লায়ালপুর মিয়ানওয়ালি কারাগারের সামনে এসে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে কেঁপে কেঁপে উঠল কামালের পুরো দেহ। মনও। গোপন আলোড়নের ঝড় সামাল দিয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল ও। এখানে কখনও আসবে, ভাবনায় থাকলেও তা সত্যি হয়ে যাবে, বিশ্বাস করতে পারেনি। আর এ কারণেই লায়ালপুর এসে এখনও ঘোরের মধ্যেই আছে কামাল।
লাহোর থেকে আশি মাইল দূরের এ শহরের বর্তমান নাম ফয়সলাবাদ। নাম বদল হলেও কারাগারের চেহারা বদল হয়নি। দেয়ালে গজিয়ে থাকা উদ্ভিদের চিকন-সরু শেকড়-ঝাড় আর তেলচিটে ফাংগাসের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে কারাগারের ভেতরে ঘটে যাওয়া হিংস্রতার চিহ্ন। আছে মমতার স্বাক্ষরও।
এ কারাগারের ভেতরে রয়েছে টিনশেডের একটা কোয়ার্টার। দেখতে স্কুল-ঘরের মতো এই কোয়ার্টারের মধ্যে আছে অনেক কক্ষ। উত্তর-দক্ষিণ লম্বা শেডের একদম উত্তর প্রান্তের কক্ষের সামনে ধীর পায়ে হেঁটে এসে দাঁড়াল কামাল। পায়ে কোত্থেকে এত শক্তি এসেছে, জানে না ও। কে ওকে গাইড করে নিয়ে এসেছে, তাও না। কেউ যেন পা টেনে রাখছে পেছনে। সবল টান উপেক্ষা করে বুক উঁচিয়ে এখানে এসে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে কক্ষের দরজাটা খুলে গেল। আর অবাক হয়ে ও দেখল লালসূর্যের রোদের মতো প্রখর রোদের একটা ঝলক বেরোচ্ছে কক্ষের ভেতর থেকে। বিরল দৃশ্য দেখে চমকে উঠে পেছনে তাকাল কামাল। সূর্য পশ্চিমে হেলেছে। বাইরের রোদ ভেতরে ঢোকার কথা। কথামতো কিছু ঘটছে না। ভেতর থেকেই বেরোচ্ছে রোদ!
কক্ষে ঢোকার আগে আছে একটা ছোট বারান্দা। বারান্দাটা শক্ত লোহার শিক দিয়ে ঘেরা। আবদ্ধ বারান্দার গ্রিলেও রয়েছে তালা লাগানোর একদম অন্যরকম কঠিন ব্যবস্থা। ভেতরে যিনি থাকবেন, ইচ্ছা করলে বেশি দূর যেতে পারবেন না। ছোট্ট সীমানার মধ্যেই আটকে থাকতে হবে তাকে। সে আলামত দেখতে পাচ্ছে ও।
বাঁয়ে ঘুরে কামাল দেখল একটা টিউবওয়েল। মরচে পড়ে গেলেও টিউবওয়েলের হাতল চেপে জল বের করে মুখ ধোয়ার ইচ্ছা হল ওর। নিজ দেশ থেকে উড়ে এসে এ জায়গাটা দেখার স্বস্তিবোধের সামনে ক্লান্তি টেকেনি, উড়ে গেছে মুহূর্তেই। হাতলটা ধরার সঙ্গে সঙ্গে ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো ঝাঁকি খেল ও। আশ্চর্যের বিষয় হল যেভাবে ঝাঁকি লাগার কথা, তা লাগেনি। বরং ভয়ের পরিবর্তে সহস্রগুণ সাহস বেড়ে গেল বুকের ঘরে। মনে হল এ হাতলে লেগে আছে মহান এক হাতের স্পর্শ। স্পর্শটা একদম তাজা, একদম বর্তমান স্পর্শের মতো, একদম বাস্তব, সত্যি। স্পর্শের অনুভবে হাতলটা ধরেই রইল ও। কিছুতেই এ হাতল ছাড়তে চাইল না। চাপতেও না। আর তখনই ওর হাতের স্নাযুকোষ বেয়ে দুরন্ত গতিতে ব্রেনের দিকে ছুটে গেল এক উল্লসিত কাঁপন, স্পন্দন। স্নায়ুকোষে নতুন আলো ঢুকিয়ে দিল ওই কম্পনস্রোত। আর তখনই কামাল শুনল অবিশ্বাস্য মহান এক স্বর, ‘হাতল ধরে বসে আছ কেন? চাপো? না চাপলে কি পানি বেরোবে? পঞ্চাশ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতাপে তো ঘেমেনেয়ে একাকার হয়ে গেছ। মুখে পানি ছিটাও। শান্তি পাবে।’
মাথার ভেতর এ কথার আলোড়ন উঠলেও স্পষ্টই তা কানে শুনতে পেল কামাল। অবিশ্বাস্য সত্যকথন শুনে কিছুটা খেই হারিয়ে আবার নিজেকে শক্ত করে ও জবাব দিল, ‘শান্তি পেয়ে গেছি। মুখে পানির ছিটা দিয়ে আর শান্তি পেতে চাই না।’
‘এটা তোমার ভুল ধারণা। কল্পনা। বাস্তবতা হচ্ছে কল চাপতে হবে। পানি বেরোবে। সে-পানি দিয়ে মুখ ধোবে। তারপর তৃপ্ত হয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াবে।’
‘সোজা হয়ে দাঁড়াতে চাই না। হাতলটাও ছেড়ে দিতে চাই না। আমার হাতের তলে থাকা তোমার হাতটাও না।’
‘শোনো, বোঝো। অবুঝ হোয়ো না। মুখ ধুয়ে নাও।’
‘মুখ ধুতে গেলে তোমার স্পর্শ থেকে বঞ্চিত হব না তো? তোমার কথা থেমে যাবে না তো? সঙ্গে থাকবে তো? আগে গ্যারান্টি দাও।’
এবার হো হো হো করে আবার হাসির রোল উঠল। অট্টহাসির এ দাপটে ভড়কে গিয়ে কামাল প্রশ্ন করল, ‘হাসছ কেন?’
