মায়ের আঁচল
মায়ের যত্নে আঁকা নজর ফোঁটা,
কপালে চাঁদ হয়ে ভাসতো ছেলেবেলায়।
রোজ স্নানের পরে ভোরবেলার পূব আকাশ,
ধরা দিত মায়ের প্রশস্ত ললাট জুড়ে।
সেই আলো সীমন্তে প্রতিফলিত হয়ে আলোকিত করতো মুখমণ্ডল।
মায়ের শিখিয়ে দেওয়া প্রণাম মন্ত্র উচ্চারণ করতে গিয়ে,
ভেসে উঠতো মায়ের কপালের লাল সূর্য টা।
আর অনুভব করতাম ত্রিলোক ছুঁয়েছি।
বাবা শেষবারের মতো বাড়ি এসেছিল একটা বাক্সের ভেতর।
তখন বুঝিনি, আজ বুঝেছি কতটা গৌরবময় ছিলো সেই ফেরা!
আর সূর্য ওঠা ভোর দেখিনি মায়ের মুখে।
এখন কেবল শরতের শুভ্র পেঁজা মেঘ মায়ের আঁচল জুড়ে!
প্রতিক্ষা
আরো অনেকগুলো বছর পেরিয়ে যাবে
ঠিক এমনি ভাবেই ছুঁয়ে দেখার প্রতিক্ষায়।
ধীরে ধীরে বয়েস বাড়তে থাকবে সেই সব ইচ্ছেদের।
ছুঁয়ে দেখার কাল্পনিক মুহূর্তের গায়ে ধুলো জমতে জমতে একসময় চাপা পড়ে যাবে মাটির নীচে। আর ইতিহাস হয়ে ধরা দেবে পরের কোনো প্রজন্মের হাতে।
ঈদ শুভেচ্ছা
বড়ো বড়ো ইমারতের মাঝে,
এক চিলতে ঝুপড়িতে থাকে বুড়ো-বুড়ি।
সম্বল একে অপরের কম্পিত চারটি হাত।
উঁচু ইমারত ভেদ করে,
ওদের উঠোন স্পর্শ করার সাহস দেখায়নি
চাঁদ – সূর্য -গ্রহ নক্ষত্রেরা!
তাই ঈদের খুশি দোল দেয় না ওদের মনে।
রোশনাইয়ের আলোর মিছিলেও ওরা ব্রাত্য!
তবু আকাশ গায়ে নৌকো হয়ে ভেসে বেড়ানো,
একফালি ঈদের চাঁদ খুঁজে বেড়ায় ওদের ঝাপসা দৃষ্টি।
ওদের চারখানা কম্পিত হস্তে আরো দু’খানা জুড়ে দিয়ে,
দাঁড় করালাম আমার ছাওনিতে।
চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে
জ্বরায় ধরা দু’জোড়া চোখ।
নিচে ঠাকুর ঘরে শাঁখে ফুঁ পড়েছে,
মায়ের ঠোঁট ছুঁয়ে।
কবিতার স্কুল
আমার ইচ্ছে ছিল তোমাকে প্রেম শেখাবো।
কারখানার ইস্পাতগুলো বড্ড বেশি শক্ত করে দিয়েছে তোমায়।
তোমার হাতে হাত রাখলে অমসৃণ কংক্রিটের দেওয়াল ছুঁয়েছি মনে হয়।
কথা গুলোও কেমন ঝনঝনে আর বেসুরো।
আমার ভীষণ ইচ্ছে ছিল,
তোমায় একটু প্রেম শেখাই।
সন্ধের নরম আলোয় রবীন্দ্রনাথের গীতবিতান থেকে ধার নিয়ে,
তোমাকে দু’টো প্রেম পড়ে শোনাই।
ইচ্ছে ছিল জ্যোৎস্না ভরা রাতে যখন সবাই বনে যাবে,
হাসনুহেনার নুয়ে পড়া ডালটার নিচে তোমায় নিয়ে বসে,
তোমাকে প্রেম দিই আমার অঞ্জলি ভরে।
তোমার শক্ত খটখটে আবরণটা ঢেকে দিই,
আমার নরম ওম দিয়ে।
কিন্তু সেদিন আমি চমকে উঠলাম!
শক্ত খটখটে ‘তুমি’টার ভেতর এমন নরম নদীও আছে?
তোমার মনের কপাট খুলে দেখি থরে থরে সাজানো আছে কবিতা গ্রন্থ।
বুকের ভেতর একটা আস্ত কবিতার স্কুল!
যেখানে বসে অনায়াসে প্রেম শিখে নিতে পারে একজন অপ্রেমিকও।
আমিও ধীরে ধীরে শিখে নিতে থাকলাম ছন্দ-ছড়া আর প্রেম।
ইশাদী
(এক)
এমন রুদ্র বৈশাখেও কি নরম আর স্নিগ্ধ দেখাচ্ছিলো পাহাড়টাকে।
যেন কোনো শুভ মুহূর্তের সাক্ষী হতে
সদ্য স্নাত যাজক।
আগেই টের পেয়েছিল পাহাড়টা,
তাকে আজ ইশাদী হতে হবে কিছু দেওয়া নেওয়ার।
তাই নিজের সর্বাঙ্গ ঢেকে রেখেছিলো নির্জনতার চাদরে।
পরিনত আবরণের ভেতরে লুকিয়ে থাকা কিশোর কিশোরী,
হাঁটতে থাকে পিছন ফিরে।
নিশ্চুপ বিশ্রামাগার কোল পেতেছে,
উৎরাইয়ের পথে কয়েক মুহুর্তের ‘বিরতি ‘র জন্য।
দু’জোড়া পরিণত ঠোঁট খুঁজে পেয়েছে অনন্য সুধাভাণ্ডের।
পাহাড়ি মহুয়া আর ভাঁটফুলের শুভ্রতা স্বর্গীয় করে তুলেছে মুহূর্তের যাপন।
(দুই)
ক্ষণিকের বিরতি যুগিয়েছে উৎরাইয়ের ইন্ধন।
ঘেঁটে যাওয়া কপালের চাঁদ শুনতে পেলো,
পাহাড় চূড়ার আহ্বান।
অনেক আগেই দুটি হাতের তালুতে স্থান করে নিয়েছে কিছু প্রতিশ্রুতি।
তাই আজ আর তালু নয়,
মুঠোয় ধরা থাক ‘বিরতি’রা।
পাহাড়টা একা নেয়নি ইশাদী হওয়ার দায়।
ঈশ্বর সাক্ষ স্বর্গীয় বাসরে মহুয়ার নেশায় ভাঁটফুল আজ পরিণীতা।
উত্তরণের শেষ সীমানায় এসে একটা দু’টো করে,
খসে পড়তে চায় সোহাগ রেণু।
হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরা থাকে কিছু আলোক রশ্মি।
রাজকীয় অবতরণের পথে ইশাদী পাহাড়টা
ছড়িয়ে দিয়েছে শত-শত মহুয়া আর সুরভিত ভাঁটফুল।
পায়ে পায়ে গুনে নিতে থাকে একে অপরের
বুকের দোলন।
শেষ সিঁড়িতে পা রেখেছে ছেড়ে যাবার মুহূর্তরা!
তাই ঠোঁট ছুঁয়ে শুষে নিতে হবে,
আরো কিছু সুখ আর ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি।