২০২১ সালের ১৫ আগস্ট আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল নিয়ন্ত্রণে নেয় সশস্ত্র গোষ্ঠী তালেবান। ২০ বছর ধরে চলা যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে সে বছর ৩১ আগস্ট আফগানিস্তানের মাটি ত্যাগ করে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশের সেনারা। শান্তি ফিরিয়ে আনতে দেশ শাসনের দায়ভার নেয় তালেবান। এই গোষ্ঠীটির দেশ শাসনের এক বছর পূর্ণ হলো সোমবার, ১৫ আগস্ট। এই এক বছরে আফগানিস্তানের বাস্তব চিত্র এবং তাদের দায়বদ্ধতা নিয়ে আল-জাজিরার সঙ্গে কথা বলেছেন তালেবানের শীর্ষ এক নেতা আনাস হাক্কানি।
সশস্ত্র গোষ্ঠী তালেবান যখন তাদের দেশ শাসনের এক বছর পূর্তি উদযাপন করতে প্রস্তুত তখন দেশটির নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে। জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত সপ্তাহে আইএস-এর সদস্যরা তালেবানের এক নেতাকে হত্যা করেছে বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে, সম্প্রতি ড্রোন হামলায় আল-কায়েদা প্রধান আয়মান আল-জাওয়াহিরি নিহত হওয়ার দাবি করেছে বাইডেন প্রশাসন। ফলে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে যে আদৌ আফগানিস্তানে কি শান্তি ও নিরাপদ পরিবেশ বজায় রাখতে পারবে তালেবান? যদিও তালেবান সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে আফগানিস্তানের মাটি ব্যবহার করতে দেবে না বলে বারবার আশ্বস্ত করে আসছে।
এক বছরে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি, সাফল্য, ব্যর্থতা এসব বিষয় নিয়ে তালেবানের শীর্ষ এক নেতা আনাস হাক্কানি কথা বলেছেন আল-জাজিরার সঙ্গে।
আনাস হাক্কানির কাছে প্রশ্ন ছিল, আপনার সরকার এক বছর ধরে দায়িত্ব পালন করছে, আপনাদের অর্জন আর ব্যর্থতাগুলো কি কি? আনাস হাক্কানি বলেছেন, গত এক বছরে, আমরা অনেক ক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য কাজ করেছি। বিদেশিদের হাত থেকে দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার পাশাপাশি, বিদেশিদের হস্তক্ষেপ, অন্যায় ও নিপীড়ন থেকে দেশকে মুক্ত করেছি। দখলের অধীনে থাকা যেকোনো মানুষ বা দেশ এটাই চায়। এটা আমাদের জন্য গর্বের উৎস, আশীর্বাদও বটে। আপনি বাইরে থেকেছেন এবং আপনি দেখতে পাচ্ছেন যে আমাদের দেশ বিশাল পরিবর্তনের দিকে এগোচ্ছে। ৪০ বছরের মধ্যে এই প্রথম একটি কেন্দ্রীয় সরকার গোটা দেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। দেশের প্রতিটি কোনায়, ইঞ্চি, ইঞ্চি তালিকা করার জন্য আরও অনেক কিছু করার বাকী আছে। তবে এটি উল্লেখ করা গুরুত্বপূর্ণ যে বাধ্যতামূলক শুল্ক যেগুলো আগে মানুষের ওপর আরোপ করা হতো তা এখন আর নেই। দেশে আর কোনো বিশেষ জঙ্গি গোষ্ঠী কাজ করছে না। কেন্দ্রীয় সরকার, কোনো শুল্ক বা বিদেশি সাহায্য ছাড়াই, সব প্রতিষ্ঠানের সরকারি কর্মচারীদের বেতন দিতে সক্ষমতা অর্জন করেছে।
গত বছরের কথা যদি বলা যায়। কেন আপনারা তৎকালীন পশ্চিমাদের সমর্থিত সরকারের সঙ্গে আলোচনার পরিবর্তে জোর করে কাবুল দখল করলেন? কেউ কেউ বলছেন এটি ২০২০ সালে স্বাক্ষরিত দোহা চুক্তির লঙ্ঘন। এমন প্রশ্নের জবাবে আনাস হাক্কানি বলেন, শুরু থেকেই আমরা দোহা চুক্তির প্রতি সম্মান করে আসছি। মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনী সেনা প্রত্যাহারের পর থেকে ১৪ মাস ধরে চুক্তি লঙ্ঘনের একটি ঘটনাও ঘটেনি। এর প্রমাণ হলো এটির আয়োজক ও পৃষ্ঠপোষক কাতার।
এর বিপরীতে, মার্কিন বাহিনী ও সাবেক প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানির নেতৃত্বের সময় সহিংসতার ঘটনা এক হাজার ছাড়িয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ক্ষমতায় আসেন, যেখানে তিনি আমাদের সঙ্গে আলোচনা না করে দোহা চুক্তিতে সেনা প্রত্যাহারের মেয়াদ আরও চার মাস বাড়িয়েছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ পর্যন্ত সন্ত্রাসীর কালো তালিকা থেকে নাম অপসারণে বিলম্ব করছে এবং আফগান বন্দীদের মুক্তি দিতেও বিলম্ব করেছে। তাদের চুক্তি লঙ্ঘনের তালিকা দীর্ঘ। আমাদের হতাশা সত্ত্বেও, আমরা সহিংসতা অবলম্বন করা থেকে বিরত থেকেছি। যাইহোক, কাবুলের আকস্মিক শূন্যতা আমাদের পদক্ষেপ নেওয়ার কারণ ছিল।
