একটা জেলা শহরের একজন রাজনীতিবিদ কথা প্রসঙ্গে একদিন বললেন, আমি আপনাকে নিশ্চিত করে বলে দিতে পারি, আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ সংগঠনের ৭৫ শতাংশ সদস্য একবারে বঙ্গবন্ধুর জন্ম সাল এবং জন্মদিন বলতে পারবেন না! আমাদের ইতিহাসের একটা কালো অধ্যায়ের কারণে ৭৫ এর ১৫ আগস্ট তাঁদের মুখস্থ হয়ে গেছে, তাই হয়ত একবারে বলতে পারেন! আমি পরে ভেবে দেখেছি, ভদ্রলোকের বক্তব্য একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না! কারণ, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর যেমন গৌরবের দিন হিসাবে আমাদের হৃদয়ে খোঁদাই হয়ে গেছে। তেমনি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙ্গালি জাতির জীবনে এক কালো অধ্যায় হিসাবে, বাঙ্গালি জাতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামের সাথে ১৫ আগস্ট দিনটিও আমাদের হৃদয়ে রক্তের অক্ষরে লেখা হয়ে গেছে! আর সেটা যে শুধু আওয়ামী লীগের লোকেদের হৃদয়ে লেখা হয়েছে তা, নয়! সংবেদনশীল প্রতিটা মানুষ, রাজনীতি সচেতন, দেশপ্রেমিক যেকোনো মানুষের হৃদয়ে লেখা থাকবার কথা! যদিও আমার আজকের লেখার বিষয় আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ সংগঠনের নেতা কর্মীরা বঙ্গবন্ধুর জন্ম সাল এবং জন্মদিন জানেন কিনা, একবাক্যে বলতে পারবেন কিনা, পারলে সেটা কত শতাংশ সেই বিতর্ক নয়! শিরোনাম দেখেই নিশচয় সেটা আপনারাও অনুমান করতে পারেন! আমরা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এবং বর্তমান সরকার প্রধান থেকে শুরু করে সরকারি কর্মচারী সবার মুখেই শুনি, তারা নাকি বঙ্গবন্ধুর চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁর সোনার বাংলার স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছেন! কি ছিল বঙ্গবন্ধুর চেতনা, কি ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন সেগুলি জানতে হলে বঙ্গবন্ধুর জন্ম, তাঁর বেড়ে ওঠা এগুলি জানাও জরুরী! যে ভদ্রলোকের কথা দিয়ে লেখা শুরু করেছিলাম তিনি নিশ্চয় বঙ্গবন্ধুর জন্ম সাল এবং জন্ম তারিখ নিয়ে কথা বলতে চান নাই! তিনি বুঝাতে চেয়েছিলেন, যারা একজন মানুষের জীবনের শুরু জানেন না, তাঁর বেড়ে ওঠা জানেন না, তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়কাল জানেন না, তাঁরা কিভাবে সেই মানুষের চেতনা ধারণ করবেন? তাঁরা কিভাবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবেন?
আসলে বাস্তবতাও কিন্তু তাই! সেইটার সবচেয়ে বড় উদহারণ হল, গ্রাম-গঞ্জ থেকে শহর-বন্দরে ১৫ আগস্ট এলে আমরা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণই শুনেছি! মনে-প্রাণে আওয়ামী লীগ না করা একজন মানুষও যদি পূর্ণ মনোযোগের সাথে এই ভাষণ শোনেন, তাহলে তিনি শিহরিত না হয়ে পারেবন না, সেটা বোধহয় জোর দিয়েই বলা যায়। এই ভাষণের প্রতিটি কথা আমাদের পূর্বসূরিদের মনের কথা, প্রাণের কথা। আজও যখন আমরা এই ভাষণ শুনি, আমাদের মনে হয় এ তো আমাদেরই মনের কথা, প্রাণের কথা। কিন্ত বঙ্গবন্ধুর এই একটা ভাষণই আমাদেরকে শোনানো হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সরকারি কর্মচারীদের উদ্যেশ্য করে বঙ্গবন্ধুর যে ভাষণ, যেখানে কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষকে সম্মান জানিয়ে, বঙ্গবন্ধুর ভাষায় ইজ্জত দিয়ে কথা বলতে বলেছেন, সেই ভাষণ আমাদের শোনানো হয় না! আসলে সেটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর চেতনা। আর আজকে সরকারি কর্মচারীদেরকে স্যার না বললে, তাঁদের ইজ্জত থাকে না! আমি বারবার সরকারি কর্মচারী বলছি, কারণ আমাদের সংবিধানে কর্মকর্তা বলে কোনো শব্দ নাই! বলা হয়েছে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী! কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশে তারাই হয়ে বসেছেন, সচিব, কর্মকর্তা, আমাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা! এই কি ছিল বঙ্গবন্ধুর চেতনা, এই কি ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলা? এইগুলি নিয়ে যদি কেউ প্রশ্ন না তুলতে পারেন, তিনি হতে পারেন পাড় আওয়ামলীগার কিংবা বঙ্গবন্ধুর অন্ধভক্ত, কিন্তু তিনি বঙ্গবন্ধুর চেতনার ধারক, বাহক হিসাবে দাবী করতে পারেন না। তিনি কিভাবে তাঁর স্বপ্নের বাস্তবায়ন করবেন কিভাবে?
দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, সুন্দরবন কেউ পয়দা করেনি! এই বন প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত হতে বাংলাদেশেকে রক্ষার জন্য কবচ হিসাবে কাজ করে! কাজেই এই বনকে ধ্বংসের অধিকার কারো নাই। আমি জানিনা, আওয়ামী লীগ করা কত জন মানুষ এই কথা জানেন! তবে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র করার জন্য যারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যারা মরিয়া ছিলেন, তাঁদের একজনও এই বক্তব্য জানে না, এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। তাহলে আপনারা বঙ্গবন্ধুর কোন চেতনা ধারণ করেন? কোন স্বপ্নের বাস্তবায়ন করতে চান? যে চেতনায় কৃষক নাই, শ্রমিক নাই, খেটে খাওয়া মানুষ নাই, প্রাণ-প্রকৃতি নাই!
১৯৫৫ সালের ২১ অক্টোবর ঢাকায় অনুষ্ঠিত তৃতীয় সম্মেলনে দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি প্রত্যাহার করা হয়। বঙ্গবন্ধু পুনরায় সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। আমাদের কি বুঝতে অসুবিধা হয়, যে এই মুসলিম শব্দ প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর কি ভূমিকা ছিল। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ আওয়াল লীগের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেছেন- ‘রাজনীতিতে যারা সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করে, যারা সাম্প্রদায়িক তারা হীন, নিচ, তাদের অন্তর ছোট। যে মানুষকে ভালবাসে সে কখন কোনদিন সাম্প্রদায়িক হতে পারে না। আপনারা যারা এখানে মুসলমান আছেন তারা জানেন যে, খোদ যিনি আছেন তিনি রাব্বুল আলামিন। রাব্বুল মুসলিমিন নন। হিন্দু হোক, খ্রিস্টান হোক, বৌদ্ধ হোক সব মানুষ তাঁর কাছে সমান। সেজন্যই একমুখে সোশ্যালিজম ও প্রগতির কথা এবং আরেক মুখে সাম্প্রদায়িকতা পাশাপাশি চলতে পারে না। যারা এই বাংলার মাটিতে সাম্প্রদায়িকতা করতে চায়, তাদের সম্পর্কে সাবধান হয়ে যাও! আওয়ামী লীগের কর্মীরা তোমরা কোনদিন সাম্প্রদায়িকতা পছন্দ করো নাই! তোমরা জীবনভর তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছ! তোমাদের জীবন থাকতে যেন বাংলার মাটিতে কেউ সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন না করতে পারে।’
কি দুর্ভাগ্য এই জাতির! বঙ্গবন্ধুর চেতনাধারণকারী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এক যুগের বেশি সময় ধারাবাহিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করে আসছে! এই সময়কালে একটি সাম্প্রদায়িক হামলাও সাংগঠনিক কিংবা রাষ্ট্রীয়ভাবে আওয়ালীগ কিংবা সরকার প্রতিহত করতে পারেন না, এমনকি একটা ঘটনার দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি নিশ্চিত করতে পারে নাই! উলটো একাধিক ঘটনায় দেখা যায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ হামলার সাথে যুক্ত ছিলেন এবং স্থানীয় প্রশাসনের ভুমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ ছিল!