‘এতদূর এসেছ তুমি, কীসের টানে? কীসের মোহে? নিজের প্রতি বিশ্বাস নেই? আছে তো! তার প্রমাণ তো এখানে এসে দিয়েই ফেলেছ। বি কনফিডেন্ট।’ জোরাল কথার দাপটে নিজের অবস্থান থেকে সরে হাতলে চাপ দিল কামাল। কলের মুখ দিয়ে ঝরঝর করে বেরিয়ে এল জলধারা। দু’হাতের আজলা ভরে ও মুখ ধুয়ে নিল। আবার আজলা ভরে মুখের সামনে তুলে আনার সঙ্গে সঙ্গে দেখল হাতের মধ্যে ও তুলে ধরেছে অপরূপ এক জলসূর্য। ফট করে কথা বলতে শুরু করল দ্যুতিময় ঝকঝকে জল-আলো, ‘এ জল খেতো তোমার বন্ধু, যাঁকে তুমি খুঁজতে এসেছ, তিনি। এ জলে গোসল করত তোমার বন্ধু, যাঁর স্মৃতিগাথা তুমি দেখতে এসেছ, তিনি। তাঁকে গোসলের জন্য দেওয়া হত উটমার্কা কাপড় কাঁচা সাবান। সেই সাবানে কি আর ঘামজড়ানো শরীর পরিষ্কার হতো? না। হতো না। আমি পরম মমতায় গোসল করিয়ে দিতাম, শরীরের ময়লা ধুয়ে ঝরঝরে করে তুলতাম তাঁকে।’
মুগ্ধ হয়ে জলসূর্যের কথা শুনল কামাল। সঙ্গে সঙ্গে মুখ ধুয়ে নিল। চোখেও ঢুকেছে জলের ছিটা। মুহূর্তেই বেড়ে গেল চোখের জ্যোতি। ওর চোখও কথা বলতে শুরু করল, ‘ডানে তাকাও। দেখো, এখানকার জমিন দেখো। মাটি দেখো। চারপাশটা দেখো।’
কামাল দেখল যবগাছের একটা ক্ষুদ্র বাগান। যবগাছ মানে গমগাছ, জানে ও। গাছের কচি পাতার আলো থেকে চোখ সবুজের ছাট খেল। সঙ্গে সঙ্গে ও এগিয়ে গেল বাগানটার দিকে। সবুজ পাতায় স্পর্শ করার পর গাছের ডাটি মুঠি করে ধরার সঙ্গে সঙ্গে গাছ কথা বলতে শুরু করল, ‘এ জায়গাটায় জন্মে আমি ধন্য। এখানে যবগাছ লাগিয়েছিলেন তোমার বন্ধু, যাঁকে তুমি দেখতে চাও, খুঁজতে এসেছ যাঁর স্পর্শ, তিনি। আমাদের পূর্বসুরী, তখনকার যবগাছের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে তিনি সবুজ রোশনি নিতেন দু’চোখে। তাঁর চোখে তখন ভেসে উঠত তোমার শস্যশ্যামল সবুজ দেশ। তিনি দেখতে পেতেন তাঁর প্রিয় বাংলা, দেখতে পেতেন দেশের মানুষকে। আর একা একা দাঁড়িয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলতেন। কথা বলতেন সন্তান আর স্ত্রীর সঙ্গে। কথা বলতেন মা-বাবার সঙ্গে। কথা বলতেন দেশের মাঠে রেখে আসা সহযোদ্ধাদের সঙ্গে। আর দেশের মুক্তির জন্য প্রার্থনা করতেন। ছোট্ট শিশু রাসেলের সঙ্গেও কথা বলতেন। কিন্তু আশ্চর্যরকম ছিল তাঁর প্রাণশক্তি। জনবিচ্ছিন্ন থেকেও চোখের জল ফেলতেন না। পুরো বিশ্ব থেকে একদম আড়াল করে রাখা হয়েছিল তাঁকে। না-ছিল টেলিফোন-টেলিভিশন, না-ছিল খবরের কাগজ, না-ছিল পড়ার মতো কোনও বই। আমাদের বংশধররাই ছিল তাঁর সঙ্গী, বন্ধুও।’
‘তোমাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।’
‘না। না। আমাদের প্রতি নয়, তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ থেকো। তাঁর কারণে তোমরা পেয়েছ একটা স্বাধীন দেশ। এ মৃত্যুপুরীতে থেকেও তিনি আপন মনে বুনেছেন আমাদের। পাঁচ গজ সমান মাটিঘেরা এ জায়গাটুকু সাজিয়েছেন প্রাণের ঢেলা দিয়ে। ছোট্ট বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকতেন এ ভূমিতে। স্বপ্ন দেখতেন সবুজ বাংলার, স্বপ্ন দেখতেন সোনার দেশ গড়ার। তিনি নিশ্চিত সোনার মানুষ গড়তে পেরেছেন, যার প্রমাণ তুমি। কত দূর থেকে উড়ে এসেছ তার স্পর্শ খুঁজে পেতে, ভাবা যায়!’
