুষের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। হোন তিনি মন্ত্রী, সাংসদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সচিব কিংবা পুলিশ। আমাদের না কোনো রাজনৈতিক দলে, না রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে এই সংস্কৃতিই গড়ে উঠেছে। বরং অনেক ক্ষেত্রেই দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা এইসব লাগামহীন, অসংবেদনশীল মন্তব্যের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। তাহলে কি আমরা ধরে নেব রাষ্ট্রপ্রধানকে নিয়ে আমরা যে কাল্পনিক গল্প ফেঁদেছি সেটা আসলে সত্যি। তা না হলে একটা সভ্য রাষ্ট্রে তো জনগণের কথিত সেবকদের জনগণকে নিয়ে এরকম মশকরা করে পার পেয়ে যাবার কথা নয়। তাই যদি না হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে আমরা আসলে আমাদের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিদের ভাষা বুঝতে অক্ষম। উনারা সঠিক সময়ে মোক্ষম কথাটা বলেছেন, আমরাই তার তাৎপর্য বুঝতে পারি নাই। কিন্তু এই ধরাধরির মধ্যে থাকলে তো আমরা আসল কারণটা জানতে পারব না, সত্যিটা জানতে পারব না।
চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াসকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আপনাকে যদি চীনের প্রধান করা হয়, আপনি প্রথমে কোন কাজটি করবেন? তিনি বলেছিলেন, আমি প্রথমে রাজনীতিবিদদেরকে শুদ্ধরূপে ভাষা শেখাব। যাতে তারা জনগণকে যা বলতে চাই, তা সঠিকভাবে বলতে পারেন, যে প্রতিশ্রুতি দেন তা যাতে যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে পারেন এবং জনগণ যাতে সঠিকভাবে সেগুলির জবাবদিহিতা চাইতে পারেন। তখন যাতে রাজনীতিবিদেরা কোনো ছলচাতুরীর আশ্রয় নিতে না পারেন। আমাদের দেশে শুধু রাজনীতিবিদ না, জনগণেরও শুদ্ধরূপে বাংলা ভাষা শিক্ষা জরুরী হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি আমাদের একজন মন্ত্রীর আমরা বেহেশতে আছি বক্তব্য নিয়ে সর্বমহলে যে হাস্যরসের সৃষ্টি হয়েছে, সেই রসের জোয়ারে জ্বালানি তেলের মুল্যবৃদ্ধির যে ক্ষোভ সেটা ভেসে যাচ্ছে। প্রথমত উনি বেহেশত বলতে কি বোঝাতে চেয়েছেন, সেটা নিশ্চয় চোখ-কান খোলা কোনো মানুষেরই বুঝতে না পারার কথা নয়। প্রশ্ন হল, উনি এমন একটা সময়ে কথাটা বললেছেন, সেইটা মানুষ নিতে পারেনি। কিন্তু আমরা একটু পেছন ফিরে তাকালে দেখতে পাব, উনার মুখে এরকম মন্তব্য নতুন নয়। এই উনিই ভারতের সাথে আমাদের সম্পর্ক বোঝাতে গিয়ে বলেছেন, আমাদের সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর মত। এখানে কে স্বামী আর কে স্ত্রী? এটা যে দেশের জন্য, গোটা জাতির জন্য যে কত অবমাননাকর, সেটা আমরা ভুলতেই বসেছি। নইলে এই ইস্যুতেই উনার পদত্যাগ দাবী করে দেশপ্রেমিক জনতার রাস্তায় মিছিল করার কথা ছিল। কই, আমরা তো সেভাবে রা ও করলাম না।
আসলে আমরা বাস করি বাংলাদেশে, কথা বলি বাংলায়। যদিও শুদ্ধ কিংবা আঞ্চলিক বাংলার শতভাগ শব্দ আমরা ব্যবহার করি তা বলা যাবে না। ইংরেজির সাথে সমানতালে বেড়েছে আরবি শব্দের ব্যবহার। ইদানীং কেমন আছেন জিজ্ঞাসার প্রত্যুত্তর শুনি, আলহামদুলিল্লাহ! কেমন আছ্ন এর আক্ষরিক উত্তর কি আলহামদুলিল্লাহ হতে পারে? যদি হয়, তাহলে তো আমরা বেহেশতে আছিতেও কোন দোষ দেখি না। দোষ হল, আমরা বেহেশতের যে স্বপ্ন দেখি, সেটার সাথে দেশের এই চিত্র মেলে না। কবি তো বলেছেন, কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক কে বলে তা বহুদুর, মানুষেরই মাঝে স্বর্গ নরক মানুষেতেই সুরাসুর। এই মাটির ভূমিকে স্বর্গে পরিণত করতে হলে সবার আগে, আমাদেরকে প্রশ্ন করতে শিখতে হবে। এমন প্রশ্ন, যে প্রশ্নের মুখোমুখি একবার হলে মন্ত্রী, সাংসদ, ভিসি, সচিব, পুলিশ তো বটেই, খোদ রাষ্ট্রপ্রধানও বেফাঁস মন্তব্য ভুলে যাবেন। সেই কাজটিই আমরা পারছি না বলেই, আজ দেশে এই অনাচারের মধ্যেও আমরা হাস্যরস করে সময় পার করছি এবং অনাচারীদেরকে সুযোগ করে দিচ্ছি, আয়েশী জীবন যাপনে। যতদিন না, আমরা সেই প্রশ্ন করতে শিখিছি, সেই প্রশ্ন করতে পারছি ততদিনই আমরা শুনতে থাকব, আল্লার মাল, আল্লায় নিয়ে গেছে। শুনতে থেকে দেশে খুন বেড়েছে কিন্তু অপরাধ কমেছে। শুনতে থাকব মিষ্টি কুমড়া দিয়ে বেগুনি বানানোর রেসিপি’র কথা। আর নিজেরাও বলতে থাকব, আলহামদুলিল্লাহ, বেহেশতে আছি!
প্রশ্ন করার আগে তো প্রশ্ন করার সুযোগ তৈরি করতে হবে। আপনি প্রশ্ন করলেই তো আপনাকে দেখে নেওয়া হবে। উত্তর তো অনেক পরের ব্যাপার।
সেই, যুক্তির যেখানে অভাব, অ-ভাবই তো মানুষের স্বভাবে পরিণত হয়!