আওয়ামী লীগের একজন ছাত্র সংগঠনের কর্মীর কেমন হওয়া উচিৎ, সে ব্যাপারে সরাসরি কিছু না বললেও বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে নিজের ছাত্রজীবন সম্পর্কে যা বলছেন, তার এই অংশটুকু আজকে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন তো বটেই, অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের জন্য অনুসরণীয় হতে পারত, এখনো হতে পারে। তিনি বলছেন- ‘আমাকে যে কাজ দেওয়া হত আমি নিষ্ঠার সাথে সেই কাজ করতাম! কোনোদিন ফাঁকি দিতাম না। ভীষণভাবে পরিশ্রম করতাম। সেই জন্য আমি কড়া কথা বললেও কেউ আমাকে কিছুই বলত না। ছাত্রদের আপদে-বিপদে আমি তাদের পাশে দাঁড়াতাম। কোন ছাত্রের কি অসুবিধা হচ্ছে, কোন ছাত্র হোস্টেলে জায়গা পায় না, কার ফ্রি সিট দরকার, আমাকে বললেই আমি প্রিন্সিপাল ড. জুবেরী সাহেবের কাছে হাজির হতাম। আমি অন্যায় আবদার করতাম না। তাই শিক্ষকেরা কথা শুনতেন। ছাত্ররাও আমাকে ভালবাসত। হোস্টেল সুপারিন্টেডেন্ট সাইদুর রহমান সাহেব জানতেন, আমার অনেক অতিথি আসত।। বিভিন্ন জেলার ছাত্রনেতারা আসলে কোথায় রাখব, একজন না একজন ছাত্র আমার সিটে থাকতোই। কারণ সিট না পাওয়া পর্যন্ত আমার রুমই তাদের জন্য ফ্রি রুম।’
আজকে যারা ছাত্রলীগ করছেন, তারাই তো আগামীদিনে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে আসার কথা! যদিও সেই সম্ভাবনা দিন দিন ক্ষীণ হয়ে আসছে। মাঠের রাজনীতিতে যারাই থাকুক না, কেন সংসদে ব্যবসায়ী এবং আমলাদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আমার মনে হয়, বঙ্গবন্ধুর জীবনের এই কথাগুলো জানলে, তাঁর চেতনাকে সত্যিকার অর্থে ধারণ করতে পারলে আওয়ামী লীগ কর্মীরাই, ছাত্রলীগ-ই ব্যবসায়ী এবং আমলাদের এই বাড়-বাড়ন্ত রুখে দিতে পারত। কিন্ত আমরা জানি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রলীগ কি ভূমিকা পালন করছে! আর যে শিক্ষকরা গালভরা বুলি আওড়ান, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন, তারাও আজ অনেক ক্ষেত্রেই ছাত্রলীগকে তোয়াজ করে চলেন! কিসের চেতনা! কিসের স্বপ্নের বাস্তবায়ন!
আমি এতক্ষণ যে বিষয়গুলি নিয়ে কথা বললাম, তা বঙ্গবন্ধুর বর্ণাঢ্য জীবনের কয়েকটা ঝলক মাত্র! এরকম অসংখ্য ঘটনা, বক্তব্য এবং দিক নির্দেশনার সাথে বর্তমান আওয়মী লীগ এবং এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের বর্তমান কর্মকাণ্ড তুলনা করে দেখানো যাবে, বঙ্গবন্ধুর যে চেতনা, যে স্বপ্ন সেগুলির ধারে কাছেও তারা নাই। আর আমাদের কথিত বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাংবাদিক এবং শিক্ষকরাও আজ স্রোতের বিপরীতে দাঁড়াবার সাহস রাখেন বলে মনে হয় না। দল হিসাবে আওয়ামী লীগ কিংবা সরকার ভুল পথে অগ্রসর হলে তাঁদেরকে স্মরণ করিয়ে বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে পরিচালনা করার দায়িত্ব তাঁদের উপরই বর্তায়। সেই দায় যেহেতু কেউ নিচ্ছেন না, হাতে গোনা দু-একজন বলছেন, কিন্তু তাঁদের কথা যখন ভেবে দেখার আগেই খারিজ করে দেওয়া হয় তখন, একথা বলা বোধহয় খুব অসমীচীন হবে না যে, বঙ্গবন্ধু কেবল স্মরণে আছেন, চেতনায় নাই।