‘হ্যাঁ, যববন্ধু। এখানে আমাদের বন্ধু দীর্ঘদিন আটক ছিলেন। ওই ছোট্ট কুঠুরিতে শ্বাস নিয়েছেন। তোমাদের স্পর্শে ভাল থাকার চেষ্টা করেছেন। তোমাদের মমতা পেয়েছেন, যতই নিষেধ করো না কেন, আমরা তোমাদের প্রতিও কৃতজ্ঞ।’
উষ্ণ এ এলাকায় বাতাস স্থিরই ছিল। কেবল গরমভাব বেরোচ্ছিল। কামাল যখন এসে দাঁড়াল নিজ দেহের ত্বক পুড়ে যাচ্ছিল। সেদিকে খেয়াল ছিল না ওর। হঠাৎ যবগাছ দুলতে শুরু করায় টের পেলো ওই দোলায় বয়ে আসছে বাতাসের ঢেউ। গরমের তেজ শুষে নিয়ে সেই ঢেউ কোমল পরশ বুলিয়ে দিতে লাগল। কামালের বিস্ময়ের ঘোর কাটল না। অবাক হয়ে যবগাছের দুলুনি আর বাতাসের আদর পেয়ে মুগ্ধ হয়ে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল।
কামাল বুঝতে পারল অতি গরমের সময় যবগাছের দুলুনিতে বাতাসের ঢেউ উঠত। সেই ঢেউ ওদের বন্ধুকে স্বস্তি দিত। ভাবতে পেরে অন্যরকম শান্তিতে ভরে উঠল মন।
হঠাৎ পায়ের তলার মাটির কম্পন টের পেয়ে ও থপ করে বসে পড়ল মাটিতে। কেঁপে কেঁপে উঠে জবান খুলে গেল মাটির, ‘শোনো, ছোট্ট একটা কাঠের টুকরোর সরু অগ্রভাগ দিয়ে তোমাদের বন্ধু আমাদের বুকে নিরানি দিতেন। আমাদের বুকে জল ছিটাতেন। আমাদের তপ্ত বুকের তৃষ্ণা মিটিয়ে উর্বর করে তুলতেন। তারপর কয়েদখানার একজন কেয়ারটেকারকে অনুরোধ করে, তার মাধ্যমে এনে আমাদের বুকে লাগিয়েছিলেন যবের বীজ, এত সুন্দর একটা যব-বাগান বানিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। এর আয়তন অতি ক্ষুদ্র হলেও, বিস্তৃতি বিশাল। যেন এখানে বসে বসে পরম মমতায় তিনি নিজ দেশের মাটি নিরানি দিতেন, নিজ দেশের উর্বরতার কথা ভাবতেন, নিজ দেশের কৃষিকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা ভাবতেন। এ ক্ষুদ্র ভাবনার ভেতর কত বিশাল ছক লুকিয়ে ছিল, বুঝতে পারছ?’
কামালের সংকীর্ণ মনটা প্রসারিত হতে লাগল। চোখের ঘরে লুকোনো ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের ফোকাসের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল পুরো বাংলাদেশ। সবুজের মাঝখানে বাংলাদেশের মানচিত্র দেখে চমকে উঠল ও। এ দুঃসহ কারাবাস জীবনেও দেশের মানচিত্রে ডুবেছিলেন তিনি। টের পেয়ে মনে মনে তাঁকে কুর্নিশ করে উঠে দাঁড়াল কামাল।
এবার ও এগিয়ে গেল সেই মূল কক্ষের দিকে। ভেতরে ঢোকার সময় ছাট খেলো আগুনসিদ্ধ গরমের। ত্বক আবার পুড়ে যেতে লাগল। মুখ পুড়ে যেতে লাগল। চোখও জ্বলতে শুরু করল। নিজ দেশ থেকে বন্দি করে হাজার মাইল দূরে উড়িয়ে এনে অসহ্য গরম এ কারাকুঠুরিতে রেখেছিল তাঁকে! বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনকে এভাবে দমন করতে চেয়েছিল! এভাবে আন্দোলনের নৌকাকে মাঝিবিহীন করে হালভেঙ্গে দিতে চেয়েছিল শত্রুরা? গরমে তেতে ওঠা এ ভয়ঙ্কর কারাকুঠুরির বিরূপ পরিবেশ আর দুঃসহ গরমে তো যে-কেউ ভেঙে যেতে পারে, মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে পারে। মনোবল ভেঙেচুড়ে গুঁড়িয়ে যেতে পারে যেকোন শক্তিধর মানুষের। এখানে একদম জনবিচ্ছিন্ন থাকা অবস্থায় কীভাবে কাটিয়েছেন তিনি? মনে তেড়ে ওঠা প্রশ্নের পর প্রশ্নের ঝড় সামলে ও দেখল কুঠুরি ভেতর একটা পাটি বিছানো রয়েছে। তার পশ্চিমপ্রান্তে আছে জরাজীর্ণ এক বালিশ। আর কোন আসবাব নেই। কক্ষের বাইরের চারপাশটা লোহার শিক দিয়ে ঘেরা। আর ভেতরের দেয়াল যেন ঠেসে রেখেছে পাটিটাকে। উপরের টিনের শেডের গরম ভাপ ছড়িয়ে যাচ্ছে ভেতরে। দুঃসহ গরমে প্রাণবায়ু বেরিয়ে যাচ্ছিল। মাথা চক্কর দিয়ে ওঠায় কামাল ঘুরে পড়ে যাচ্ছিল প্রায়। তখনই ও ডানহাত দিয়ে দেয়ালটা ধরে নিজের পতন ঠেকিয়ে মেঝেতে বসে পড়ল। মেঝের কোনে দেখল একটা অ্যালুমিনিয়ামের মগ আর থালা।
এমন দুঃসহ যাতনায় কাটিয়েছিলেন আমাদের বন্ধু? মনে মনে আওড়ানো প্রশ্নটি বেরিয়ে গেল কামালের মুখ থেকে।
সঙ্গে সঙ্গে জবান খুলে গেল দেয়ালের ‘শোনো, প্রিয় অতিথি, শোনো, তোমার কষ্টের অনুভূতি আমি আর এ কুঠুরির সবাই টের পেয়ে গেছি। তুমি যা ভাবছ, আমার দেশের সামরিক প্রেসিডেন্টের উদ্দেশ্য ছিল তাই-ই। এমন নির্জন কক্ষে, এমন বিরূপ আর কঠিন পরিবেশে রেখে তোমাদের বন্ধুকে ভারসাম্যহীন বানানোর ফন্দি আঁটা হয়েছিল। এ নির্জন গরম সেলটা দেখো, এখানে কোন ফ্যানও নেই। এখানেই কেউ স্বাভাবিক থাকতে পারার কথা নয়। অথচ ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুহুমকি নিয়ে থেকেছেন তোমাদের বন্ধু। কীভাবে থাকতে পেরেছিলেন, শুনবে?’
‘বলো। শুনছি।’
জিজ্ঞাসার তৃষ্ণা বেড়েই চলেছে। সে তাগিদে দেয়ালের কথা শোনার জন্য কানখাড়া রাখল ও দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে।
‘আমি তোমার বন্ধুকে কখনও ঠেসে ধরার মতো তাঁর অনুভব জাগাইনি, কষ্ট দিইনি তাঁকে। বরং এ ছোট্ট কুঠুরিতে বসে তিনি দেখতে পেতেন তোমার পুরো দেশ। শ্বাসরুদ্ধকর এ কক্ষে এজন্য তাঁর শ্বাসরোধ হয়নি। কখনও তাঁর মনোবল ভেঙ্গে যায়নি। দুঃসাহসী তোমার বন্ধুর মনোবল আর সাহসের তোড়ে আমি কখনও তাঁর ধারেকাছেও ঘেঁষতে পারিনি। দূরে দূরে থেকে দেয়ালঘেরা কুঠুরিটাকে বানিয়ে দিয়েছিলাম তোমাদের দেশ। মাঝে মাঝে তবু দেখেছি তাঁর হাঁসফাঁস করা কষ্ট। তাঁর যন্ত্রণার প্রতিচ্ছাপ বসে আছে আমার বুকে। উৎকন্ঠার চাপে মাঝে মাঝে তিনি দিশেহারা হয়ে যেতেন। দেশের কী হলো, কী ধ্বংস আর হত্যালীলা চলছে ভেবে ভেবে কাতরাতে থাকতেন। খাতা-কলম চেয়ে না-পেয়ে মাঝে মাঝে কাঠি দিয়ে খুড়ে খুড়ে আমার বুকে এটাসেটা লিখতেন। সেই সব দেয়াললিপি মুছে দিয়ে গেছে শয়তানের দল।’
‘তামাক টানার জন্য তিনি একটা কালো পাইপ ব্যবহার করতেন। সেটা কি এখানে ছিল তাঁর সঙ্গে?’