আপনারা অনেক বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। শান্তি ফিরিয়ে আনা, আফগানদের অধিকার প্রতিষ্ঠা, অন্তর্বর্তী সরকার গঠন, নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা করা এসব। কতটা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পেরেছেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে আনাস হাক্কানি বলেন, গত ২০ বছর ধরে আফগানিস্তানকে নিয়ন্ত্রণ করছে বিদেশি শক্তি, তাদের উন্নত প্রযুক্তি, সামর্থ্য এবং সম্পদ দীর্ঘ সময়ের মধ্যেও ব্যর্থ হয়েছে। তারা নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়েছে। যা আমাদের জনগণ এখন উপভোগ করছে। আমরা কেবল একবছর পার করছি। রাতারাতি সব লক্ষ্য পূরণ বা অর্জন করা যায় না। এটা প্রায় অসম্ভবের কাছাকাছি, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আমাদের শাসনের স্বীকৃতি এবং বিদেশি সাহায্যসহ তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করেনি। তাদের পক্ষ থেকে বিলম্ব হওয়া সত্ত্বেও, আমরা আল্লাহর রহমতে অনেক অগ্রগতি লাভ করেছি। এখন, আপনি দেখতে পাচ্ছেন যে মেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্কুলগুলোতে যোগদান করছে [প্রদেশগুলোর বেশিরভাগ এখনো উচ্চ বিদ্যালয়ের মেয়েদের শিক্ষার অনুমতি দেয় না]। বলা বাহুল্য যে, আমাদের সব মন্ত্রণালয় এবং অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে এখনো অনেক ব্যবস্থা নেওয়ার বাকি আছে। আমরা যে চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি হয়েছি তার মধ্যে গত ২০ বছরে অন্যরা যা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে তা অর্জন করার আশা করবেন না।
আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার অধীনে থাকা তালেবান নেতাদের সরকারে থাকার দরকার আছে কী? এটা কি সরকারের জন্য প্রতিবন্ধকতা নয়? কেন অন্য আফগানদের (তালেবানের বাইরে) সরকারে আনা হয় না? এমন প্রশ্নের জবাবে হাক্কানি বলেন, আজ পর্যন্ত সমগ্র বিশ্ব ‘সন্ত্রাস’ এর অভিন্ন সংজ্ঞায় আসতে পারেনি। এটাই স্বাভাবিক যে ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিরা তাদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানো কাউকে ‘সন্ত্রাসী’, ‘শত্রু’, ‘অপরাধী’ হিসেবে চিহ্নিত করবে। ইতিহাসে অনেক উদাহরণ রয়েছে। যেমন, ইয়াসির আরাফাত এবং নেলসন ম্যান্ডেলা বছরের পর বছর কালো তালিকায় ছিলেন। পরে তারা নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন। কালো তালিকা এবং নিষেধাজ্ঞা রাজনৈতিক হাতিয়ার ছাড়া আর কিছুই নয়। আমাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল আমাদের দেশকে দখলদারদের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করা, আমাদের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করা এবং সেটাই আমরা পূরণ করেছি। আমরা অন্য দেশ বা জনগণের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে চাই না। আমরা এবং পুরো আফগান জনগণ আমাদের নেতাদের অত্যন্ত সম্মান করি। আমরা আশা করি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমস্যাগুলোও দূর হবে।
২৬ লাখের বেশি আফগান এখন উদ্বাস্তু এবং ৩০ লাখ অভ্যন্তরীণভাবে স্থানচ্যুত হয়েছে। আফগানিস্তান বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম খাদ্য সংকটের মুখোমুখি। এক বছরে আপননারা যা অর্জন করেছেন তাতে কি আপনি সন্তুষ্ট? মানবিক সংকট মোকাবিলায় আপনারা কী করছেন?