‘ছিল। তবে তামাক আর আগুন চেয়েও পেতেন না। তাঁকে নানাভাবে কষ্ট দেওয়াই ছিল জান্তাদের আসল উদ্দেশ্য।’
বন্ধুর একাকিত্বের কষ্ট একই রকমভাবে অনুভব করে দেয়াল-কথন শেষ হওয়ার পর টিনশেডের দিকে তাকাল কামাল।
সঙ্গে সঙ্গে টিনশেড বলতে শুরু করল, ‘আমাকে দোষ দিয়ো না। জানো তো সূর্যের তাপে আমি উত্তপ্ত হয়ে যাই সহজে। সেই তাপ কুঠুরির ভেতরে ছড়িয়ে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। এটাই বিজ্ঞান। কিন্তু স্বাভাবিক বিজ্ঞানের ফুটো খুঁজে বের করেছিলাম আমি। এই যে দেখছ কাঠের বিম, আমাকে বহন করে রেখেছে, আমার ভার ধরে রেখেছে, তাঁর বুকের শাঁসের ভেতর দিয়ে আমি আমার হিংস্র উত্তাপকে চালান করে দিতাম। ওই ফাঁক দিয়ে, দেখো আমার আর বিমের মাঝে ফাঁক আছে, তাপের বড় অংশ চলে যেত ঘরের বাইরে। আর তোমার বন্ধুও ছিল অসাধারণ বুদ্ধিমান। তাঁর উদ্ভাবনী চিন্তার তেজ ছিল আমার ছড়িয়ে দেওয়া তাপের চেয়েও বেশি উত্তাপময়। তিনি দরজা লাগাতেন না, খোলা রাখতেন। আর সে সুযোগে ঘরের ভেতরে ছড়ানো আমার তাপ দরজা দিয়ে বাইরে চলে যেত। তবু তলানিতে যে-গরম ছড়িয়ে থাকত ঘরে, তার জন্য তোমার বন্ধুর যে-ভয়াবহ কষ্ট হত, তা আমার মতো পাষাণের বুকেও কান্না ছড়িয়ে দিত। নিজের সুরক্ষা দেয়াল তুলেছিলেন তিনি নিজের বিশ্বাস আর মনোবলের দেয়াল গেঁথে। তাতে ফাটল ধরাতে পারেনি আমার ছড়ানো তাপ-দহন,আমার দেশের হিংস্র শাসকও।’
সব শুনে প্রায় দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল কামালের। তবু বলল, ‘তোমাদের প্রতি আমার অসীম কৃতজ্ঞতা। নিশ্চয়ই তোমাদের সহযোগিতা পেয়েছিল আমাদের বন্ধু। আর এ কারণে এমন দুর্বিষহ বিচ্ছিন্ন জীবনেও তিনি টিকে থাকতে পেরেছিলেন।’
কামালের কথা শেষ হওয়ার আগেই কুঠুরির কোণায় থাকা থালাটা নড়েচড়ে শব্দ তুলে বলল, ‘আমাকে হাতে নিয়ে তোমার বন্ধু ভাত খেতে বসতেন। বাঁ হাতের তালুতে আমাকে ধরে রাখতেন আর ডান হাত দিয়ে তিনি খুটিয়ে খুটিয়ে ভাত খেতেন।’
কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে থালাটা হাতে তুলে নিল কামাল। বাঁ হাতের তালুতে বসিয়ে চোখের সামনে তুলে ধরল ওটা। আশ্চর্য হয়ে দেখল থালা ভর্তি ভাত। আঙুলের দুই কড় সমান চালের ভাতের মধ্যে মাথা মোটা কালো কালো পোকাও দেখতে পেল। দুঃসহ যাতনার চাবুক এসে পড়তে লাগল ওর পিঠে।
কামালের বোধ সঞ্চারিত হয়ে গেল অ্যালুমিনিয়ামের থালার অনুকণার স্রোতে। সেই স্রোতে বইতে লাগল অতিথির জন্য সহমর্মিতার ঢেউ। ব্রেনে পৌঁছে গেল নতুন খবর। অনুকম্পন বলছে, ‘একদিন বঙ্গবন্ধু বিদ্রোহ করলেন। পোকাযুক্ত ভাত খাব না বলে জানিয়ে দিলেন। এও জানালেন তিনি রুটি খেতে চান।’
‘তারপর কি হল?’ কামাল প্রশ্ন করল।
কারাগারের বড় এক কর্তা জানিয়ে দিলেন, ‘রুটি হচ্ছে এদেশের মানুষের খাবার। এটা জুটবে না তাঁর মতো দেশোদ্রোহী আসামির জন্য।’
‘তিনি রুটি পেয়েছিলেন?’
‘তাঁর জোরাল দাবির মুখে কর্তপক্ষ রুটি দিতে বাধ্য হয়। উপরের মহলে সে-খবর চলে গেলে আবার ভাত আসতে থাকে।’
‘খেতে পারতেন তিনি?’
‘আব্দুল মালেক নামের একজন বাঙালি কয়েদি ছিল এখানে। তার রিক্রুট সঙ্গী পাঞ্জাবি আশরাফও ছিল এখানে কয়েদি হিসেবে। লেখাপড়া জানত বলে সেই পাঞ্জাবি মুন্সির কাজ করত কারাগারে। আব্দুল মালেক ওই মুন্সির সহায়তায় তোমার বন্ধুর ভাতের থালা থেকে পোকা বেছে দিতেন গোপনে। এ খবর তোমার বন্ধু জানতেন না। ভাতে পোকা না-থাকায় পরে ওই ভাত খেতে পারতেন তিনি। তখন খেতে কষ্ট হত না তাঁর।’
কামালের চোখ বুজে এল। শ্রদ্ধায় ভরে উঠল মন। এ শ্রদ্ধা আব্দুল মালেকের জন্য।
হঠাৎ অ্যালুমিনিয়ামের গ্লাসটা ঝিলমিল ঝিলমিল করতে করতে বলতে লাগল, ‘তোমার বন্ধুর খুব কাছের সঙ্গী ছিলাম আমি। আমার কিনারায় লেগে আছে তোমার বন্ধুর ঠোঁটের ছোঁয়া। আর তাঁর হাতের পরশ। প্রথমে আমাকে প্রায় প্রতিদিন ধুতেন উটমার্কা কাঁচা সাবান দিয়ে। পরে ধুয়েছেন ইম্পেরিয়াল লেদার সাবানের ফেনা দিয়ে।’
‘ওই সাবান পেলেন কোথায় তিনি?’
‘ওই যে, আব্দুল মালেকের কথা শুনলে না, তিনিই নিজের টাকা থেকে তিনটে ইম্পেরিয়াল সাবান কিনে পাঠিয়েছিলেন। কিছুদিন তা ব্যবহার করেছেন। ওই সাবান দিয়েই তিনি গোসল করার সুযোগ পেয়ে বেশ ঝরঝরা থাকতেন।’
আবারও মালেকের অবদানের কথা বুকে পুরে নিল কামাল। তারপর গ্লাসটা হাতে ঘষাঘষি করতে লাগল নিজের দু’হাত নিয়ে। এক সময় গ্লাসের কিনারায় লাগাল নিজের ঠোঁট। বন্ধুর হাত আর ঠোঁটের জীবন্ত ছোঁয়া পেয়ে ক্লান্তি ঘুছে গেল। চাঙ্গা হয়ে উঠল মন।
হঠাৎ ও শুনল মচমচ আওয়াজ। কোত্থেকে এল এমন শব্দ? এদিক-ওদিক তাকিয়েও খুঁজে পেল না শব্দের উৎস। হঠাৎ চোখ গেল পাটির পশ্চিম দিকে থাকা বালিশটার ওপর। কাছে গিয়ে ওটাতে হাত দিয়ে স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে মন খারাপ করে ফেলল কামাল।
‘তুমি যা ভাবছ, তা ঠিক। আমার শক্ত পাথর-গড়নের ওপর মাথা রাখলে ভীষণ কষ্ট পেতেন তিনি। সে-যাতনার ভার এখনও বয়ে বেড়াচ্ছি আমি। মাঝে মাঝে আমাকে সরিয়ে মাথার তলে হাত রেখে ঘুমানোর চেষ্টা করতেন। তাতে তাঁর ঘাড়ে যন্ত্রণা হত। ব্যথায় কোঁকড়াতেন। তাঁকে নির্মম কষ্ট দেওয়ার গ্লানি আর অপরাধবোধ এখনও আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।’
‘ঘুমাতে পারতেন তিনি?’
‘প্রায়ই রাতে ঘুমাতে পারতেন না। ছটফট ছটফট করে কাটাতেন। কখনও কখনও শোয়া থেকে উঠে বসে থাকতেন। আর অস্থিরতা কমাতে আদরের শূন্য-পাইপটা মুখে নিয়ে টানতেন, যেন সত্যিই তামাক টানছেন। শেষরাতে ঘরে গরম ভাপ কমে এলে ঘুমাতে পারতেন।’
পাথর-বালিশের কথা শুনে মন নীল যন্ত্রণায় ভরে গেল। আরও কিছুক্ষণ সেখানে কাটিয়ে বাইরে এসে বড় করে শ্বাস ছেড়ে লোহার শিক ধরে দাঁড়াল কামাল। দেখতে লাগল চারপাশ। হঠাৎ শিক বলে উঠল, ‘সুযোগ পেলে আব্দুল মালেক এখানে এসে দাঁড়াতেন। তোমার বন্ধু তখন মালেকের সঙ্গে বাংলায় কথা বলতেন। বাংলায় কথা বলা আর শোনার সুযোগ পেয়ে শিশুর মতো খলবল করতেন তিনি। তাঁর চোখেমুখে তখন ভেসে উঠত মায়ের মুখ। মায়ের ভাষায় কথা বলার সুধা কী মধুর, তাঁর মুখ দেখে আমি বুঝতে পারতাম।’
অনন্য সব কথা শুনে চোখ বুঁজে এল কামালের। তা দেখে লোহার গরাদ আবার বলতে লাগল, ‘চোখ খোলো, শোনো, নিরাপত্তারক্ষীদের ভয়ে যখন মালেককে তাঁর সামনে থেকে সরে যেতে হত গ্রিলের ভেতর থেকে হাত বের করে তিনি তখন তার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিতেন। আমার মনে হত মালেককে নয়, তিনি হাত রাখতেন তোমাদের পুরো জাতির মাথায়।’
শ্রদ্ধায় মাথা ন্যুয়ে এল কামালের।
পরম শান্তি নিয়ে সামনে তাকিয়ে ও দেখল মাটিকাটা একটা কবরের মতো গর্ত। লোহার গরাদ পেরিয়ে এবার এসে দাঁড়াল ওই গর্তের সামনে।
‘আমি কবরের মতো খোড়া কোন গর্ত নই, প্রিয় অতিথি।’
গর্তের ভেতর থেকে আওয়াজ ভেসে আসতে দেখে আবারও চমকে উঠল কামাল। সাহস ফিরে পেয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আমার মনের কথা বুঝে ফেলেছ?’
‘খুউব।’
‘তাহলে বলো তুমি কী?’
‘আমি কবরই। কবরের মতো নই।’
‘তো। তোমার বুক শূন্য কেন? খালি কেন? কবরে লাশ নেই কেন? কাউকে না কাউকে দাফন করা না-হলে সে খোঁড়া গর্তকে কি কবর বলা যায়?’
‘দাফন করার জন্য মাটি খুঁড়ে বানানো হয়েছিল আমাকে।’
‘বলো কি!’