হাক্কানি বলেন, আমি যেমনটি শুরুতেই বলেছিলাম, আফগানিস্তান সম্পূর্ণ ভিন্ন এখন, যেটি ২০ বছর আগে ছিল। উদাহরণ দিয়ে বলি, সাবেক সরকার মাজার-ই-শরীফের অনেক কিছুই করতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা অন্যদের চাপের মধ্যে ছিল। আমরা সঠিক পথে কিছু করতে শুরু করেছি। এখন দেখছেন দেশি-বিদেশি কোম্পানির মাধ্যমে খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করা হচ্ছে। আল্লাহর রহমতে এসব প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা এখন আমাদের মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কাজকর্মের জন্য রাজস্ব আদায় করতে পারছি, বেতন দিতে পারছি। রাজস্বের আরেকটি উৎস আসে শুল্কের মাধ্যমে। রাজ্যগুলোর সব রাজস্ব এখন কেন্দ্রীয় সরকারের কোষাগার, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ে চলে যায়। আমরা সব দেশ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে ভালো এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উপভোগ করতে চাই। আমাদের জনগণের জন্য একটি মর্যাদাপূর্ণ এবং আরামদায়ক জীবনযাপনের ব্যবস্থা করাও আমাদের কর্তব্য। আমরা এখানে মানুষের সেবা করতে এসেছি। আমি বিশ্বাস করি আমরা আমাদের জনগণের জন্য অনেক কিছু অর্জন করতে পেরেছি। যাইহোক, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় স্বীকৃতি না দেওয়ার কারণে আমরা যে চ্যালেঞ্জগুলোর সম্মুখীন হচ্ছি তা সত্ত্বেও আমরা আরও কিছু করার আশা রাখি।
আপনারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তার মধ্যে একটি ছিল যে আফগান মাটি বাইরের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ব্যবহার করবে না এবং যে কোনও সন্ত্রাসী সংগঠনের জন্য জিরো টলারেন্স থাকবে। গত কয়েক সপ্তাহে, আমরা বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ড ঘটতে দেখেছি। পাকিস্তানি তালেবান নেতা নিহত হয়েছেন। কাবুলে আল-কায়েদার নেতা নিহত হয়েছেন। আপনার সরকার কি করছে এবং কিভাবে তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছে?
হাক্কানি বলেন, দোহা চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে আমরা সব বাধ্যবাধকতাকে সম্মান করে আসছি। আমরা এই বিষয়ে যেকোনো অভিযোগ খণ্ডন করতে প্রস্তুত। ইসলামিক আমিরাত [তালেবান সরকার] তাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করে যে বিবৃতি দিয়েছে, তা খুবই স্পষ্ট ছিল: ‘আমরা দোহা চুক্তির প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ’। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের অনুমতি ছাড়াই আমাদের ভূখণ্ডে প্রবেশ করে। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একটি স্পষ্ট লঙ্ঘন। বিশ্বের চোখে তালেবানের ভাবমূর্তি নষ্ট করার লক্ষ্যে বিদ্বেষপূর্ণ প্রচারণা চালানো হচ্ছে। আমরা এই মিথ্যা দাবি প্রত্যাখ্যান করি এবং আমি আবারও বলছি, দোহা চুক্তির অধীনে আমরা আমাদের কোনো বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘন করিনি। আমরা দেখতে চাই অন্য পক্ষ তাদের সম্মান রেখেছে এবং তাদের দায়িত্ব পালন করছে।
সূত্র: আল-জাজিরা