‘ওই যে কুঠুরি, যেখান থেকে তুমি বেরিয়ে এলে, সেখানে আটক ছিলেন এক মহান মানুষ। একাত্তর সালে ৯ মাস ১৪ দিন জনবিচ্ছিন্ন ছিলেন তিনি এখানে। ১৯৭১ সনের ১৬ ডিসেম্বর, তোমাদের বিজয়ের পর তাঁকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল আরও দুর্গম এলাকায়। তাঁকে হত্যা করে মাটি চাপা দেওয়ার জন্য খোঁড়া হয়েছিল আমাকে।’
‘সে-খবর কি তিনি জানতেন?’ বুকে কামড় খেয়ে জিজ্ঞেস করল কামাল।
‘হ্যাঁ। এটাই ছিল আমাদের সেনা-প্রেসিডেন্টের হিংস্রতা, পৈশাচিক উল্লাস। তাঁকে মেরে ফেলা হবে। মেরে গর্তে পুরে ফেলা হবে। পৃথিবীর কাক-পক্ষীও টের পাবে না এ হত্যাযজ্ঞের কথা―এ নিখুঁত পরিকল্পনার পর এসব শোনানোও হতো তাঁকে। তাঁর মনটাকে দুমড়ে-মুচড়ে দিতে চেয়েছিল আমাদের দেশের সামরিক সরকার প্রধান।’
‘এতবড় মানসিক যন্ত্রণা দিয়েছে ওরা আমাদের বন্ধুকে?’
‘সেনা-সরকার সামরিক আইনে লোকদেখানো বিচার করেও তাঁকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল। তাঁর পক্ষে উকিল নিয়োগের জন্য চাপ দিয়েছিল।’
‘উকিল নিয়োগ করেছিলেন তিনি?’
‘আরে না। পাত্তাই দেননি ওদের কথা। সরকারিভাবে এক উকিল নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল শুনেছি। তখন ওই লোহার শিক ধরে চিৎকার করে বাঘের গর্জন ছেড়ে তিনি বলেছিলেন, “আমি রাজনীতিবিদ। সত্তরের নির্বাচনে আমার দল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়েছে, আর আমাকে প্রহসনের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাতে চাচ্ছ, তোমরা? জেনে রেখো, আমার দেশের দামাল ছেলেরা এ ষড়যন্ত্রের দাঁতভাঙা জবাব দেবে, দেশকেও মুক্ত করে ছাড়বে ইনশাআল্লাহ।” বাপরে, বুকের পাটা স্বর্ণপাতে মোড়া না হলে মৃত্যুমুখে দাঁড়িয়ে এমন তেজোময় কথা কেউ বলতে পারে! কী দুর্জয় সাহস তাঁর! কী দুর্ভেদ্য মনোবল! এসব দেখেশুনে তখন থেকে তাঁর স্মৃতির সবটুকুই আমার বুকে তুলে রেখেছি। আজ তোমার কাছে প্রকাশ করে আরাম পাচ্ছি, হালকা হচ্ছি।’
‘কিন্তু আমি তো শুনেছি তাঁকে সামরিক আদালতে তুলেছিল।’
‘ঠিকই শুনেছ। সেখানেও তিনি রাজার মতোই আচরণ করেছেন। উকিল নিয়োগের কথা বলেছিলেন বিচারক। সে-কথায়ও কান দেননি। বরং অন্যদিকে তাকিয়ে আপন মনে তাঁর বুকের আরেক রতন, কালো পাইপটাকে আদর করছিলেন, নাড়াচাড়া করছিলেন।’
‘এসব কথা তুমি কীভাবে জানলে?’
‘এসব কথা কি আর লুকোচাপা থাকত? কয়েদি আর কারারক্ষীরা সব জানত। ওরা ওই যে, ওই উঁচু জায়গায় বসে আড্ডা দিত, এসব আলোচনা করত। শুনে ফেলতাম আমি। এ জন্যই তো জানাতে পারলাম তোমাকে। কমান্ডো আক্রমণ হতে পারে―সে সম্ভাবনার কথাও শুনেছি। উদ্দেশ্য তোমাদের বন্ধুকে হত্যা করা। তোমার বন্ধুও তা জানত। শেষের দিকে ইয়াহিয়া মরিয়া হয়ে উঠেছিল। হতাশায় ডুবে বলেছিল, “আমার সবচেয়ে বড় ভুল আর ব্যর্থতা হল মুজিবকে ফাঁসির দড়িতে না-ঝুলানো, হত্যা করতে না-পারা।” আর এ দিকে একাত্তরের ষোলই ডিসেম্বর তো রেসকোর্স ময়দানে পরাজিত নব্বই হাজার পাকিস্তানি সেনা নিয়ে জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি, যৌথ বাহিনীর প্রধান, ভারতের লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিত সিং আরোরার কাছে আত্নসমর্পণ করে বসে আছে। এ কারণে বিশ্বজনমত উপেক্ষা করে তোমাদের বন্ধুকে হত্যা করার সাহস পায়নি ইয়াহিয়া।’
আবার কী যেন জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছিল কামাল। সে সুযোগ পেল না। হঠাৎ শুনল কবরের ভেতর শোরগোল শুরু হয়েছে। সে আওয়াজ অনুসরণ করে হাঁটুগেড়ে বসে ও তাকাল ভেতরের দিকে। তখনই থেমে গেল শোরগোল। কামাল দেখল সেখানে মাটি খুঁড়ে আঁকা হয়েছে বাংলাদেশের সবুজ পতাকা। আর তার মাঝে আঁকা দেশের লাল মানচিত্র বুকে নিয়ে পতাকাটা তাকিয়ে আছে কামালের দিকে।
‘কী ব্যাপার, তুমি এখানে শায়িত হলে কীভাবে?’
‘ওই কুঠুরির লোহার কঠিন শিক শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে থেকে তোমার বন্ধু বলতো, ‘প্রিয় কবর, ওরা যদি আমাকে হত্যা করে, যদি তোমার বুকে ছুঁড়ে দেয়, আমাকে নরম করে ধোরো। আমাকে মাটি চাপা দেওয়ার আগে আমার দেশের মানচিত্র হয়ে যেয়ো তুমি। আর আমার দেশের পতাকা দিয়ে ঢেকে দিয়ো আমাকে। যদি পারো, উড়াল দিয়ে চলে যেয়ো আমার দেশে। আমি শেষ ঠিকানা হিসেবে আমার দেশের মাটি চাই।’
শুনে কামালের বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠল।
কবর আবার বলতে লাগল, ‘সেই থেকে আমি এখানে এক টুকরো বাংলাদেশ। এই ফয়সলাবাদে কুখ্যাত ইয়াহিয়ার খোঁড়া কবর হয়ে গেল স্বাধীন দেশ, বাংলাদেশ। তোমার বন্ধু, তোমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলার প্রতীক হয়ে আছি আমি।’
কামালের মনে হল মিয়ানওয়ালি কারাকুঠুরির একটা লাল-সবুজ চোখ আছে। সেই চোখ নিজের চোখে পুরে ও তাকাল সামনে। বিস্ময় নিয়ে দেখল, বঙ্গবন্ধু হাসছেন। ভুবনজয়ী সে-হাসির ঢেউ ছড়িয়ে যাচ্ছে বিশ্বজুড়ে।
কথাসাহিত্যিক মোহিত কামালের গল্প: মিয়ানওয়ালি কারাকুঠুরির লাল-সবুজ চোখ
এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
কথাসাহিত্যিক মোহিত কামালের জন্ম ১৯৬০ সালের ০২ জানুয়ারি চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলায়।
তাঁর বাবার নাম আসাদুল হক এবং মায়ের নাম মাসুদা খাতুন। তাঁর শৈশব-কৈশোর কেটেছে আগ্রাবাদ, চট্টগ্রাম ও খালিশপুর, খুলনায়। বর্তমান নিবাস ধানমন্ডি, ঢাকা। স্ত্রী মাহফুজা আখতার মিলি, সন্তান মাহবুব ময়ূখ রিশাদ, পুত্রবধূ ইফফাত ইসলাম খান রুম্পা ও জিদনি ময়ূখ স্বচ্ছকে নিয়ে তাঁর সংসার। চার ভাই এক বোনের মধ্যে চতুর্থ সন্তান তিনি। তাঁর অ্যাফিডেভিট করা লেখক-নাম মোহিত কামাল। তিনি সম্পাদনা করছেন শুদ্ধ শব্দের নান্দনিক গৃহ, সাহিত্য-সংস্কৃতির মাসিক পত্রিকা শব্দঘর। তাঁর লেখালেখির মুখ্য বিষয় : উপন্যাস ও গল্প; শিশুসাহিত্য রচনার পাশাপাশি বিজ্ঞান বিষয়ে গবেষণাধর্মী রচনা। লেখকের উড়াল বালক কিশোর উপন্যাসটি স্কলাস্টিকা স্কুলের গ্রেড সেভেনের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে; ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্যও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পাঠাভ্যাস উন্নয়ন কর্মসূচি (ঝঊছঅঊচ) কর্তৃকও নির্বাচিত হয়েছে। এ পর্যন্ত প্রকাশিত কথাসাহিত্য ৩৭ (উপন্যাস ২৪, গল্পগ্রন্থ ১৩)। এ ছাড়া কিশোর উপন্যাস (১১টি) ও অন্যান্য গ্রন্থ মিলে বইয়ের সংখ্যা ৫৫।
জাতীয় পুরস্কার: কথাসাহিত্যে অবদান রাখার জন্য তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (২০১৮), অগ্রণী ব্যাংক-শিশু একাডেমি শিশুসাহিত্য পুরস্কার ১৪১৮ বঙ্গাব্দ (২০১২) অর্জন করেছেন।
তাঁর ঝুলিতে রয়েছে অন্যান্য পুরস্কারও; হ্যাঁ (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০২০) উপন্যাসটি পেয়েছে সমরেশ বসু সাহিত্য পুরস্কার (২০২০)। পথভ্রষ্ট ঘূর্ণির কৃষ্ণগহ্বর (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০১৪) উপন্যাসটি পেয়েছে সিটি আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার (২০১৪)। সুখপাখি আগুনডানা (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০০৮) উপন্যাসটি পেয়েছে এ-ওয়ান টেলিমিডিয়া স্বাধীনতা অ্যাওয়ার্ড ২০০৮ এবং বেগম রোকেয়া সম্মাননা পদক ২০০৮―সাপ্তাহিক দি নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেস-প্রদত্ত। না (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০০৯) উপন্যাসটি পেয়েছে স্বাধীনতা সংসদ নববর্ষ পুরস্কার ১৪১৫। চেনা বন্ধু অচেনা পথ (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০১০) উপন্যাসটি পেয়েছে ময়মনসিংহ সংস্কৃতি পুরস্কার ১৪১৬।
কিশোর উপন্যাস উড়াল বালক (রোদেলা প্রকাশনী, ২০১২; অনিন্দ্য প্রকাশ, ২০১৬) গ্রন্থটি ২০১২ সালে পেয়েছে
এম নুরুল কাদের ফাউন্ডেশন শিশুসাহিত্য পুরস্কার (২০১২)।
তিনি মনোচিকিৎসা বিদ্যার একজন অধ্যাপক, সাবেক পরিচালক জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ,ঢাকা
একটি মন্তব্য করুন
একটি মন্তব্য করুন